বাংলাদেশ, , মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

নীতি নৈতিকতার অবক্ষয়ে ঘটছে দুর্নীতি বিঘ্নিত হচ্ছে উন্নয়ন :: ডাঃ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন

  প্রকাশ : ২০১৯-০৭-২৪ ১৩:০৬:৪৮  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : মানুষ এমন এক ধরনের প্রাণী যা জন্মগ্রহণ করে সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে। একটা পূরণ হলে আর একটা চাই। এভাবেই চলে মানুষের চাহিদা, ক্ষুধা ও লোভের উত্তরোত্তর বেড়ে চলা। ফ্রাঙ্ক বুকম্যান বলেছেন, ‘পৃথিবীতে সবার প্রয়োজন মেটাবার জন্য যথেষ্ট সম্পদ রয়েছে, কিন্তু সবার লোভ মেটাবার জন্য তা যথেষ্ট নয়।’ প্রয়োজনের অতিরিক্ত জাগতিক উচ্চাভিলাষ ও লোভ-লালসা দুর্নীতির কারণ। দুর্নীতির অন্যতম প্রধান কারণ নৈতিক অবক্ষয় এবং ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষার অভাব। মূলত ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে এবং নিয়মবহির্ভূত সব ধরনের কাজকর্ম, আচার ব্যবহার, কথাবার্তা এবং জাগতিক লোভ ও মতার বশবর্তী হয়ে বিত্তবাসনা চরিতার্থ করার জন্য অবৈধ পথে আয়-উপার্জন করাকে দুর্নীতি বলে। অসৎ উপায়ে টাকা কামানো যেমন- সুদ, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, প্রতারণা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, কালোবাজারি, মতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন ধরনের অবৈধ প্রক্রিয়ায় সম্পদ আহরণই হলো দুর্নীতি। এককথাই যাবতীয় অনিয়মই দুর্নীতি। ‘দুর্নীতি’র ইংরেজি প্রতিশব্দ Corruption শব্দটি ল্যাতিন ক্রিয়া Corruptus শব্দ থেকে এসেছে। উইকিপিডিয়া অনুসারে, দর্শন, ধর্মশাস্ত্র অথবা নৈতিকতার আলোকে দুর্নীতি হলো আধ্যাত্মিক ও নৈতিক অবয় অথবা অর্থনৈতিক আর্দশ থেকে বিচ্যুতি। দুর্নীতি হচ্ছে- অনর্জিত আয়, যা পেতে আইন ও বিধিস্বীকৃত পন্থা অনুসৃত হয়নি। সহজ কথায় অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া, মতার অপব্যবহার, দায়িত্বে অবহেলা ও নিজ স্বার্থে নীতিভ্রষ্ট হয়ে কাজ করাই দুর্নীতি। নীতির বিপরীত দুর্নীতি। নীতি হলো সত্যের নির্দেশ। যখন নীতি নৈতিকতা ভূলে গিয়ে মানুষ লোভাতুর হয়ে পড়ে তখনই ডেকে আনে সর্বনাশ। কেননা প্রতিটি মানুষের ভেতর হিংস্র পশু আছে, যেটা প্রতিনিয়ত অন্যায় ও পাপ কাজে উৎসাহিত করে। সেই হিংস্র পশু বা পাপিষ্ঠ আত্মার ক্রিয়াকর্মই হলো দুর্নীতি। দুর্নীতি তখনি হয়, যখন নিজের আত্মার ও প্রবৃত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না, যখন সত্যের ওপর মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়; যখন পশুত্ব মনুষ্যত্বকে অতিক্রম করে, যখন প্রয়োজনের তুলনায় ‘চাহিদা’ বেশি হয় ও যখন লোভ বেড়ে যায়। লোভের কারণেই দুর্নীতি হয়। দুর্নীতি আমাদের দেশে একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। অতিরিক্ত ‘চাহিদা’ই সৎ জীবনযাপনের প্রধান অন্তরায়। অভাব দুর্নীতির প্রধান কারণ নয়। কেননা, নৈতিকভাবে যারা আদর্শবান ও নির্লোভ তারা অভাব সত্ত্বেও সব সময় দুর্নীতি থেকে দূরে থাকেন। দুর্নীতি মানুষের সহজাত কুপ্রবৃত্তিগুলোর অন্যতম। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন, ‘কোনো আদম সন্তান যদি স্বর্ণ-রত্নরাজি পরিপূর্ণ একটি উপত্যকা কোনো সময় পেয়ে যায়, তাহলে সে দ্বিতীয় উপত্যাকাটি চাইবে। মাটি ছাড়া কোনো কিছুই তার মুখ বন্ধ করবে না।’ দুর্নীতিবাজেরা সমাজের ও দেশের ‘বিত্তশালী রাস’। অর্থ সম্পদের ও মতার প্রতি অতিরিক্ত লোভ বা মোহ মানুষকে দুর্নীতির দিকে ঠেলে দেয়। সম্পদের প্রতি মোহ এমন যে, এর সীমা-পরিসীমা নেই। দুর্নীতি মানুষকে আত্মমর্যাদাহীন করে তোলে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু দুর্নীতিই দেশের জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ খেয়ে ফেলেছে। দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমন করতে পারলে জিডিপির হার আরো বাড়বে। দুর্নীতি দারিদ্র্য ও সব ধরনের অনিয়ম, অবিচার বাড়ায় ও উন্নয়নকে ব্যাহত করে। দুর্নীতি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও কল্যাণকর প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য বাড়ায়। মানুষের মধ্যে যদি নৈতিক মূল্যবোধ ও নীতিবোধ সদাজাগ্রত থাকত, তাহলে উন্নয়নের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। যারা দুর্নীতি করে তাদের অর্থের জোর থাকলেও মনের জোর থাকে না। দুর্নীতিই দেশের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। যে দেশ যত বেশি দুর্নীতিমুক্ত, সে দেশ তত বেশি উন্নত। দুর্নীতি হয় অন্ধকারে। এর বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে প্রকাশ্যে। লোভ ও সুযোগ এই দুইয়ের সমন্বয় হলেই মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়। দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের প্যাকেজ ভাঙতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এজন্য মানুষের নৈতিক সংস্কার দরকার। আগে আমাদের চরিত্র পরিবর্তন করতে হবে। যে দিন আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে স্ব-প্রণোদিত হয়ে সুশিক্ষা ও নৈতিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে আত্মশুদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে জীবনকে সৎ ও সুন্দরভাবে গঠন করার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করব, সে দিন সমাজ থেকে দুর্নীতি চিরতরে বিদায় নেবে। সৎ, নির্লোভ, নির্মোহ ও বিশ্বস্ত থাকলে দুর্নীতি অনেক কমবে। মেধাবী ও সার্টিফিকেটধারীরা অনেকেই আজ দুর্নীতির দায়ে জেলে ও শাস্তি ভোগ করছেন। যা অতীব দুঃখজনক এ থেকে পরিত্রানের জন্য সবাইকে সৎ এবং নির্লোভ হতে হবে। ভোগ বিলাসের জীবনযাত্রা এবং স্বার্থপরতা সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত অবস্থায় সাধারণ থেকে কিভাবে অসাধারণ হওয়া যায় তার প্রমাণ রেখে যেতে হবে। যার আত্মার ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে এবং যিনি নির্লোভ, তিনি কখনো দুর্নীতি করতে পারেন না। সঠিক পন্থা এবং সৎ পথ ধরে এগিয়ে আসলেই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সাফল্য পাওয়া যাবে। সামাজিক সচেতনতা এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখলে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব। যে সমাজে ও রাষ্ট্রে চরিত্রবান ও নির্লোভ মানুষের সংখ্যা যত বেশি, সে সমাজ তত উন্নত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে পরিবারভিত্তিক প্রতিবাদ জোরালো করলে দুর্নীতির বিষবৃ সমূলে উৎপাটিত হতে পারে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে নিজের ভালো এবং অপরের কল্যাণ কামনায় সাধ্যমতো চেষ্টা করা চাই। বাংলাদেশে নৈতিক অবয়ের মূল কারণ ও তার প্রতিকার সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যায় আমাদের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের নৈতিক