বাংলাদেশ, , শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

সৃজনশীল পদ্ধতিঃ জ্ঞান নয় কল্পনা শক্তিই বড় : ড.মুহাম্মদ মাসুম চেীধুরী

  প্রকাশ : ২০২০-০৭-০৯ ১৫:২২:৩১  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : মহাকালের এক সেরা কথা ‘জ্ঞানের চেয়ে কল্পনা শক্তি অনেক বড়’। কথাটা বলেছিলেন,সর্বকালের সেরা এক বিজ্ঞানী আলভার্ট আইনস্টাইন। সত্তর বছর পূর্বের এই ছোট অসাধারণ কথাটিই ছিল আজকের সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির উৎস।যে কথাটির অর্থ বুঝতে আমাদের সত্তর বছর সময় প্রয়োজন হলো।
আবিস্কারের পর আবিস্কার করে এই দুনিয়াটাকে যাঁরা আধুনিক কালে এগিয়ে এনেছেন তাঁরা সবাই পড়ার চেয়ে চিন্তা ও কল্পনা শক্তিকে অধিক ব্যবহার করেছিলেন।একজন মানুষের বড় সম্পদ হলো সৃজনশীলতা। সৃজনশীলতার কারণেই গুহাবাসী মানুষ মহাকাশ পাড়ি দিচ্ছে আর গুহার শিয়াল গুহায় থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে।
নিউটন ভাবছিলেন, আপেলটা উপরে গেল না কেন! তাঁর কল্পনার ফসল মধ্যাকর্ষণ শক্তির আবিষ্কার।
শিক্ষক অভিভাবক শিক্ষার্থীদের বলেন, পড় পড় পড়। বেশী করে পড়। আমি আমার ছাত্রদের বলি, পড় কম, ভাবো বেশী।
কবি টেনিসন বলতেন, ‘Knowledge comes but wisdom lingers’, আমাদের বিদ্যা আসে প্রজ্ঞা আসে না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমাদের বিদ্যা আসে বুদ্ধি আসে না’। প্রজ্ঞা আর বুদ্ধি আসে কল্পনা শক্তি হতে।
অনেক বৈজ্ঞানিক উপকরণের আবিস্কারক থমাস আলভা এডিসন তরুণ বয়সে মুরগীর ডিমে তা দিতে অনেকদিন ডিমের উপর বসে ছিলেন। ভাবছিলেন,মুরগীর তা দ্বারা বাচ্চা ফুটলে, মানুষের তা দ্বারা ফুটবে না কেন? এটি ছিলো তাঁর চিন্তার চর্চা।
কোরান অর্থ অধ্যয়ন। কেরাত ও তেলওয়াত অর্থ অধ্যয়ন। পবিত্র কোরানের প্রথম নাজিলকৃত পাঁচটি আয়াতই জ্ঞান এবং বিজ্ঞানের। সূরা ইয়াসিনের শুরুতে মহান আল্লাহ পাক ‘বিজ্ঞানময় কোরানের শপথ’ করেন। আরেক আয়াতে ‘কলম’এর শপথ করেছেন। আল্লাহ পাক যে বস্তুর শপথ করেন তার মর্যাদা অনেক বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ পাক শপথের মাধ্যমে যে জ্ঞান বিজ্ঞানময় কোরানের মর্যাদা বৃদ্ধি করলেন, সে কোরান কিন্তু খানায়ে কাবায় নাজিল হয়নি।অথচ কাবা ঘরের পাশে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘর। কোরান নাজিল, জিবরাইল (আঃ)’র আগমন, নবুয়ত প্রকাশ সবই হয়েছে খানায়ে কাবা হতে ছয় মাইল দূরে, সমতল হতে আড়াই হাজার ফুট উপরে,জাবালে নুরের চূড়ায়, হেরা গুহায়। নবুয়ত প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে এক দুই বছর নয়, পনের বছর গেলেন জ্ঞান সাধনার জন্য নয়, ধ্যান, চিন্তা এবং কল্পনা শক্তির বিকাশ সাধন করতে। গৌতম বুদ্ধ অস্বথ বৃক্ষের নীচে একাধারে ধ্যান করেন ছয় বছর। আল্লাহ অলিগণ বছরের পর বছর পাহাড় পর্বতে চিল্লা করতেন জ্ঞান চর্চার জন্য নয়, ধ্যানের মাধ্যমে কল্পনা শক্তির বিকাশ সাধন করতে।
কোরান পাঠ মানে কোরানের বিষয়গুলো চিন্তা করা। তাই এই কোরানেই ‘তাফাক্কুর'(চিন্তা বা গবেষণা) শব্দটি নানা ভাবে ১৮টি আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
