বাংলাদেশ, , শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী ও আমাদের বাংলাদেশ : লায়ন ডাঃ বরুণ কুমার আচার্য বলাই

  প্রকাশ : ২০১৯-০৩-১৭ ২০:১৮:১২  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : ১৭ মার্চ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০০তম জন্মদিন এবং জাতীয় শিশু দিবস। একই সঙ্গে দুটি দিবস হওয়ার কারণ হলো, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশুদের অত্যন্ত আদর-স্নেহ করতেন ও ভালোবাসতেন। শিশুদের নিয়ে তাঁর অনেক স্বপ্ন ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন আজকের শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। আগামিতে দেশ গড়ার নেতৃত্ব দিবে শিশুরা।
শেখ মুজিবুর রহমান তদানীন্তন ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা শেখ লুৎফর রহমান এবং মার নাম সায়েরা খাতুন। চার কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে তিনি ছিলেন তৃতীয় সন্তান। ১৯২৭ সালে ৭ বছর বয়সে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। নয় বছর বয়স তথা ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন এবং এখানেই ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত পড়াশানা করেন। ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জে মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৩৪ থেকে চার বছর তিনি বিদ্যালয়ের পাঠ চালিয়ে যেতে পারেন নি। কারণ তাঁর চোখে জটিল রোগের কারণে সার্জারি করাতে হয়েছিল এবং এ থেকে সম্পূর্ণ সেরে উঠতে বেশ সময় লেগেছিল। গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৩৮ সনে আঠারো বছর বয়সে তাঁর সাথে ফজিলাতুন্নেসার বিয়ে হয়। এই দম্পতির ঘরে দুই কন্যা এবং তিন পুত্রের জন্ম হয়। কন্যারা হলেন শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। আর পুত্রদের নাম শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেল। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর আয়োজিত এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর আক্রমন শুরু করলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট নিজ বাসভবনে মতালোভী ঘাতকদের হাতে সপরিবারে শহিদ হন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করার পর এ দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ২৪ বছরের রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে ১৩ বছর ৯ মাস অর্থাৎ প্রায় ১৪টি বছর কারাবন্দি থেকেছেন, জেল নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, কারা প্রাচীরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ৫১১০টি দিন অতিবাহিত করেছেন। তিনি তাঁর জীবনে শ্রেষ্ঠ সময় অতিবাহিত করেছেন কারান্তরালে, যৌবনের সুন্দর দিনগুলো যিনি উৎসর্গ করলেন দেশ ও জাতির মুক্তির জন্য। তাঁকেই আবার হত্যা করা হয়েছে এ দেশের মাটিতে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বিশ্বের অন্যতম রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব। শুধু বাংলাদেশের মানুষের কাছে নয়, বিশ্বের অন্যতম রাষ্ট্রনায়ক, নেতা, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও মনীষীদের কাছে ছিলেন প্রিয়পাত্র।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, তাঁর সিদ্ধান্ত, অবিচলতা নিয়ে বলতে গিয়ে ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো’।
ব্রিটিশ জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের প্রকাশ করেছিল,‘শেখ মুজিব ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব।’
ফিনান্সিয়াল টাইমস প্রকাশ করেছিল, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনই জন্ম নিত না।’
ভারতীয় জনপ্রিয় বেতার ‘আকাশবাণী’ ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট তাদের সংবাদ পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে সম্প্রচার করেছিল, ‘যিশু মারা গেছেন। এখন ল ল লোক ক্রস ধারণ করে তাঁকে স্মরণ করছে। মূলত একদিন মুজিবই হবেন যিশুর মতো।’
