বাংলাদেশ, , বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মেডিকেল বর্জ্য অপসারণে মানা হচ্ছে না বিধিনিয়ম : ডাঃ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন

  প্রকাশ : ২০১৯-০৮-২১ ২০:৫৫:১৪  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : পরিচ্ছন্ন নগরী ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ সবার কাম্য। পরিবেশ দূষণ এবং মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের অন্যতম প্রভাবক হলো বর্জ্য। পরিবেশ দূষণের কারণে স্বাস্থ্যহানিসহ নানাবিধ ক্ষতির পরিমাণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যত্রতত্র বর্জ্য ফেলা এবং এর থেকে সৃষ্ট সমস্যা থেকে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। কেননা জনসংখ্যার পাশাপাশি দেশে পরিবেশ দূষণের মাত্রাও ক্রমে বাড়ছে। জনসংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে বর্জ্য উৎপাদনও ক্রমবর্ধমান। এসব বর্জ্যরে মধ্যে মেডিকেল বর্জ্য অর্থাৎ হাসপাতাল থেকে যেসব বর্জ্য উৎপাদন হয়, সেসব বর্জ্য মারাত্মক ক্ষতি সাধিত করে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সারা দেশে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান বা হাসপাতাল প্রায় ২ হাজার ২৩৫টি এবং প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। এছাড়াও বেসরকারি নিবন্ধিত হাসপাতাল ও ক্লিনিক আছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার এবং বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা প্যাথলজিক্যাল সেন্টার আছে প্রায় ৬ হাজারেরও বেশি। এর বাইরেও সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনিবন্ধিত ছোট-বড় হাসপাতাল, ডায়গনষ্টিক সেন্টারের সংখ্যাও কম নয়।

