বাংলাদেশ, , মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪

পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে সহজলভ্য প্লাস্টিক সামগ্রীর নিষ্টুর ভালবাসায় : এ কে এম আবু ইউসুফ

  প্রকাশ : ২০১৯-০৭-২৩ ১২:৩২:২৭  

পরিস্হিতি২৪ডটকম :  দৈনন্দিন জীবনে এমন কোন পর্যায় নেই যেখানে প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার হয় না। প্লাস্টিকের ব্যবহার আমাদের জীবনকে যে সহজ করছে, সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। বহুমুখী ব্যবহার, স্বল্প খরচ ও ব্যবহারের সুবিধার কারছে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকজাত সামগ্রীর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। কিন্তু কখনো প্লাস্টিকের ক্ষতিকর দিকটি বিবেচনা করে আমরা তা ব্যবহার করছি না। নিজের ইচ্ছামাফিক প্রতিনিয়ত নানান কাজে ব্যবহার করছি প্লাস্টিক সামগ্রী। আর ঐসব প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহারের পর যথাযথ নিয়ম না মেনে ফেলছি যত্রতত্র। যার দরুণ আমাদের পরিবেশকে তির দিকে আমরা ঠেলে দিচ্ছি অজ্ঞাতসারে। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে অন্তত ১ কোটি মানুষ যদি প্রতিদিন প্লাস্টিকসামগ্রী বাইরে নিক্ষেপ করে, তাহলে আগামী ৫০ বছরে ১৮ হাজার কোটি প্যাকেট প্লাস্টিক বর্জ্য পতিত হবে। ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, আমার আপনার ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বোতল বা সামগ্রী যেখানেই ফেলছেন না কেন, প্লাস্টিকের এসব সামগ্রী শেষ পর্যন্ত নদী-নালা বা সমুদ্রে গিয়েই পড়ছে। সমীক্ষা অনুসারে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫ লাখ টনেরও বেশি প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহৃত হয়।

