বাংলাদেশ, , বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

একজন নিষ্ঠাবান গবেষক সোহেল ফখরুদ-দীন : ড. আশিস কুমার বৈদ্য

  প্রকাশ : ২০১৯-০৪-৩০ ১৯:৩৪:৫৩  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : আমার এই সামান্য জীবনের একটি বড় প্রাপ্তি এই যে, আমি (ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হয়তো) সোহেল মো. ফখরুদ-দীন মহোদয়ের মতো একজন খ্যাতনামা ইতিহাস বিশারদ, লেখক-গবেষক, সুবক্তা, হৃদয়বান, মানবতাবাদী প্রকৃত সজ্জনের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছি। অসাম্প্রদায়িক চেতনাশ্রয়ী বলে তাঁর পক্ষে সর্বস্তরের মানুষকে অতি স্বল্পসময়ের মধ্যেই বুকে টেনে নেওয়া মোটেই কঠিন হয়ে উঠে না। প্রথাসিদ্ধ লেখনি তাঁর অমূল্য অলঙ্কার। বুকভরা ভালোবাসা তাঁর অফুরন্ত পাথেয়। আঠাশ এপ্রিল তাঁর জন্মদিন। এদিনের পুণ্যলগ্নে তিনি মায়ের কোল আলো করে এসেছিলেন। জন্মণে সকল শিশুই কাঁদে। তিনিও কেঁদেছিলেন। পুষ্পকলি ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হয়ে সৌরভ দিল ছড়িয়ে, পিতৃদেব, মাতৃদেবীর পাশাপাশি জন্মভূমির গৌরব গেলো বেড়ে। ক্রমে সেই সৌরভ ও গৌরবের ছোঁয়া এসে লাগল এ পাড়েও, আমাদের প্রাণে-মনে। বহুগুণে গুণময় আমাদের এই প্রিয়জন। গুণগ্রাহী, বন্ধুবৎসল, সৃজনশীল ও সুমহৎ। এই সময় একজন যশস্বী কবির একটি অমর কবিতার একটি পঙক্তি মনে পড়লো, ‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ!’
সোহেল মো. ফখরুদ-দীন একজন সুসংগঠক রূপেও সুপরিচিত। সাংবাদিক সত্তার দিক থেকেও পিছিয়ে নেই তিনি। সবচেয়ে বড় পরিচয় এই যে, নিজের জন্মভূমির অতীতকে জানার, জানবার অদম্য অনুসন্ধিৎসায় তিনি একজন নিষ্ঠাবান গবেষক। আমাদের জন্য বহুমূল্যবান গ্রন্থ ও নিবন্ধ রচনা করেছেন তিনি। শিার্থীদের প্রতি দায়িত্ববোধে রচনা করেছেন বহু পাঠ্যগ্রন্থ। আমি তাঁর কয়েকটি প্রবন্ধ পাঠের সুযোগ পেয়েছি, এ গুলোর মধ্যে আছে, ‘প্রথম দুর্গাপূজা : মেধস মুনির আশ্রম’ (দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত), ‘সাহিত্যিক-সাংবাদিক মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী’ (ইনকিলাব সাহিত্যপাতায় প্রকাশিত), ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী’ (সাপ্তাহিক চট্টলা’য় প্রকাশিত), ‘বাংলা মায়ের প্রিয়ভাষাকে বিলীন করতে চেয়েছিল পাকিস্তানিরা’ (দৈনিক আজাদী পত্রিকায় প্রকাশিত), ‘মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ও প্রাচীন চট্টগ্রামের ইতিহাস’ (সাপ্তাহিক শ্লোগান পত্রিকায় প্রকাশিত), ‘আলাউদ্দিন খাঁ : সঙ্গীত সাধনা, জীবন ও কর্ম’ (দৈনিক আজাদী পত্রিকায় প্রকাশিত), নজরুল ইসলামকে নিয়ে লেখা ‘আমি আপনাকে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ’ (দৈনিক আজাদী পত্রিকায় প্রকাশিত), ‘বাঙালি জাতির গৌরব বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ’ (দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত), ‘মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ’ (দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত), ‘আর্য-আরব-ইরানীরা নয়, বাঙালিই গর্বিত ঠিকানা’ (ইনকিলাব পত্রিকায় প্রকাশিত), ১৯ মে ভারতের আসাম রাজ্যে ‘বাংলাভাষা শহিদ দিবস স্মরণে’ (সুপ্রভাত পত্রিকায় প্রকাশিত) প্রভৃতি। অধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ সানাউল্লাহর সাথে যৌথভাবে লিখেছেন, ‘বিজয়ের বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক অমূল্য গ্রন্থ। ভগৎসিং, সূর্যসেন, পূর্ণচন্দ্র দেব তত্ত্বনিধি প্রমুখ প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্বের জীবনালেখ্য নিয়েও তাঁর গবেষণাধর্মী রচনা আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। ইতিবৃত্ত, মানবতাবাদ, সুফি দর্শনাদিনামা বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা প্রশ্নাতীত। মাতৃভাষার প্রতি, মাতৃ-সংস্কৃতির প্রতি সোহেল মো. ফখরুদ-দীনের প্রগাঢ় শ্রদ্ধা আমাকে আকৃষ্ট করেছে। ‘সোনামণিদের সাধারণ জ্ঞান’ তাঁর এবং অধ্য মোহাম্মদ হাসান মহোদয়ের অসাধারণ গ্রন্থ। ‘কিরাত বাংলা’ তাঁর মানসকন্যা। কন্যাসম সমাদরে প্রকাশিত এই মুখপত্রেও আমরা তাঁর সম্পাদনগুণের পরিচয় পাই। বহু সংবর্ধনা ও পুরস্কারে ভূষিত এই ইতিহাসবিদ ও সুলেখকের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় বাংলাদেশের কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল ইতিহাস মঞ্চ আয়োজিত ‘ইতিহাস ও সাহিত্য সম্মেলন ২০১৮’। দ্বিতীয়বার তাঁর সান্নিধ্যে আমি চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র আয়োজিত (১১ জানুয়ারি, ২০১৯) চৌধুরী পূর্ণচন্দ্র দেব তত্ত্বনিধি স্মরণে আন্তর্জাতিক স্তরের আলোচনা চক্রে। তৃতীয়বার তাঁরই আমন্ত্রণে গেলাম ঢাকায়। একুশে ফেব্র“য়ারিকে সামনে রেখে ২০ ফেব্র“য়ারি ঢাকায় তিনি একটি সুসংগঠিত, সুসংহত অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। আর একবার একটি অগ্রণী সংগঠনের আমন্ত্রণে এসেছিলেন আগরতলায়। এখানেও তাঁর মূল্যবান কথা শোনার সুযোগ হয়েছে আমার। তাঁর সারল্যমণ্ডিত জীবনযাত্রা ও আপোষহীন সংগ্রামী চেতনার সঙ্গে মাধুর্যমণ্ডিত ব্যক্তিত্বে আমি আকৃষ্ট হয়েছি। ইতিহাসের গবেষক রূপেও তাঁর অসামান্য অবদান আছে। বিশেষ করে জন্মস্থান চট্টগ্রামের সুপ্রাচীন ইতিহাসকে সর্বসমে তুলে ধরার ধারাবাহিক প্রকাশ ভাবনাও প্রশংসনীয়। তাঁর ইতিহাস চর্চায় সহানুভূতি পরায়ণতার দিকটিও উল্লেখনীয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক রইস ডেভিডের একটি তাৎপর্যমণ্ডিত উক্ত হলো : “It is true that in my humble opinion, no historian can be an adequate historian without sympathy.” কার প্রতি এই সহানুভূতি? স্বদেশ ও বিশ্ববাসীর প্রতি। ইতিহাসবিদ প্রামাণ্য উপাদানের পাশাপাশি দেশ-কাল-মানুষের যাবতীয় সৃজনধারা, ঐতিহ্য, আবেগ, লোকশ্র“তির প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন, সংবেদনশীল হবেন। ইতিহাস নিরস বিষয় নয়, তাই এর সঙ্গে সাহিত্যানুভূতিও সংশ্লিষ্ট থাকলে সুখপাঠ্য হয়। এ বিষয়ে সোহেল ভাই একশো ভাগ সচেতন বলেই মনে হয়। স্থাপত্য-ভাস্কর্য-প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক তাঁর রচনাদি পড়ে আমার এ ধারণা বন্ধমূল হয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য, আমি তাঁর প্রভূত রচনাশৈলীর অতি সামান্য অংশের সাথে পরিচিত হতে পেরেছি। সুতরাং আমি নই, পাঠকসমাজই শেষ কথা বলবেন। আমি শুধু আমার অনুভবের কথাই লিখেছি। আজ তাঁর ৫০তম শুভ জন্মদিকে অগ্রজপ্রতীমরূপে প্রাণভরে আশীর্বাদ করি। একজন গুণগ্রাহী হিসেবে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানাই। সুস্থ, সুখী, সৃজনশীল, আনন্দময় দীর্ঘজীবনের অধিকারী হোন সোহেল মো. ফখরুদ-দীন।

লেখক: ড. আশিস কুমার বৈদ্য, ইতিহাসবিদ, গ্রন্থপ্রণেতা, সংগঠক ও কবি; আগরতলা, ত্রিপুরা, ভারত।



ফেইসবুকে আমরা