বাংলাদেশ, , সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪

জগৎ বিখ্যাত আলেমে দ্বীন আল্লামা মুহাম্মদ আজিজুল হক আল কাদেরী ( রহঃ) স্মরনে : সোহেল মো.ফখরুদ-দীন

  প্রকাশ : ২০১৯-০৪-০১ ২০:২১:৫৬  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : জগৎ বিখ্যাত আলেম এদ্বীন, ইসলামীশিক্ষা জগতে চট্টগ্রাম এর গৌরব, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্টানের প্রতিষ্টাতা, পীরে তরিকত হয়রত আলহাজ মুহাম্মদ আজিজুল হক আল কাদেরী গত ৩১ মার্চ ২০১৯ রবিবার সকালে চট্টগ্রাম নগরীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মহান আল্লাহের ডাকে সাড়া দিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। ১এপ্রিল সোমবার বাদে আসর তাঁরই প্রতিষ্টিত ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্টান হাটহাজারী ছিপাতলী আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে হাজার হাজার মুসল্লীদের উপস্থিতিতে জানাজা শেষে তাঁকে দাপন করা হয়। তাঁহার ইন্তেকালের সংবাদে চট্টগ্রামে শোকের ছাঁয়া নেমে আসে। হুজুরের হাজার হাজার ছাত্র আজ শিক্ষায় প্রতিষ্টিত।দেশে বিদেশে সম্মানের সহিদ কাজ করছেন। হুজুরের ইন্তেকালের সংবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক আলেম ওলামায়ে কেরাম,পীর বুজুর্গ, শিক্ষাবিদ,রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবি এসে হুজুরকে শেষবারের মতো দেখে জানাজা ও দোয়া মাহফিলে শরীক হন। ব্যক্তিগত জীবনে মহান এই শিক্ষা সাধক পুরুষের সাথে আমার একাধিক বার দেখা ও সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে। এরকম একজন আলেম এর ইন্তেকালে দেশ একজন শিক্ষার আলোকিত মনীষীকে হারাল।জীবন কর্মের ইতিহাসে আল্লামা আজিজুল হক আল কাদেরী পুরোটা জীবন শিক্ষাবিস্তারে অতিবাহিত করেছেন। প্রতিষ্টা করেছেন একাধিক দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্টান। ইসলাম ধর্মের মর্ম বানী ও নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পবিত্র ধর্ম ইসলামের আলোর পথে মানুষকে আহবান করে সঠিক পথের শিক্ষা দিয়েছেন তিনি। মানবতাবাদী ও মানুষের কল্যান করেছেন যুগের পর যুগ। অনাত এতিম অসহায় ছাত্রের শিক্ষাদানে তাঁর ভুমিকা অপরিসিম। মহান আল্লাহ ও রাসুল ( সাঃ) এর দেখানো পথেই তিনি চলেছেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্যদিয়ে জাতি ও দেশবাসী একজন দ্বীনদার আলেম পীর সাহেবকে হারালেন।আল্লামা মুহাম্মদ আজিজুল হক আল্ কাদেরী (রা:) চট্রগ্রাম জেলার অন্তরগত হাটহাজারী উপজেলাস্থ ছিপাতলী গ্রামে এক সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারে ২৭শে মে ১৯৪০ ইংরেজীতে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মৌলভী মোহাম্মদ ইলিয়াছ, মাতা কাজী মুস্তফা খাতুন, তা ছাড়া তাঁর চাচা মুহাদ্দিস আল্লামা মুহাম্মদ ইদ্রিস (রহ), একজন উচ্চস্তরের আলেম ও বুযূর্গ ছিলেন। তাঁর দাদার নাম শাহ্সূফী লাল মিয়া (রহ) তিনি তৎকালীন যুগশেষ্ঠ ও বুজুর্গ ছিলেন,আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের খতিব, হুযুর গাউছে পাক (রা.) খাস বংশদর পীরে তরিকত্ব হযরতুলহাজ্ব আল্লামা সৈয়দ বাগদাদী (রহ.) এর তা’লিমি এজাযতপাপ্ত মুরিদ ছিলেন।হুজুরের তিন বৎসর বয়সে বাবা ইন্তেকাল করেন, পরবর্তীতে তাঁর দাদা শাহ সূফী লাল মিয়া (রহ), তাঁর লালন পালনের দায়িত্ব নেন। ১৩ বৎসর বয়সে তাঁর দাদাও ইন্তেকাল করেন,পরিবর্তীতে তিনি নিজে নিজে লেখা পড়া চালিয়ে যান।