শিক্ষার চরম অভাব রয়েছে। নৈতিক শিক্ষার শুরু হওয়া উচিৎ পরিবার এবং একেবারে প্রাইমারী লেভেল থেকে। কিন্তু আমাদের শিক্ষা কারিকুলাম ও শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ এমন অবস্থায় রয়েছে যে, এর আমূল সংস্কার ব্যতীত নৈতিকতার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। কেননা নৈতিকতার মানোন্নয়ন ব্যতীত সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে সন্ত্রাস, দূর্নীতি ও অন্যান্য দুষ্কর্ম দূর করা সম্ভব নয়। যারা শিার ঝুলি মাথায় নিয়ে সার্টিফিকেটধারী খেতাবে ভূষিত হয়ে অফিস আদালতে চেয়ার-টেবিলে বসে ফাইল আটকিয়ে অর্থনৈতিক শোষণ, অফিসে দূর্নীতি, নিরাপত্তা ও রাজনীতিতে অস্বস্তি সৃষ্টি করছে, তারা বিদেশেও আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে চলছে। মাত্র ৫% দূর্নীতিবাজের জন্য ৯৫% মানুষকে এর প্রায়শ্চিত্ত ভোগ ও দূর্ণাম পোহাতে হচ্ছে। রিকশাওয়লা, ভ্যানচালক, ফেরিওয়ালা, জুতার মুচি, নাপিতরা দূর্ণীতি করে না। বাসার বউ বাচ্চাদের জন্য দামি দামি গিফট নেয় না। দূর্নীতি করে তারাই যারা মূল্যবোধের বিপরীতে অনৈতিকতার চূড়ান্ত শিখরে উপণীত। তবে আশার আলো এই যে, এদেশের ৮৫-৯০% মানুষ সৃষ্টিকর্তার প্রতি আস্থা ও পরকালীন জীবনের প্রতি বিশ্বাস রাখে। এ কারণে সহজেই এ সমস্যা উতরানো সম্ভব। শুধু প্রয়োজন সঠিক ইচ্ছার ও যথার্থ পরিকল্পনার। পারিপার্শি¦ক পরিবেশ, সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির আত্মশুদ্ধি সবকিছুর জন্যই নৈতিক শিক্ষা প্রয়োজন। বিবেক, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের জাগরণ দুর্নীতি প্রতিরোধে সহায়তা করে। দুর্নীতি দমনে মানসিকতার পরিবর্তন ও সদিচ্ছাই অপরিহার্য। দুর্নীতি প্রতিরোধে কারিকুলামে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সৃষ্টিকারী বিষয় দুর্নীতি প্রতিরোধে সাহায্য করে। মহৎ মানুষের জীবন ও আদর্শই সাফল্যের বাতিঘর। শৈশব থেকে দুর্নীতির কুফল এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজের সুফলের ধারণা দিতে পরিবার ও বিদ্যালয়ের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রতিষ্ঠানিক দুর্নীতি কমিয়ে আনতে কর্তাব্যক্তির সদিচ্ছা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং সমাজ পরিবর্তনের স্বার্থেই দুর্নীতি প্রতিরোধ করার জন্য কার্যকর পদপে নিতে হবে। দুর্নীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে তখনই সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে, যখন বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত হবে। দতা ও মানবিকতার বিকাশ, নৈতিকতা ও নিষ্ঠার অনুশীলন, শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার চর্চা প্রয়োজন। দুর্নীতি বন্ধে সংশ্লিষ্টদের কর্মকাণ্ড তদারকীর আওতায় এনে দোষীদের বিরুদ্ধে তাৎণিক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে যাতে দুর্নীতিবাজরা বেরিয়ে যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি করলে কঠোর শাস্তি পেতে হবে, এই ভয়টা মানুষের মধ্যে ঢোকাতে পারলে সবাই ধীরে ধীরে দুর্নীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। এসব বিষয় নিয়ে সাধারণ জনগণ ও সরকারকে এখনই চিন্তাভাবনা করতে হবে। নৈতিকতামূলক শিক্ষা এবং আইনের সঠিক প্রয়োগই পারে আমাদের এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিষ্ট,
সভাপতি, বৃহত্তর চট্টগ্রাম ডেন্টাল এসোসিয়েশন।



ফেইসবুকে আমরা