পরিস্হিতি২৪ডটকম : (পূর্বে প্রকাশের পর)..আমি ভারত সফরের রোজনামচায় মরুর রাজ্য রাজস্থানের জয়পুর ঘুরা ঘুরির গল্প বলার সময় বলেছিলাম জলমহল ও গোলাপী শহর বা পিন্ক সিটি বা জয়পুরের গোলাপী শহর হয়ে উঠার গল্প শুনাবো বলেছিলাম। তার ধারাবাহিকতায় আজ স্বল্প পরিসরে বলেই আগ্রার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। যাত্রায় তাড়া আছে তাই সিখায় ভুল আছে অনেক। নিজ গুনে ক্ষমা করে দিবেন, কারণ আমার কোন গুণ নাই
জলমহল (Water palace) :
মহল বা প্রসাদ বললেই চোখে ভেসে ওঠে বিশাল কোনো নান্দনিক কারপকার্য ক্ষচিত স্থাপনা যেখানে মানুষ বাস করে। তবে জলমহল আসলে এমন কিছু নয়। জলমহল পানির মাঝখানে নির্মিত বিশাল প্রাসাদ। চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা। প্রাসাদে যেতে হয় নৌযানে। এটি ‘জলের প্রাসাদ’ নামে পরিচিত হলেও আসল নাম ‘জলমহল’। সুযোগ পেলে একবার দেখে আসুন প্রাসাদটি।
অবস্থান :
জলমহল দেখতে চাইলে যেতে হবে ভারতের রাজস্থানের রাজধানী জয়পুরের পিংক সিটিতে। ইতিহাস :
জলমহল “মান সাগর” নামক কৃত্তিম লেকের মাঝখানে স্থাপিত। ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে মহারাজা মাধে সিং এই মহল নির্মান করেন।
এলাকার মানুষের পানি সংকট দূর করতে লেকটি তৈরি করেছিলেন রাজা মান সিং। ১৬১০ সালে হঠাৎ ভয়ানক খরা আর দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে দ্রুত বারবতী নদীতে বাঁধ দিয়ে প্রজাদের জন্য পানির ব্যবস্থা করেন মান সিং। তৈরি করা হয় বিশাল এক লেক। যার নাম দেন “মান সাগর”।
নির্মাতা:
আগেই বলেছি ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে মহারাজ মাধো সিং জলমহল নির্মাণ করেছিলেন । এই প্রাসাদের মালিকানা পরে পান মাধো সিংয়ের ছেলে দ্বিতীয় মাধো সিং। বাবার প্রাসাদকে অবশ্য খুব একটা বাড়াননি তিনি। প্রাসাদের সঙ্গে শুধু একটা বিচারালয় যোগ করেছিলেন এবংবাহিরের কারুকাজে কিছুটা পরিবর্তন এনেছিলেন।
নির্মাণের কারণ:
জলমহলটি বসবাসের জন্য মহারাজা মাধো সিং তৈরী করে ছিলেন না। তিনি একজন শৈখিন হাঁস শিকারী ছিলেন। জল মহলটি তিনি তৈরী করেছিলেন তার হাঁস শিকারে সুবিধার্থে মূলত। মাঝেমধ্যে নৌকায় করে হাঁস শিকারে আসতেন তিনি।এই প্রসাদে রাজকীয় পরিবারের সদস্যদের থাকার মত কোন কামরা নেই, তবে বিশাল একটি চত্বর রয়েছে প্রাসাদে। আছে বাঁকানো সিঁড়িসহ বাগান।
তবে গ্রিষ্মের গরম থেকে কিছুটা সময় আরাম পেতে রাজ পরিবারের সদস্যরা এই জলমহলে এসে ঠান্ড হাওয়ার পরশ নিতে বলেও জানা যায়। আর এই উদ্দেশ্যে এ প্রসাদ নির্মান করা হয়েছে বলে জনশ্রুতি আছে।
কারুকার্য:
জলমহলের চারদিকে পানি থাকায় প্রসাদটিকে একতলা মনে হবে, বাস্তবে জলমহল পাঁচতলা। নিচের চারটি তলাই বছরের বেশির ভাগ সময় পানির নিচে ডুবে থাকে। রাজপুত আর মোগল- এই দুই ঘরানার শিল্পেরই দুর্লভ ছোঁয়ার দেখতে পাওয়া যায় এই প্রসাদে। এছাড়া জলমহলের ছাদে রয়েছে বিশাল এক চারকোনা ছাতা। সুন্দর কারুকার্যখচিত ছাতার পাশে বসে কেবল দিনেরই নয়, রাতের ঝলমলে জলমহলকেও উপভোগ করা যায়।
সৌন্দর্যহানী:
জলমহলের সৌন্দর্য ও আকর্ষণীয়তা স্থানীয় শাসকদের কাছে একসময় গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে, ফলে অনাদর-অবহেলায় নষ্ট হতে থাকে এর সৌন্দর্য। পরবর্তীতে আশপাশে গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানার বিষাক্ত রাসায়নিক আর গৃহস্থালির আবর্জনা এসে জড়ো হতে থাকে মাম সাগরের পানিতে। বিকট গন্ধের কারণে একসময় পর্যটক আসা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দৃষ্টির আড়ালে চলে যায় জলমহল। পরের ২০০ বছরের বেশি সময় অবহেলিতই থাকে জলমহল আর মান সাগর।
সংস্কার: ২০০৪ সালে একটি বেসরকারি সংস্থা দায়িত্ব নেয় জলমহল আর মান সাগরের। তাদের চেষ্টায় খুব দ্রুত আগের রূপ ফিরে পায় মান সিং এর মান সাগর। সেই সঙ্গে মান সাগরও হয়ে ওঠে পরিষ্কার। জলমহলের কাছে গেলে এখন প্রাসাদই নয়, দেখতে পাবেন পরিষ্কার পানিতে মহলের মোহনীয় ছায়া!