উল্লেখ্য যে,তাঁর পৃর্বপুরুশ মুহাম্মদ রাজার বংশের মাওলানা আছাদ আলী (রহ). ছিলেন তৎকালীন বড় আলেম ও বুযূর্গ। আর তাঁর নানা ছিলেন হযরত কাজী রফিক উদ্দীন মারুফ শাহ্, প্রকাশ মারুফ ফকির (রহ) এর বংশদর। তাঁর নানার বংশের সকলেই বংশানুক্রমিক এক একজন উচ্চস্তরের আলেম ও বুযূর্গ ছিলেন।আল্লামা মুহাম্মদ আজিজুল হক আল কাদেরী বাল্যকালে তিনি পিতৃহীন হন এবং পিতামহের হাতে লালিত-পালিত হন। অনেক দুঃখ, কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে তিনি প্রথমে গাজীয়ে দ্বীনে মিল্লাত, ইমামে আহলে সুন্নাত, আশেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহহি ওয়াসাল্লাম ,হযরতুলহাজ্ব আল্লামা মুহাম্মদ আজিজুল হক শেরে বাংলা (রহ). এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত মেখল ফকিরহাট ইমদাদুল উলুম মাদ্রাসার প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন।পরিবর্তীতে বেঙ্গুরা মাদ্রাসায় কিছু দিন লেখা পড়া করার পর চট্রগ্রাম ওয়াজেদিয়া অালিয়া মাদ্রাসা থেকে ১৯৬৭ সালে কামিল হাদিস ডিগ্রি লাভ করে,এবং ঢাকা সরকারী আলীয়া মাদ্রাসা থেকে ১৯৬৮ সালে কামিল ফিকহ্ বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করে।
পূর্বপাকিস্তানের শিক্ষা জীবন শেষ করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের ভাওয়ালপুর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাদীস ও তাফসীর বিষয়ে গবেষণামূলক উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। অতপর বিভিন্ন শাস্ত্রের বিজ্ঞ পন্ডিতগণের সুষ্ঠ শিক্ষাদানের মাধ্যামেই শিক্ষার্থীগণ যোগ্য কর্মনিষ্ঠ রুপে গড়ে উঠে। এই ক্ষেত্রেও আল্লামা কাদেরী অত্যন্ত ভাগ্যবান। সুযোগ্য শিক্ষকমন্ডলীর সহচর্যে তাঁর বিদ্যাচর্চা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। যে সকল যুগ শেষ্ঠ মনীষীদের নিকট থেকে তিনি শিক্ষা লাভ করেন নিম্নে তাঁদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হলো। আল্লামা কাজেমী (রহ.) এর সংস্পর্শে ধন্যঃ আল্লামা কাদেরী অগাধ জ্ঞান ভান্ডারের অধিকারী হওয়ার পিছনে যার অবিস্মরণীয় অবদান তিনি হলেন, শায়খুল মুহাদ্দিসীন ওয়াল মুফাস্সিরীন, মুহাদ্দিসে আযম,গায্ যালিয়ে যমান,রাযীযে ওয়াকত্,সুলতানুল আরেফীন শাহ্সূফী সৈয়দ আহমদ সাঈদ আল্ কাজেমী (রহ.)। আল্লামা কাজেমী (রহ.) এর নিকট হতে তিনি হাদীস,ফিকহ্, তাফসীর, গভীর জ্ঞান অর্জনের এর পাশাপাশি তরিকতের দীক্ষা গ্রহণ করতঃখেলাফত লাভে ধন্য হন।হাদীস শাস্ত্রে তিনি ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইলমে হাদীস ইসলামের দ্বিতীয় উৎস হিসেবে এক বিশেষ বৈশিষ্টের অধিকারী। আল্লামা কাদেরী (রা:). যে সকল ইসলামী স্কলার ও বিজ্ঞ ওলামায়ে কিরামের নিকট হাদীস শাস্ত্র শিক্ষা লাভ করেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন-:১চট্রগ্রাম ওয়াজেদিয়া আলিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল হযরতুলহাজ্ব আল্লামা আতিকুল্লাহ খান (রহ). ২. হযরতুলহাজ্ব আল্লাম মুহাদ্দিস আজিজুর রহমান (রহ). ৩.হযরতুলহাজ্ব অাল্লামা মুফতি রশিদ আহম্মদ! (রহ). ৪. হযরতুলহাজ্ব আল্লামা আবদুল মুস্তফা আল্ আযহারী (রহ).করাচি পাকিস্তান প্রমুখ।কর্মজীবনে আল্লামা আজিজুল হক আল কাদেরী (রা:). ভাওয়ালপুর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় হতে আল্লামা সৈয়দ আহমদ সাঈদ কাজেমী (রহ). এর তত্ত্ববধানে থেকে হাদীস,তাফসীর, ফিকহ্, উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করার পর প্রথমে লাহোর সিরাজুল উলুম মাদ্রাসায় মুহাদ্দীসের দায়িত্ব পালন করেন।