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দিনে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, ‘বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকী নিউজউইকে বঙ্গবন্ধুকে, ‘পয়েট অফ পলিটিক্স’ তথা রাজনীতির কবি হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। যুদ্ধবিরোধী ব্রিটিশ আন্দোলনকারী ও রাজনীতিবিদ লর্ড ফেন্যার ব্রোকওয়ে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী এবং দ্যা ভ্যালেরার থেকেও মহান নেতা’।জাপানের খ্যাতিমান অধ্যাপক, লেখক ও জাপান রেডক্রসের প্রাক্তন প্রধান পরিচালক ফুকিউরা তাদামাসা আজও বাঙালি দেখলে বলে বেড়ান, ‘তুমি বাংলার লোক? আমি কিন্তু তোমাদের জয় বাংলা দেখেছি। শেখ মুজিব দেখেছি। জানো এশিয়ায় তোমাদের শেখ মুজিবের মতো সিংহ, হৃদয়বান নেতার জন্ম হবে না বহুকাল।’
পশ্চিম জার্মানি’র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, শেখ মুজিবকে ফ্রান্সের রাজ চতুর্দশ লুইয়ের সাথে তুলনা করা যায়। জনগণ তাঁর কাছে এত প্রিয় ছিল যে লুইয়ের তিনি এ দাবি করতে পারেন ‘আমি-ই রাষ্ট্র’।
বিবিসি ১৫ অগাস্ট ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এক সম্প্রচারে বলেছিল, ‘শেখ মুজিব নিহত হলেন তাঁর নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে অথচ তাঁকে হত্যা করতে পাকিস্তানীরা সংকোচবোধ করেছে’।
বিশ্বের অন্যতম লৌহমানব ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।’ ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাত বলেছিলেন, ‘আন্দোলনের আপোষহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য’।
নোবেল বিজয়ী উইলিবান্ট দুঃখ প্রকাশ করেই বলেছিলেন, ‘মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না, যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যেকোন জঘন্য কাজ করতে পারে’।
ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব নিহত হবার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তার অনন্য সাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল’।
ইংলিশ এমপি জেসলামন্ড দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশই শুধু এতিম হয়নি, বিশ্ববাসী হারিয়েছে এক মহান সন্তানকে’।
মরহুম মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীও বলেছিলেন, ‘টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবের কবর একদিন সমাধিস্থলে রূপান্তরিত হবে এবং বাঙালির তীর্থস্থানের মতো রূপলাভ করবে’।
বঙ্গবন্ধুর নিহত হবার সংবাদ শুনে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এতটাই দুঃখ পেয়েছিলেন যে, তিনি আপে করে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমার-ই দেয়া ট্যাং দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ! আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি’।
১৭ মার্চ বাঙালির আনন্দের দিন। খুশির দিন। কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দিনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জীবনের পুরো সময় কেটেছে সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সংগ্রামী নেতা হিসেবে যেমন অর্জন করেছে সাফল্য, তেমনি বিশ্বের সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের দরবারে ঠাঁই করে নিয়েছেন, তিনি হলেন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। ২০০৪ সালে ২৬ মার্চ বিবিসি বাংলা’র শ্রোতা জরিপে বঙ্গবন্ধুকে শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে সম্প্রচার করা হয়। তিনি বাঙালি জাতিকে স্বাধীন রাষ্ট্র এনে দিয়েছেন। ফলে পৃথিবীর মানচিত্রে বাঙালির আবাসভূমি বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু বেঁচে না থাকলেও ছড়িয়ে আছে সারা বাংলাদেশে। সকল ধর্মের মানুষ তাঁর জন্য প্রার্থনা করে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা রয়েছে প্রতিটি বাঙালির। তাঁকে নিয়ে অসংখ্য গান, কবিতা, কাব্য, প্রবন্ধ ও গল্প রচিত হয়েছে। জাতির জনকের কাছে বাংলাদেশের সকল মানুষ ঋণী। কারণ, তাঁর জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না। আজও বাঙালি জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতো। তাই বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন বাংলাদেশের খুশির দিন। মহান নেতার জন্মদিনে রইল তাঁর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও বিনম্র শ্রদ্ধা। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

লেখক: প্রাবন্ধিক, মরমী গবেষক ও গ্রন্থপ্রণেতা।



ফেইসবুকে আমরা