বাংলাদেশ, , রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

বাংলার লোকসাহিত্যের দূত ড. আশরাফ সিদ্দিকী স্মরণে : সোহেল মুহাম্মদ ফখরুদ-দীন

  প্রকাশ : ২০২০-০৩-১৯ ১৮:৪৯:২৪  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : বাংলাদেশের ইতিহাসে বরেণ্য লোকসাহিত্য গবেষক ড. আশারাফ সিদ্দিকী একটি কালজয়ী নাম। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদ ও শহরের জীবনের লোক সাহিত্যকে তিনি প্রজন্মের জন্য গ্রন্থ আকারে রেখে গেছেন। তাঁর রচিত অনেক মূল্যবান গ্রন্থ আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ইউরোপ আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। ড. আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আলোকিত এক মহামানব। ১৯ মার্চ ২০২০ দিবাগত রাত ৩ টায় রাজধানী ঢাকার এ্যাপোলো হসপিটালে ৯৩ বছর বয়সে তিনি মারা যান। ইতিহাস সাহিত্য সংস্কৃতির এই মনীষীর সাথে আমার পরিচয় হয় ১৯৯৮ সালে। ধানমন্ডিতে বসবাস করতেন চট্টগ্রামের কৃতি পুরুষ ভাষাসৈনিক ও ঢাকা শিাবোর্ডের চেয়ারম্যান জনাব ফেরদৌস খান। খান সাহেবের পাশাপাশি বাড়িতে বসবাস করতে ড. আশরাফ সিদ্দিকী। ফেরদৌস খান সাহেবেই আশরাফ সিদ্দিকী সাহেবের সাথে তাঁর বাস ভবনে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সূত্রে আশরাফ সিদ্দিকী সাহেবের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল আমার। ড. আশরাফ সিদ্দিকী মানুষ হিসেবে অসাধারণ গুণ সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। ২০০০ সালে চট্টগ্রাম সাহিত্য সাংস্কৃতি পরিষদের অনুষ্ঠানে আমার আমন্ত্রণে তিনি চট্টগ্রামে আসেন। আন্দরকিল্লাস্থ কে.বি আবদুস সাত্তার মিলনায়তনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। এতে ড. আশরাফ সিদ্দিকী প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। এই সভায় অন্যান্যের মধ্যে মুহাম্মদ আশরাফ খান, লেখিকা ফাহমিদা আমিন, কবি ফজিলাতুল কদর, বেগম রুনু সিদ্দিকী, অধ্যা মোহাম্মদ হোসেন খান সহ অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। সভার পরের দিন ড. আশরাফ সিদ্দিকী চাকতাইস্থ কবি ফজিলাতুল কদরের বাসভবনে মধ্যহ্নভোজ শেষে সুগন্ধাস্থ চট্টগ্রাম মহিলা ইসলামী পাঠাগার পরিদর্শন করেন। ঐ সভায় তিনি কবি ফজিলাতুল কদরকে নিবেদন করে একটি কবিতা রচনা করেন।
কবিতাটি নিুরূপ:
“তোমাদের নাম-সবার নাম ভালোবাসা”