নিষেধাজ্ঞা: নিরাপত্তা ও সংরক্ষনের কথা চিনিকা করে জলমহলকে সাধারণ পর্যটকের জন্য এখনআর উন্মুক্ত করা নয়। তাই দূর থেকেই এর রূপ উপভোগ করা ছাড়া আমাদের মত আম পর্যটকের কি বা করার আছে।
গোলাপী শহর –মোগলদের পতনের পর রাজপুত রাজারা পাহাড় ছেড়ে সমতলে আসেন। আরাবল্লী পর্বত ছেড়ে তাঁদের রাজধাণী সমতলে স্থানান্তরিত করেন।
১৭২৭ সালের ১৮ই নভেম্বর ভারতের সবচাইতে পরিকল্পিত শহর জয়পুরের গোড়াপত্তন করেন রাজা সোয়াই জয় সিং-২ । এই শহরকে পরিকল্পিতও নান্দনিক করে সাজানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বাঙ্গালী স্থপতি বিদ্যাধর ভট্টাচার্যকে। পুরানো ঐতিহ্যের সাথে আধুনিকতার মিশেলে তিনি এক অনন্য রাজধানী শহর তৈরী করেছিলেন। সম্প্রতি এই শহরকে UNESCO “ওয়ার্ল্ড হেরিটেইজ সিটি “ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
১৮৭৬ সালে প্রিন্স অব ওয়েল্স আলবার্ট ও মহারাণী ভিক্টোরিয়ার জয়পুরে আগমন উপলক্ষ্যে গোটা শহরকে আতিথিয়তার রঙ গোলাপী রঙে সাজিয়েছিলেন রাজা রাম সিং। সেই থেকে জয়পুর গোলাপী শহর বা পিন্ক সিটি হিসেবে খ্যাত। লর্ড আলবার্ট প্রথম বার “এই পিন্ক সিটি” শব্দটি ব্যবহার করেন। আজো এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখা হয়েছে। জয়পুর শহরের নাগরিকরা আইনত তাদের সকল প্রকারের স্থাপনা গোলাপী রং করতে বাধ্য।আজো পুরান জয়পুরের সকল বাড়ী ঘর, দালান বা স্থাপনা গোলাপী রঙ এর।
নাহারগড় ও জয়গড় দেখে আমরা সোজা চলে এলাম জলমল দেখতে। মানসাগর লেকের পাশে পর্যটক বা দর্শনার্থীদের জন্য লেকের পাড় পাকা করে দিয়েছেন এবং বসার জন্য সুন্দর পাকা বেন্চেরো ব্যবস্থা করে দিয়েছেন জয়পুর পৌর কর্পেরেশন । সেখানে বসেছে নানা রকমের দেকান।
দোকান গুলোতে স্থানীয়রা হরেক রকমের জিনিস নিয়ে পশরা সাজিয়ে বসেছে। পর্যটকরা তাদের পছন্দের গিফট আইটেম কিনছেন।
আমরা কিছুক্ষণ মান সাগরের বুকে রাজপুতানদের বিলাসী জীবণের নিদর্শন জলমহলের সৌন্দর্য উপভোগ করে রাহমানের রেস্তোরায় এসে পেট পূজা সারলাম। তারপর বিকাল ৪ টায় রওয়ানা হলাম মোগলদের আরেক রাজধানী আগ্রার পানে।
জয়পুর থেকে আগ্রার দূরত্ব ২০৪ কি মি।আমাদের গাড়ী ছুটছে। রাস্তার দুপাশ জুড়ে সরষের ক্ষেত। সবুজের সমারোহ আর সরষে হলুদ ফুলের আমাদের সৌন্দর্য নিমিশেই আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল আমার সোনা ফলা দেশ। বাংলাদেশে।সূর্য অস্তমিত হলো। রাস্তার পাশে আগুন জ্বালিয়ে মানুষ উষ্মতা নিচ্ছে। খুব ঠান্ডা পড়ছে । আমাদের গাড়ীতে হিটার থাকায় আমরা তেমনটা অনুভব করতে না পারলেও বাইরের দৃশ্য আমাদেরকে জানান দিচ্ছে শীতের তিব্রতা কত।আমরা রাত ৮ টা ৩০সে এসে আগ্রায় পৌঁছায়।
শীতের তিব্রতার কারণে আমরা আর রাতের আগ্রা শহর ঘুরে দেখার সাহস করলাম না। তবে আমাদের ড্রাইভার হোটেলে যাওয়ার আগে আমাদেরকে আগ্রা শহরের যতটুকুন ঘুরিয়েছেন তাও গাড়ীতে বসেই দেখতে হয়েছে। কি করা দুধের স্বাধ ঘোলে মিঠানো আর কি!
চলবে…
লেখক : শওনীল হোসাইন।