‘জ্ঞানের চেয়ে কল্পনা শক্তি অনেক বড়’ কথাটি আইনস্টাইনের আধুনিক কালের ঘোষণা মনে করা হলেও চৌদ্দশত বছর পূর্বেই কোরান এবং প্রিয় নবী (দঃ) এই শিক্ষা মানব জাতিকে দিয়ে গেছেন।
হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামগণকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে জ্ঞান শিক্ষা দিতেন। কারণ প্রশ্ন করলে শ্রোতা অমনোযোগী হওয়ার সুযোগ থাকে না। মন স্থির থাকে চিন্তা ও কল্পনার জগতে।কল্পনার শিক্ষাই সৃজনশীল। পবিত্র কোরানের বহু স্থানে মহান আল্লাহ পাক বান্দাকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন। রাত এবং দিনের মধ্যে সবচেয়ে অধিক মর্যাদাবান ‘লাইলাতুলকদর’। মহান আল্লাহ পাক এই রাতের গুরুত্বের কথা চিন্তা ও কল্পনা করতে সূরা ‘কদরে’ প্রশ্ন করেছেন,’ওমা আদরাকা মা লাইলাতুলকদর? আপনি জানেন,লাইলাতুলকদর কী? এই প্রশ্নের পর মহান আল্লাহ পাক অসাধারণ নিউজ দিলেন,’লাইলাতুলকদর’ হলো হাজার মাসের চেয়ে উত্তম’।(হাজার মাসের চেয়ে কত উত্তম তা কল্পনা জন্য রাখলেন)।
একবার লেখা দশবার পড়ার সমান। একবার ভাবা দশবার লেখার সমান। আজ সৃজনশীল শিক্ষার যুগে লেখা ও ভাবার মানুষের সংখ্যা কমছে। সংবাদপত্র, সামাজিক যোগাযোগ ও ইন্টারনেটের মধ্যে ছবি দেখার সংখ্যা পাঠকের চেয়ে অনেক বেশী। যুগটা যতই সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির হোক এখন আইনস্টাইনের জন্ম হবে কী করে?
আজকের তরুণ সমাজ সিনেমার নায়ক হতে চায়, ক্রিকেট তারকা, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার হতে চায় কিন্তু কেউ নিউটন, আইনস্টাইন, শেক্সপিয়ার, রবীন্দ্র-নজরুল হতে চায় না। যে সব তারকাদের অনুসরণে চুল রাখে, কাপড় পড়ে তাদের স্ট্রাগাল জীবন অনুসরণ করে না।
আজ তরুণ সমাজের মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কিন্তু শরীরটা ঠিক আছে। সেরা বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের মাথাটা ঠিক ছিল, শরীরটা ছিলো অকেজো। মাথার কল্পনা শক্তি দ্বারা সেরা সেরা সৃজনশীল কাজ করেছেন। মানুষের সৃজনশীল ক্ষমতা অসীম।তার ক্ষুদ্র অংশ ব্যবহার করে আধুনিক বিশ্ব তৈরী হয়েছে। সেরা বিজ্ঞানীরা ১৫% ব্রেইন সেল ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক ছিলো দেড় লিটার।জগতের অধিকাংশ মানুষের মস্তিষ্ক দেড় লিটার।সকলের ক্ষমতা আইনস্টাইনের সমান।বিজ্ঞানীরা হিসেব করে বলেছেন,একটি কম্পিউটারের দাম যদি ৫০ হাজার টাকা হয় তাহলে দেড় লিটার মস্তিষ্কের দাম হবে ৫ হাজার কোটি টাকা। মানুষের মাঝে আলাদীনের চেরাগ আছে,আমরা সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালিয়েছি।মানুষের সৃজনশীলতা সামনে দুনিয়ার কোন সমস্যাই টিকে থাকতে পারে না।
এক রিপোর্টে দেখা যায়, মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রায় ৫০% সৃজনশীল প্রশ্ন করতে পারে না। এ ধরনের শিক্ষক দিয়ে সৃজনশীল জাতি গঠন হবে কী করে?
আমরা বই পড়ে একটা কল্পনার জগৎ তৈরী করতাম। ‘বীরপুরুষ’ কবিতা পড়ে কল্পনা করতাম,’ইস’ আমি এ ধরনের বীর পুরুষ হলে জগৎ বিজয়ী হতাম। আজ সে কল্পনার জগতের বিশালতা কোথায়?