সত্যি হাঁ-সত্যিই ত-
চন্দ্রের ছায়া দেখেনি সূর্য
তাকেও দেখেনি চাঁদ
একই বিশ্বে তবু পাশাপাশি
একই লক্ষ্যে কর্মপ্রবাহ
ছুয়ে যায় প্রতি জড় ও অজড় প্রাণ
অবসরহীন দিনে আর রাতে
বলে ‘ভালোবাসি’
তাদের সে গান সারা গৃথিবীর
পাখীর কণ্ঠে
দেখা অদেখায় প্রাণে এনে দেয়
চির মমতার স্বাদ.
ঝড় ঝঞ্জা বিবাদ বিসংবাদ
কোন কিছুই ঘটায় না অবসাদ.
প্রাতঃস্মরণীয় ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের
স্মৃতির-সভায় গিয়ে-
এ তত্ত্বটুকুই জানলাম আপনার কাছে
সাগর দ্বীপে আপনাদের ঘর
চারদিকে উত্তাল ঢেউ আর হু হু হাওয়ার কলম্বর
কখনও আবার পাইন বলে দুরন্ত সাপের মত
ঝড় ঝঞ্জা অবিরত
দারুণ দাপে
সুন্দরীর চুল উড়ে-
ঘর কাঁপে-মন কাঁপে.
অথচ দেখুন আমরা সবাই
সূর্য ও চাঁদের প্রসাদ চাই
কিন্তু উড়ির চরের দারুন জ্বর
আমাদের যুগে যুগে কাঁদায় নিরন্তর
এবং আপনি বলছেন ভালোবাসাই
অজড় অমর-
হয়তো আপনিই ঠিক।
আপনি লিখুন-
আপনার কবিতায় সমুদ্র চিরতরে বন্ধ হয়ে যাক
চাঁদ সূর্য গ্রহ তারকারা সব বন্ধ হয়ে থাক
আপনি তাদের পত্র দিন-লিখে দিন-
তোমাদের নাম-সবার নাম আজ থেকে ভালোবাসা।

