বাংলাদেশ, , শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

আশা পূরণের জিগাগাছ এখনো অন্ধবিশ্বাস!

  প্রকাশ : ২০১৯-১০-২৮ ২০:০৫:৩৬  

পরিস্হিতি২৪ডটকম/(মির-হোসেন সরকার): কার্তিক মাসের শীতলতা আবহাওয়ার দিন আর দুপুর একটু খানি গরম। সকালের দিকটায় হালকা ধরনের বৃষ্টির কারণে রাস্তাঘাটে প্যাচপ্যাচে কাঁদা। এমন দিনে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার বাসট্যান্ড থেকে অটো ভ্যানে করে রওনা হলাম মেরিরহাটের বাহিরডাঙ্গা গ্রামের উদ্দেশে। গ্রামের সরু মেঠোপথ রাস্তায় ঢুকতেই চোখটা গেল চারপাশে। চারপাশে তাকিয়ে অনুভব করালাম; সবুজ আর শীতল বাতাসে, নিমিষেই দূর হয়ে গেল আমার সবক্লান্তি-বিরক্তি। আঁকাবাঁকা পথের দু’পাশে ধানের ক্ষেত, পুকুর কিংবা বিল। মাঝে মাঝেই কলাগাছের বাগান। চোখে পড়বে শতবর্ষী কিছু গাছও। অটো ভ্যান ছুটছে সন্ন্যাসতলার দিকে। প্রায় আধাঘণ্টা চলার পর থামল গন্তব্যপথ। গ্রামের একজন মাঝবয়সী কৃষকের দেখানো পথে অবশেষে দেখা মিলল সন্ন্যাসতলার। সেখানে ছোট-খাটো দেখতে একটি ঝাঁকড়াজিকা গাছ, লোকমুখে অবশ্য জিগা বা ঝিগা গাছ নামেই পরিচিত। সেই গাছকে ঘিরেই মানুষের ভিড়। মেঠোপথ ঘেঁষা গাছটি তার ডালপালা মেলে ধরেছে খেয়ালিভাবে। ডালপালার কিছু অংশ পথের ওপর বাঁকাহয়ে পড়লেও সেটি কেটে ফেলা তো দূরের কথা, কেউ ছুঁয়ে দেখতেও সাহস পান না। আর ডালেডালে ঝুলছে দুধে পূর্ণ বাঁশের চোঙ্গা, বোতল কিংবা পলিথিন। জনশ্রুতি আছে, এই জিকা গাছটি মানুষের আশা পূরণ করতে পারে। অনেকের কাছেই এটি বিস্ময়বৃক্ষ। তাই দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে এসে দুধের বোতল কিংবাবাঁশের চোঙ্গা ঝুলিয়ে দিয়ে যান গাছের ডালে। এরপর মনের অপূর্ণ বাসনা বা ইচ্ছাজানিয়ে জিকা গাছটির তলায় এসে প্রার্থনা করেন। ইচ্ছাপূরণ হলে জোড়া পাঠা বলি বা মিষ্টি বিলানোর মতো বিভিন্ন ধরনের প্রতিজ্ঞা বামানতও করেন তারা। ‘আশাপূরণে’র সেই গাছটি ঘিরেই তাই জমজমাট সন্ন্যাসতলা।