কিছু দিন অধ্যয়নের পর পরবর্তীতে দেশে প্রত্যাবর্তন করে তাঁর সুদৃর প্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে দ্বীন ইসলামের ক্ষেত্রে হাটহাজারী নাঙ্গলমোড়া শামসুল উলুম মাদ্রাসা, হাটহাজারী অদুদিয়া মাদ্রাসা, গহিরা আলিয়া মাদ্রাসা, ও নাজিরহাট আহমদিয়া মিল্লিয়া মাদ্রাসা সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুহাদ্দিস ও অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি ছিপাতলী জামেয়া গাউছিয়া মূঈনীয়া মাদ্রাসা, হাটহাজারী আনোয়ারুল উলুম নোমানীয়া মাদ্রাসা সহ অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্টাতা করেন।
হযরত মানব কল্যানে আনজুমান প্রতিষ্টাতায় মানুষকে সঠিক পথে দিক নির্দেশনা দেওয়ার লক্ষে ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন।তরিকত্ব ভিত্তিক অাধ্যাত্নিক সংস্থা ‘আনজুমানে কাদেরীয়া চিশতীয়া আজিজিয়া’বাংলাদেশ। তাঁর হাতে বায়াত গ্রহণ করে অসংখ্য লোক দেশ-বিদেশে নিজেদের অমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং আনজুমানের মাধ্যমে মাযহাব-মিল্লাতের খেদমত আন্জাম দিচ্ছে। হযরতের জীবনের অমুল্য অবদান হলো আজিজিয়া কাজেমী কমপ্লেক্সঃ তিনি সুদৃর প্রসারী পরিকল্পনা বাস্ত বায়ন করার লক্ষ্যে ১৯৮৮ সালে আজিজিয়া কাজেমী কমপ্লেক্স ট্রাস্ট প্রতিষ্টাতা করেন। এই ট্রাস্টের আওয়াতায় বর্তমানে ২৫ টি প্রতিষ্ঠান তাঁর একক প্রচেষ্টা ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান, এবং তাঁর বক্ত-মুরিদানের সাহায্য-সহযোগিতা পরিচালিত হয়ে আসছে।কমপ্লেক্স পরিচালনাধীন প্রতিষ্ঠিতসমূহঃ (১) ছিপাতলী জামেয়া গাউছিয়া মূঈনীয়া মাদ্রাসা, (২) হাটহাজারী আনোয়ারুল উলুম নোমানীয়া মাদ্রাসা, (৩)বেতবুনিয়া মূঈনীয়া উলুম রেজবীয়া সাঈদিয়া মাদ্রাসা, (৪) শহর কুতুব আমানত শাহ্ মাদ্রাসা, (৫) আল্লামা গাজী সৈয়দ আজিজুল হক শেরে বাংলা (রহ) তাহফীজুল কোরআন মাদ্রাসা, (৬) হযরত শাহ্ আহম্মদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহ) মাদ্রাসা, (৭) আল্লামা কাজেমী (রহ) ছাত্রবাস,সহ আরো ২৫ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।লেখক হিসেব আল্লাম আজিজুল হক আল কাদেরীর ভৃমিকা অসিম।তিনি শুধুমাত্র যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, মুফাসসির,ইসলামী আইনজ্ঞ, পীরে তরিকত্ব, সুবক্তা ও তর্কবিদই নন বরং তিনি ইসলামী আকাইদ ও যুগোপযোগী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয়ের উপর অসংখ্য গ্রন্থ রচনা,ফত্ওয়া-ফারায়েয ও প্রবদ্ব বিরামহীনভাবে লেখেই যাচ্ছেন। যা পাঠ করে পাঠক সমাজ পাচ্ছেন অন্ধকার থেকে আলোর দিশা ও সঠিক দিক-নিদের্শনা। বর্তমানে হুযুর কেবলার লিখিত প্রায় শতাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। আরো অসংখ্য কিতাব প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কিতাবের নামঃ (১) ফরমানে মুস্তফা, (২) শানে মুস্তফা, (৩) মিলাদে মুস্তফা, (৪) ইরশাদে মুস্তফা, (৫) আল্ বায়ানূল মোছাফ্ফা ফি মাসআলাতে আবদিল মুস্তফা, (৬) আস্-সায়েক্বাহ,(৭)আত্-তোহফাতুল গাউছিয়া,(৮) আল্ কাওলুল হক্বব,(৯) কালামুল আউলিয়া ফি শানে ইমামিল আউলিয়া,(১০) তায্কেরাতুন্ নুফুসুল কুদ্ সিয়্যাহ ফি সালাসিলে আউলিয়াইল্লাহ, (১১) ফরমানে মোস্তফা সহ রয়েছে আরো অর্ধশতাধিক কিতাব। মহান আল্লাহ হুজুরের জীবন কর্মকে কবুল করে জান্নাতের বাসিন্দা রুপে কবুল করুক। আমিন।
লেখক: সভাপতি,চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র



ফেইসবুকে আমরা