এর মধ্যে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত হয় মাত্র ৯ দশমিক ২ শতাংশ। এই বিপুল পরিমাণ অপচনশীল প্লাস্টিক হয় নদী-নালা দিয়ে আমাদের বঙ্গোপসাগরে পড়ছে অথবা মাটির নিচে চাপা পড়ছে বা পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। এসব ফেলে দেওয়া বর্জ্যরে কারণে হুমকির মুখে পড়ছে আমাদের পরিবেশ। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। আমরা যেসব প্লাস্টিক পুড়িয়ে ফেলছি, সেসবের কারণে বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য দায়ী। আর যেসব প্লাস্টিক আমরা মাটিতে ফেলে দিই, সেগুলো কিন্তু মাটির সঙ্গে মিশে যায় না। এসবের মধ্যে কোরিনযুক্ত প্লাস্টিক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে। এটি ভূগর্ভস্থ পানি ও ভূপৃষ্ঠের পানির সঙ্গে মিশে যায়। যেহেতু ভূগর্ভস্থ পানি আমরা প্রতিনিয়ত পান করছি, তাই আমাদের শরীর তিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার, মাটিতে থাকা বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া যেমন সুডোমনাস (Pseudomonas), নাইলন-ইটিং ব্যাকটেরিয়া বা ফ্যাভোব্যাকটেরিয়া(Flavobacteria)প্লাস্টিক অণুর ভাঙনে সাহায্য করে। এসব ব্যাকটেরিয়া নাইলোনেজ এনজাইম রণের মাধ্যমে নাইলন অণুকে ভেঙে ফেলে। তখন প্লাস্টিকের ভাঙনের মাধ্যমে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়, তা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী। কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুলনায় মিথেন গ্যাস বায়ুমণ্ডলে এক শতাব্দীকাল সময়ব্যাপী ৩০ গুণ বেশি তাপ ধরে রাখতে পারে। তার মানে, গ্রিনহাউস ইফেক্ট বা বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করার মতা কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়েও মিথেনের বেশি। প্রতিদিন ব্যবহারের পর আমরা যেসকল প্লাস্টিক সামগ্রী ও পলিথিন আবর্জনার সাথে ফেলছি তা নদী-নালা হয়ে তাদের শেষ গন্তব্য সমুদ্র। সম্প্রতি যেহারে প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার বেড়েছে এবং ব্যবহৃত এই প্লাস্টিক সামগ্রী বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে তাতে রীতিমত পরিবেশবিদগণেরাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। শুধু গৃহস্থলি কাজে ব্যবহৃত পলিথিন বা প্লাস্টিক নয় শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্যও নদী-নালাতে পতিত হচ্ছে প্রতিদিন। বছরে নদী-নালায় পড়ছে ২ লাখ টন প্লাস্টিক বা বর্জ্য আর বিভিন্ন পথে প্রতিবছর প্রায় ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক আবর্জনা সাগরে গিয়ে পড়ে। এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকের কারণে সামুদ্রিক পরিবেশ গুরুতরভাবে বিপন্ন হচ্ছে। এমনকি মহাসাগরে বিচরণকারী কোনো কোনো পাখি এবং বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীর পাকস্থলী পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এর ৮০ শতাংশ জায়গা প্লাস্টিক বর্জ্যে ভর্তি হয়ে আছে। প্লাস্টিক সাধারণত হজম হয় না, যার ফলে আস্তে আস্তে পাখি বা প্রাণীগুলো না খেতে পেরে করুণভাবে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। শুধু প্লাস্টিক বর্জ্যরে কারণে প্রতিবছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী ও কচ্ছপ মারা যাচ্ছে। খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে যাচ্ছে। ফলে জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হচ্ছে। প্লাস্টিকের বোতল, ব্যাগসহ বিভিন্ন সামগ্রীর ২০ থেকে ১ হাজার বছর সময় লাগে ভেঙে টুকরো হতে। সাধারণত প্লাস্টিকসামগ্রী ভেঙে টুকরো হয়ে প্রথমে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। পানি ও অন্য খাদ্যের সঙ্গে একসময় এই মাইক্রোপ্লাস্টিক বিভিন্ন জীবের দেহে প্রবেশ করে। এমনকি একসময় মাছের সঙ্গে মানুষের শরীরেও প্রবেশ করে চরম স্বাস্থ্যবিপর্যয় ঘটাতে পারে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে প্যাকেজিং-সামগ্রী থেকে শুরু করে ফার্মাসিউটিক্যাল, খেলনা, গাড়ির পার্টস, কসমেটিকস, ডিটারজেন্ট, পেইন্ট, ইলেকট্রিকসামগ্রীসহ বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করি। এসব প্লাস্টিকসহ অন্য সামগ্রীতেও যত্রতত্রভাবে