ড. আশরাফ সিদ্দিকী ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় সোহেল মুহাম্মদ ফখরুদ-দীনের সম্পাদনায় প্রকাশিত ফজিলাতুল কদরের সাহিত্য কর্ম গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি রুপে যোগদান করে আমাকে কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করেছেন। এই ঋণ শোধ হবার নয়। তাঁর মতো পণ্ডিত ব্যক্তি আমার মতো তৎসময়ে তরুণ লেখকের একটি বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে যোগদান আমার কাছে বড়ই অর্জন। ড. আশরাফ সিদ্দিকী চট্টগ্রামের মানুষের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল মধুর। প্রয়াত অধ্যাপিকা সালমা চৌধুরী ও ইতিহাসবিদ ড. মুহাম্মদ এনামুল হকের কথা তিনি সবসময় বলতেন। চট্টগ্রামের মানুষের সাথে দেখা হলে মাত্রই চট্টগ্রাম কলেজের অবস্থা জিজ্ঞেস করতেন। এই ধরনের মানুষ বর্তমান সমাজে বিরল। ড. আশরাফ সিদ্দিকী ১৯২৭ সালের ১ মার্চ তার নানাবাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার নাগবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আব্দুস সাত্তার সিদ্দিকী ছিলেন একজন শৌখিন হোমিও চিকিৎসক এবং ইউনিয়ন পঞ্চায়েত ও ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান। মা সমীরণ নেসা ছিলেন স্বভাব কবি। ড. আশরাফ সিদ্দিকী ছিলেন একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, শিাবিদ, নাট্যকার, ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক, লোক ঐতিহ্য গবেষক, এবং শিশু সাহিত্যিক। বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যকে যারা সমৃদ্ধ করেছেন তিনি তাদের একজন। ১৯৭৬ সাল ছয় বছর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন তিনি। এরপর ১৯৮৩ সালে জগন্নাথ কলেজের অধ্য হিসেবে যোগ দেন। সেখান থেকেই তিনি অবসরে যান। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদকে ভূষিত হন। ৪০ এর দশকের শুরুতে প্রতিশ্রুতিময় কবি হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ। তার সাহিত্যিক জীবনে তিনি রচনা করেছেন পাঁচশ এর অধিক কবিতা। বাংলার লোকঐতিহ্য নিয়ে করেছেন গভীর গবেষণা। তিনি রচনা করেছেন ৭৫টি মূল্যবান গ্রন্থ। উল্লেখযোগ্য হলো: কিংবদন্তির বাংলা, বাংলাদেশের লোককাহিনী,Toontoony and other Stories, Bhombal dass- The Uncle of Lion: A Flolk Tale from Bangladesh,লোকায়ত বাংলা, গুণীন, বাংলাদেশের রূপকথা, হারানো দিনের ধাঁধা, সিংহের মামা ভোম্বল দাস, শতাবব্দীর সেরা হাসির গল্প, কিশোর রচনা সমগ্র, বাণিজ্যেতে যাবো আমি, গলির ধারের ছেলেটি, বাংলাদেশের লোক সাহিত্য ও ঐতিহ্য, শান্তি নিকেতনের পত্র, বেঙ্গলী ফোকলোর কলেক্সন এন্ড স্ট্যাডি, ফোকলোরিক বাংলাদেশ, লোক-সাহিত্য, সহস্র মুখের ভিড়ে, বাংলাদেশের রূপরেকা, মনে পড়ে, প্রবন্ধ সমগ্র- ১, প্রবন্ধ সমগ্র- ২, জন অরণ্য, আরসি নগর, দাড়াও পাথিক-বর। ১৯৪৮ সালে দুর্ভিরে প্রোপটে ‘তালেব মাষ্টার’ কবিতা রচনা করে তিনি অল্প সময়ের মধ্যে গণ মানুষের কবি হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ‘গলির ধারের ছেলেটি’ ছোট গল্প লেখক হিসেবে তাকে প্রতিষ্ঠিত করে। এই ছোট গল্প অবলম্বনে সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ‘ডুমুরের ফুল’ চলচ্চিত্রটি জাতীয় পুরস্কার পায়। বাংলার মৌখিক লোক সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে লিপিবদ্ধ করার জন্য ড. আশরাফ সিদ্দিকী বিশেষভাবে সমাদৃত। ১৯৫৮ সালে প্রখ্যাত ম্যাকমিলান পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত তার ‘ভোম্বল দাশ’ বইটি ছিল সে বছরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক বিক্রিত শিশুদের বইয়ের তালিকায়। পরে এ বইটি ১১টি ভাষায় অনূদিত হয়। ৭০ দশকে লেখা ‘রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন’ ও ‘প্যারিস সুন্দরী’ আজও তরুণ পাঠকদের কাছে জনপ্রিয়। ড. আশরাফ সিদ্দিকী পড়াশোনা করেছেন শান্তিনিকেতন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে তিনি আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ এবং পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি রাজশাহী কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, ময়মনসিংহের এএম কলেজ, ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। তিনি কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক, ডিস্ট্রিকট গ্যাজেটিয়ারের প্রধান সম্পাদক ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার চেয়ারম্যান, প্রেস ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট, নজরুল একাডেমির আজীবন সভাপতি এবং নজরুল ইনস্টিটিউটের সভাপতির দায়িত্বপালন করেন। ত্রিশালে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেন তিনি। পারিবারিক জীবনে তিনি ১৯৫১ সালের ২৩ ডিসেম্বর সাঈদা সিদ্দিকীকে বিবাহ করেন। স্ত্রী সাঈদা সিদ্দিকী ছিলেন আজিমপুর গালর্স হাই স্কুলের শিক্ষিকা। তাদের পাঁচ সন্তান সবাই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং নিজ নিজ পেশায় সুপ্রতিষ্ঠিত। তার পুত্র সাঈদ সিদ্দিকী ক্যাটস্ আই-এর চেয়ারম্যান, নাহিদ আলম সিদ্দিকী’স ইন্টারন্যাশনাল-এর অধ্যক্ষ, কন্যা তাসনিম সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পুত্র রিফাত আহম্মেদ সিদ্দিকী’স ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারপারসন, ও রিয়াদ সিদ্দিকী ক্যাটস্ আই-এর পরিচালক।

লেখক: ইতিহাসবেত্তা ও বহুগ্রন্থ প্রণেতা, সভাপতি, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র।



ফেইসবুকে আমরা