আলভার্ট আইনস্টাইন লণ্ডনে নিজের বাড়ির নাম্বার ভুলে বাড়ি খুঁজে পেল না।ফোন নাম্বার মনে থাকতো না। নিউটন রেশনের পণ্য নিতে গিয়ে নিজের নাম ভুলে গেলন। তিনি একটি মুরগীর ঘর নির্মাণ করতে গিয়ে বাচ্চার জন্য একটি ছোট আর মুরগীর জন্য একটি বড় দরজা রাখলেন। বড় দরজাটা দিয়ে মুরগির বাচ্চা ঢুকতে পারবে সে চিন্তা মাথায় আসলো না। এই সব বিষয় শুনে অনেকে ভাবতে পারে তাঁরা পাগল না হয় মেধাহীন ছিলেন!না তা সঠিক নয়। এখানে কারণ দুটি। প্রথমত বিজ্ঞানীরা যে বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করেন তা পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা চিন্তা করেন।অন্য ছোট বিষয়গুলো তখন মাথায় ঢুকে না।দ্বিতীয়ত, তথ্য জমা রাখা আর তথ্য বিশ্লেষণ করা এক বিষয় নয়। শত শত কবিতা, বই, ফোন নাম্বার, মানুষের নাম মুখস্থ রেখে তথ্য জমা করে হার্ডডিস্ক তাঁরা পূর্ণ করেননি।তাঁরা তথ্য বিশ্লেষণ করেন।কল্পনা শক্তি দ্বারা তথ্য বিশ্লেষণ করতঃ আবিস্কারের পর আবিস্কার করেছেন অনেক অজানা অধ্যায়।
আইনস্টাইন যখন নতুন তত্ত্ব ‘Theory of Relativity’ প্রদান করেন তখন এই তত্ত্ব নিয়ে দুনিয়াজুড়ে হই চই পড়ে গেল।আমেরিকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এই তত্ত্ব সম্পর্কে জানতে আইনস্টাইনকে আমন্ত্রণ জানালো।তিনি গিয়ে এই তত্ত্ব বিষয়ক একটি মাত্র বক্তব্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদান করেন। তিনি এক প্রতিষ্ঠানে বক্তব্য দিতে যাওয়ার কালে ড্রাইভার বললো,স্যার, আপনার একটি বক্তব্য বারবার শুনে পুরো বক্তব্যটি আমার মুখস্থ হয়ে গেছে।চাইলে আপনার পরিবর্তে বক্তব্যটা আমি দিতে পারি।আইনস্টাইন বললেন,ঠিক আছে,তুমি আমার ড্রেস পড়, আমি তোমার ড্রেস পড়ি। তুমি আইনস্টাইন হিসেবে মঞ্চে বসে বক্তব্য রাখবে আর আমি বসবো ড্রাইভারের চেয়ারে। তখন এত বেশী ছবির প্রচলন ছিল না। তাই মানুষ অপরিচিতদের চিনতো না। এই সভায় প্রচুর বিজ্ঞানী হাজির হলো। ড্রাইভার পুরো বক্তব্য মুখস্থ বলে গেল।বক্তব্য শেষে এক বিজ্ঞানী একটি প্রশ্ন করে বসলো। ড্রাইভার তো বক্তব্য মুখস্থ করেছে, মস্তিষ্কে তথ্য জমা রেখেছে কিন্তু তথ্য বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা অর্জন করেনি। কী করে উত্তর দিবে! কিন্তু বুদ্ধিমান ড্রাইভার উত্তরে বললো,এই ছোট্ট প্রশ্নের আমি উত্তর দিতে চাই না।এই প্রশ্নের উত্তর দিবে আমার ড্রাইভার। ড্রাইভারের চেয়ার হতে আইনস্টাইন মঞ্চে উঠে অসাধারণ ভাবে প্রশ্নের উত্তর দিলেন। মানুষ বিস্মিত হয়ে ভাবলেন,আইনস্টাইনের ড্রাইভার যদি এত জ্ঞানী হয়,তাহলে আইনস্টাইন কত বড় জ্ঞানী।
এ সব বিষয় বিশ্লেষণ পূর্বক আত্মস্থ করা যায়, জ্ঞান নয়,কল্পনা শক্তির মাধ্যমে তথ্য বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাই সৃজনশীলতা।
লেখক : প্রাবন্ধিক,কলামিষ্ট ও শিক্ষাবিদ।



ফেইসবুকে আমরা