থ্যালেট(Phthalate)নামে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়। এগুলো প্লাস্টিকসামগ্রী থেকে খাদ্যে বা পানিতে মিশে যায়। অনেক সময় এই থ্যালেট সিনথেটিক ইস্ট্রোজেন হিসেবে কাজ করে। ইস্ট্রোজেন মেয়েলি গঠন ও স্বভাবের জন্য দায়ী। সিনথেটিক ইস্ট্রোজেন পুরুষ মাছ বা প্রাণীকে স্ত্রী মাছ বা প্রাণীতে রূপান্তরিত করতে পারে। এর ফলে কোনো প্রজাতির পুরুষ ও স্ত্রী মাছের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে ওই প্রজাতির মাছ বা সামুদ্রিক প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটতে পারে। এ ছাড়া প্লাস্টিকসামগ্রীতে বিসফেনল-এ (Bis-phenol-A) নামক অত্যন্ত তিকর প্লাস্টিসাইজারও থাকে। এটি ক্যানসারের কারণ হতে পারে এবং প্রজননের মতাও নষ্ট করে দিতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকে জানা গেছে। সাধারণত অপরিশোধিত তেল থেকে প্লাস্টিক তৈরি হয়। ১৯৫০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অপরিশোধিত তেল দিয়ে ৮.৩ বিলিয়ন মেট্রিক টনের বেশি প্লাস্টিক তৈরি হয়েছে। ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, ৮.৩ বিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিকের মাত্র ৯ শতাংশ বর্জ্য বিভিন্ন ভাগাড়ে পতিত হচ্ছে। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ১২ বিলিয়ন টনে। এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্যরে দুর্যোগের ধাক্কা কাটিয়ে উঠা কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এইভাবে চলতে পারে না বা চলতে দেয়া যায় না। নিজ নিজ স্থান থেকে সচেতন হয়ে এর দূষণ রোধ করতে হবে। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে এই দূষণ কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব। প্রতিদিন যখন বাজারে ফলমূল কিংবা সবজি কিনতে যায়, তখন পলিথিন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এর পরিবর্তে পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাগজের বা পাটের ব্যাগ ব্যবহার করা যেতে পারে। রেস্তোরাঁ থেকে খাবার বাসায় নিয়ে আসার সময় প্লাস্টিকের প্যাকেট বর্জন করা উচিত। শুধু রেস্তোরাঁর খাবার নয়, যেকোনো পণ্যের প্যাকেজিংয়ে প্লাস্টিক ব্যবহার করা হলে সেটা ব্যবহার করা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। প্লাস্টিকের বোতলে পানি, কোমল পানীয় কিংবা জুস ব্যবহারের একটি বিকল্প উপায় খুঁজে বের করতে হবে। প্লাস্টিকের তৈরি ওয়ানটাইম গ্লাস, প্লেট, চামচের পরিবর্তে কাগজের তৈরি ওয়ানটাইম গ্লাস বা বারবার ব্যবহারের জন্য ব্যক্তিগত গ্লাস, প্লেট ব্যবহার করা গেলে প্লাস্টিক বর্জ্যরে সমুদ্র থেকে আমরা একটু হলেও রেহাই পাব। প্লাস্টিকের পণ্য রিসাইকেল কিংবা পুনঃপ্রক্রিয়াজাত, প্লাস্টিক-দূষণ রোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। আমরা যত বেশি রিসাইকেল করতে শিখব, দূষণের হার তত কমতে থাকবে। যেসব প্লাস্টিক দুই বা ততোধিকবার রিসাইকেল করা যায়, সেসব প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে দুঃখের ব্যাপার হলো, আমাদের দেশে রিসাইকেলের হার খুবই কম। অবশ্য এ ক্ষেত্রে বায়োপ্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি দূষণ হ্রাসের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। বায়োপ্লাস্টিক ব্যাগের সুবিধা হলো এই যে, তা সাধারণ প্লাস্টিক ব্যাগের মতো সরানো বা পোড়ানোর কোনো দরকার পড়ে না। কাজেই বায়োপ্লাস্টিকের রিসাইকিংয়ের জন্য আলাদা করে কোনো পদ্ধতির প্রয়োজন নেই। বায়োপ্লাস্টিকের ব্যাগ কিছুকাল পর নিজে থেকেই পচে যায়। কাজেই তা আলাদা করে অপসারণ করতে হয় না। দূষণ রোধে আজই আপনার, আমার, আমাদের সবার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। নিজেদের অভ্যাস পরিবর্তন করার পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনে সচেতন হতে হবে। না হলে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সামনে আমাদের রেখে যেতে হবে এক ভয়ংকর জঞ্জালের পৃথিবী। এটা আমরা কখনোই চাই না। সরাতে হবে জঞ্জাল। এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যেতে হবে আমাদের।

লেখক: প্রাবন্ধিক,কলামিষ্ট

চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি (বাপউস)।



ফেইসবুকে আমরা