ফাইল ছবি

সেসকল প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত তাঁদের বর্জ্য ফেলছে সাধারণ বর্জ্যরে সাথে। এমনকি এই ক্ষতিকর বর্জ্যরে বিষয়ে অনেকের ধারণাই নাই। নিজের অজান্তে কত মারাত্মক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে পরিবেশের। বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকারী বেসরকারি সংস্থার তথ্যমতে, ২০১৭ সালে সারা দেশে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎপন্ন বর্জ্যরে পরিমাণ ছিল সাড়ে ২১ হাজার টন। আর বর্তমানে এই বর্জের পরিমাণ বেড়ে প্রায় দেড়গুণ হয়েছে। মূলত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান থেকে ১১ ধরনের বর্জ্য উৎপাদিত হয়। যেমন: রক্ত, পুঁজ, দেহরস দ্বারা সংক্রমিত গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা, স্পঞ্জ, সোয়াব, মব, প্লাস্টার, ক্যাথিটার, ড্রেনেজ টিউব, রক্ত সঞ্চালনের ব্যাগ বা টিউব, রক্ত দ্বারা সংক্রমিত স্যালাইন সেট, জমাট বাঁধা রক্ত বা দেহরস, ডায়রিয়া রোগীর সংক্রমিত কাপড়চোপড়, সংক্রমিত সিরিঞ্জ ইত্যাদি। একই ধরনের ভয়াবহ অ্যানাটমিক্যাল বর্জ্য হলো মানবদেহের কেটে ফেলা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, টিস্যু, টিউমার, গর্ভফুল বা গর্ভসংক্রান্ত বর্জ্য। তেজস্ক্রিয় বর্জ্যরে ভেতর রয়েছে রেডিওঅ্যাকটিভ আইসোটোপ, তেজস্ক্রিয় বস্তু দ্বারা সংক্রমিত বর্জ্য, অব্যবহৃত এক্স-রে মেশিনের হেড ইত্যাদি। সাধারণ বর্জ্য মারাত্মক ক্ষতিকারক না হলেও মেডিকেল বর্জ্য হুমকিস্বরূপ। তাই মেডিকেল বর্জ্য ডাস্টবিন, নালা-নর্দমায় কিংবা খোলা জায়গায় না ফেলার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা আবশ্যক। কারণ মেডিকেল বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে মানুষের হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, এমনকি এইডসের মতো মরণব্যাধিও হতে পারে। পরিবেশ সংরণ বিধিমালা ১৯৯৭ অনুযায়ী, হাসপাতাল-ক্লিনিকসহ সব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে মেডিকেল বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের বিধান রয়েছে। কিন্তু সব প্রতিষ্ঠানে মেডিকেল বর্জ্য শোধনাগার থাকলেও সঠিকভাবে এসব মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না করেই পরিবেশে উন্মুক্ত ফেলা হচ্ছে। মানা হচ্ছে না আইন। চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য যে বিধিমালা প্রণীত হয়েছে উক্ত বিধিমালা চিকিৎসা বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াকরণ) বিধিমালা ২০০৮ নামে পরিচিত। এই বিধিমালাতে হাসপাতালগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে নির্দেশনা নাই। কিন্তু উক্ত বিধিমালার তফসিল ৩-এ চিকিৎসা বর্জ্যের ধরন অনুযায়ী শ্রেণিবিন্যাস করে কালার কোড এবং সংরণ পাত্রের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা আছে। একটি হাসপাতালে বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য থাকে। যেমনঃ- ১) সাধারণ বর্জ্য, ২) তিকারক বর্জ্য, ৩) ধারালো বর্জ্য, ৪) তরল বর্জ্য, ৫) তেজস্ক্রিয় বর্জ্য, ৬) পুনর্ব্যবহারযোগ্য বা পুনঃচক্রায়নযোগ্য (re-cycled) সাধারণ বর্জ্য ইত্যাদি। এসব বর্জ্য সংরণ ও পরিবহনের জন্য যথাক্রমে কালো, হলুদ, লাল, নীল, সিলভার ও সবুজ রংয়ের পাত্র ব্যবহারের নির্দেশনা আছে। অনুরূপভাবে বর্জ্যের ধরন অনুযায়ি পাত্র হিসেবে ছিদ্রবিহীন প্লাস্টিক বিন বা ছিদ্রবিহীন লিডবক্স ব্যবহারের নির্দেশনা আছে। আবার বিধিমালার তফসিল ১ এ বিভিন্ন বর্জ্যের শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী পরিশোধন ও বিনষ্টকরণ পদ্ধতি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা আছে। এসব বিধিমালা বাস্তবায়নে সচেতনতা ও অঙ্গীকার খুবই জরুরি। হাসপাতাল-ক্লিনিকসহ অন্যান্য চিকিৎসাকেন্দ্রের সব ধরনের বর্জ্য অপসারণের জন্য পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা থাকার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আইন থাকলেও প্রায় কেউই তা মানছে না। খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও এ বিষয়টি নিয়ে ততটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। এমনকি দেশে সরকারি-বেসরকারি কতগুলো চিকিৎসা কেন্দ্রে পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থা আছে সে তথ্যও নেই তাদের কাছে।এদিকে এ ব্যাপারে ছাড়পত্র দেয়ার মতা শুধুমাত্র পরিবেশ অধিদপ্তরের থাকলেও তাদের কাছে গোটা বিষয়টিই যেন গুরুত্বহীন। তারাও এ ব্যাপারে কোনো ধরনের খোঁজ-খবর রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না। ফলে চিকিৎসাকেন্দ্রের অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে গোটা দেশের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনাটি প্রত্য ও পরোক্ষভাবে জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যা থেকে সহজেই মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ও সংক্রামক রোগ-ব্যাধি ছাড়িয়ে পড়ে। এ কারণে পরিবেশ সংরণ আইন-২০১০ অনুযায়ী হাসপাতালের কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পরিবেশ ছাড়পত্র নেয়ার নিয়ম করা হয়। যেখানে রোগীদের ব্যবহৃত সুচ, বেস্নড, কাঁচির মতো ধারালো চিকিৎসা সরঞ্জামগুলো ধ্বংস করতে শ্রেডিং মেশিন ও সংক্রামক বর্জ্য নিয়ন্ত্রণে অটোক্লেভ মেশিন রাখার কথা উল্লেখ্য আছে। তবে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কতটি হাসপাতাল-ক্লিনিক রয়েছে এবং পরিবেশ ছাড়পত্র নিয়েছে কতটি স্বয়ং পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে তার সঠিক তালিকা নেই। যেসব প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্রের মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেন না কর্তৃপক্ষ। পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে এমন বিপর্যয় ঘটাচ্ছে চিকিৎসা সেবায় সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো। মূলত কিছু কিছু জায়গায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দৃশ্যমান কার্যক্রম চললেও বেশিরভাগ হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো নিয়ম এড়িয়ে চলছে। এরমধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উদাসীন বেসরকারীভাগে স্থাপিত হাসপাতাল ক্লিনিকগুলো। যা খুবই বিপদজনক পরিস্থিতি ও জনস্বাস্থ্যের জন্য অশনিসংকেত। উপরোক্ত বিষয়ে প্রতিটি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান তার নিজস্ব কাঠামোতেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে সাধারণ মানুষকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করবে। বেসরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান অবশ্যই তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বর্জ্য নিঃসরণ করবে এবং নতুন যেসকল প্রতিষ্ঠান সেবা দেওয়ার জন্য জনস্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র নিতে আসবে তাদেরকে অবশ্যই তার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিজ থেকে নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনগুলো এই বিষয়ে তদারকি বাড়িয়ে ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম বা পদক্ষেপ না নিলে মেডিকেল বর্জ্যরে ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পাবে না সাধারণ জনগণ। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এই মেডিকেল বর্জ্য অপসারণে যে বিধিনিয়ম রয়েছে তা যেন কার্যকর করা হয় এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: কলামিষ্ট ও কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি (বাপউস)।



ফেইসবুকে আমরা