গাছতলায় বেশ কয়েকজন স্থানীয় মধ্যবয়সী পুরুষের ভিড়। কয়েকজন দর্শনার্থীরও দেখা মিলল। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় পাশের গ্রাম দেবীপুরের কৃষকওমর আলীর সঙ্গে। ওমর বলেন, ‘এই গাচের কাচেকিচু চালেই পাওয়া যায়। মোর ছয় বছরের ছোল মোকছেদ আও করে না। পরে এই গাছের গোড়াত বসে এটি অ্যাসা মানত করি, একটা মুরগী দিয়ে পোলা খিলামু। একমাস পরই ছোল মোর আও করলো। স্থানীয়রা জানালেন, এই গাছটিকে ঘিরে বাহিরডাঙ্গার এই সন্ন্যাসতলায়দূর-দূরান্ত থেকে নানা ধর্মের বিভিন্ন বয়সী মানুষের ভিড় জমে প্রায় প্রতিদিন।
গাছতলায় কথা হয় হোসেনপুর ইউনিয়নের শাকিল সাহার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার কোনো সন্তান নেই। তাই প্রতিদিন এই গাছে দুধ দিয়ে যাই। একদিন আশাপূরণ হবেই— এই বিশ্বাস আছে। বাহিরডাঙ্গা গ্রামের ইব্রাহিম (৪০) বলেন, গত মাসে ছোট ভাইয়ের বিডিআরের চাকরিটা যেন হয়, তাই এখানে এসে জোড়াপাঠা মানত করি। তিন দিন পরই ভাইয়ের চাকরি হয়। এই শুক্রবার জোড়া পাঠা কোরবানি করে এখানে এনে বিলিয়ে দেবো। স্থানীয় প্রবীণ রহমত মিয়া (৭৮) বলেন, ‘মোর বাপ-দাদা, তার বাপ-দাদারাও এই গাছটারে সম্মান করত শুনছি। এলাকার গনি মণ্ডলদের বাপ-দাদার জাগা শুনছি। ম্যালা বছর ধরে এই গাছটা ইংক্যাই দেকচি।’
জানা গেল, বাহিরডাঙ্গা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবার গণি মণ্ডলের। কথা হয় সেই গণি মণ্ডলের সঙ্গেও। তিনি বলেন, বাংলা একাডেমির লোকজসংস্কৃতির মাঠ গবেষণায় জায়গা পেয়েছে এই জিকা গাছটি। পূর্বপুরুষের কাছে জেনেছি, গাছটিতে এক সন্ন্যাসী ঠাকুর বাস করতেন। এর পাশেই ছিল বাহিরডাঙ্গার বিশাল বিল। বিলের ধার ঘেঁষে বেড়ে ওঠে জিকা গাছটি। ছোটবেলা থেকেই দেখছি, মানুষ এ গাছে মানতকরে। মানুষ যে উদ্দেশ্যে মানত করে, তা পূরণ হয় বলেও জানি। আমার বাবার বাবা-দাদা কিংবা তার আগের প্রজন্মের মানুষরাও মানত করেছেন। বিস্ময়কর হলো, গাছটির যে বর্ণনাতারা দিতেন, দশকের পর দশক পেরিয়ে গেলেও গাছটি তেমনই আছে।
আশাপূরণের জিকা গাছটিকে ঘিরে প্রচলিত এই বিশ্বাসে অবশ্য বিশ্বাস নেই স্থানীয় তরুণ আহসান হাবীব সরকারের (২৫)। তিনি বলেন, আমি বিজ্ঞান নিয়ে পড়ালেখা করেছি। এসবে আমার বিশ্বাস নেই। একটি গাছ মানুষের ইচ্ছা পূরণ করতে পারে? এটা অস্বাভাবিক। এলাকার মানুষের অন্ধ বিশ্বাস আছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই বিশ্বাস লালন করে আসছে। সেই জায়গা থেকে আমার তাদের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে এই মিথ্যা বিশ্বাস করি না। আহসান আরও বলেন, অনেকেই এখন এই জিকা গাছটি দেখতে আসেন শখের বশে। ছুটির দিনে রীতিমতো ভিড় জমে যায়। যারা মনে করে, এই গাছের কাছে মানত করে তাদের আশাপূরণ হয়েছে, তারা মানত পূরণ করতে এটা-ওটা দিয়ে যায়। আমরা গ্রামবাসীরা সেগুলো মজাকরে খেতে পারি। এই সেদিনও একজন দুই মণ মিষ্টি এনে বিলিয়েছেন। আমরা পুরো গ্রামের মানুষ খেয়ে শেষ করতে পারিনি। শাখা-প্রশাখা ছড়ানো ঝাঁকড়া ছোট-খাটো গাছটির একপাশে লাল টকটকে জবাগাছ, অন্যপাশে একটি খেজুর গাছ। বিকেলের মায়াবী আলোয় কেমন অদ্ভূত দেখতে এই গাছটি কতবছর আগে কে লাগিয়েছে, নাকি আপনা-আপনি জন্মেছে, সে তথ্য জানা নেই এই গ্রামের মানুষের। এ নিয়ে তাদের মাথা ব্যাথা বা জানার আগ্রহও তেমন নেই। গাছটি তাদের কাছে সম্মান আর পবিত্রতার প্রতীক। এলাকায় এমন একটি বিস্ময়বৃক্ষ থাকায় তারা গর্ববোধও করেন।



ফেইসবুকে আমরা