প্রাচীন কলিকাতা আলিয়া মাদরাসা থেকে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম বিশ্বের ঐতিহ্য
….সোহেল মো. ফখরুদ-দীন
পরিস্হিতি২৪ডটকম : ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম কলিকাতা আলিয়া মাদরাসা। সেই প্রাচীন কলিকাতা আলিয়া মাদরাসা থেকে আজকের কলিকাতা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ভূতপূর্ব নাম কলকাতা মাদরাসা কলেজ বা মাদরাসা আলিয়া নামে সমগ্র পৃথিবীতে পরিচিত রয়েছে। মুসলিম বিশ্বে শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে এই প্রতিষ্ঠানের অবদান রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই মাদরাসায় পাঠদান করে মুসলিম সমাজের অনেক অনেক আলোকিত মানুষ হয়েছেন। কোরআন ও হাদিস শিক্ষায় প্রাচীনকাল থেকে কলিকাতা আলিয়ার সুনাম ছড়িয়েছিল। বাংলাদেশেও কলিকাতা আলিয়া একটি বিশেষ প্রভাব আজও বিদ্যমান। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কলিকাতা আলিয়া মাদরাসা থেকে সনদ ও ডিগ্রি নিয়ে এসে অত্র অঞ্চলে বিশেষ মাদরাস স্থাপনের মাধ্যমে মুসলিম শিক্ষা বিস্তারে কাজ করেছেন অনেক আলেম ওলামা। এই মাদরাসার ছাত্র থেকে শিক্ষাবিদ ও আলেম ওলামা হয়েছেন। বাংলাদেশে কলিকাতা আলিয়া থেকে শিক্ষা গ্রহণ ও আরো উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পরে তিনজন প্রধানমন্ত্রীরূপে দায়িত্ব পালন করেছেন। যা ইতিহাস থেকে জানা যায়। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী রূপে দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিরা হলেন: প্রয়াত মিজানুর রহমান চৌধুরী, প্রয়াত শাহ আজিজ ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ। তা ছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে কলিকাতা আলিয়া মাদরাসার অনেক ক্ষণজন্মা ছাত্র অবদান রেখেছেন। সরকারের উচ্চ মহলে কর্মরত ও রাষ্ট্রীয় গুরুদায়িত্বও পালন করেছেন অনেকে। কলিকাতা আলিয়া মাদরাসা এখন কলিকাতা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। আমি পূর্বে প্রতিশ্রুতি দেওয়া একটি আমন্ত্রণ রক্ষার্থে ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইউএস বাংলা এয়ারওয়েজ যোগে ভারতের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গমন করি। বিমানবন্দরে আমাকে পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট কবি শ্রীতারকনাথ দত্ত ও জীতেন্দ্রলাল আচার্য ফুলেল শুভেচ্ছা দিয়ে অভ্যর্থনা জানান। পরে মার্কুইজ স্টেটে একটি বেসরকারি রেস্টহাউজে আবাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ৩ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১১টায় কলিকাতা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্বনির্ধারিত সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগদান করে বক্তব্য প্রদান করি। বিষয়: “ভারতীয় উপমহাদেশে সুলতানি ও মোগল শাসনামল”। সেমিনার শেষে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্কসার্কাস ক্যাম্পাসে বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সাহিত্যিক অধ্যাপক সাইফুল্লা মহাশয় ও কলিকাতা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন আলিয়া মাদরাসা কলেজ ক্যাম্পাসে ইসলামি ধর্মতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক শামীম আকতার এর সাথে পৃথক পৃথক সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হই। দুজনেই পুরা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন এবং প্রাচীন লাইব্রেরি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট পরিদর্শন করান। আমাকে এ সময় আমার সাথে ছিলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ মেমোরিয়াল মাদরাসা শিক্ষাকেন্দ্রের ভূতপূর্ব মুখ্য শিক্ষা সম্প্রসারক শিক্ষাবিদ আনোয়ার হুসেন। কলিকাতা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পশ্চিমবঙ্গের একটি অন্যতম সংখ্যালঘু বিশ্ববিদ্যালয়। ১৭৮১ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির তদনীন্তন গভর্নর মি. ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতা মোহামেডান কলেজ নামে এই প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা করেন। আরবি, ফারসি, ইসলামি ধর্মতত্ত্ব ও আইন বিষয়ে পাঠদানের উদ্দেশ্যে এই কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের পরে এই কলেজে বাংলায় পাঠ শুরু হয়। ২০০৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় একটি বিল পাসের মাধ্যমে রাজ্য সরকার এই কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করেন। বর্তমানে কলিকাতা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষা ক্যাম্পাসটি কলকাতার তালতলা অঞ্চলের হাজী মুহাম্মদ মহসীন স্কোয়ারের (ওয়েলেসলি স্কোয়ার) উত্তরে অবস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বঙ্গের রাজ্যপাল, পশ্চিমবঙ্গ। উপাচার্য়, অধ্যাপক মুহাম্মদ আলি। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে প্রথম দেড় বছর প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব খরচে চালান হেস্টিংস নিজেই। তারপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পরিচালিত বাংলা সরকার এটি পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে। কলকাতার বউবাজার অঞ্চলের বৈঠকখানায় এই কলেজের সূত্রপাত। পরে তালতলায় এর বর্তমান ঠিকানায় প্রতিষ্ঠানটি স্থানান্তরিত হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মাদরাসায় আর্থিক সংকট দেখা দিলে ১৮১৯ সালে কোম্পানি ক্যাপ্টেন এরোন নামে এক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সেনাকে সুপাররেন্টেন নিয়োগ করেন মাদরাসা ম্যানেজমেন্ট কমিটির রাজস্ব বোর্ডকে সহায়তা করার জন্য। ১৮৫০ সালে আর্থিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় গুরুতর সংকট দেখা দিলে অ্যালোয়েস ¯প্রাঞ্জার নামে অপর এক ইউরোপীয়কে মাদরাসার শীর্ষে স্থাপন করা হয়। প্রথম দিকে এই কলেজে আইন, জ্যোতির্বিদ্যা, যুক্তিবিজ্ঞান, দর্শন, পাটিগণিত, জ্যামিতি, ছন্দবিজ্ঞান, ব্যাকরণ, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি পড়ানো হত। ১৮২৭ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অধ্যাপক পি ব্রেটন এই কলেজে একটি মেডিক্যাল কাস শুরু করেন। ১৮৩৬ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত এই কাস এই কলেজেই নেওয়া হত। ১৯২৭ সালটি বাংলার মুসলমান সমাজের শিক্ষার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বছরই অন্যান্য মাদরাসার সঙ্গে কলকাতা মাদরাসাকে আলিম, ফাজিল, কালিম, মুমতাজুল মুহাদ্দেসিন প্রভৃতি শিক্ষাক্রমের সূচনা ঘটে। এত বছর গৌরবের সাথে অতিবাহিত হওয়ার পর আজ থেকে ৮ বছর পূর্বে কলিকাতা আলিয়া মাদরাসা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এর উদ্বোধন করেন। বর্তমানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির তত্ত্বাবধানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক উন্নতি পরিলতি হয়েছে। কলিকাতা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন লাইব্রেরিতে ২ লক্ষ ৫০ হাজারেরও বেশি মূল্যবান গ্রন্থ রয়েছে। বর্তমানে ২৮টি বিভাগে অধ্যয়নের সুযোগ আছে। আধুনিক হোস্টেলে ১২শত ছাত্র ও ৮শত ছাত্রী বসবাসের সুযোগ রয়েছে। তিনটি ক্যাম্পাসের মধ্যে এক হাজার একশত ষাটটি শ্রেণিক বিদ্যমান। আধুনিক কম্পিউটারে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে শিক্ষাদানসহ এই আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবময় অতীতকে সামনে নিয়ে আরো এগিয়ে যাবে বিশ্ব মুসলিম ইতিহাসের সাথে। কলিকাতা আলিয়া, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রযাত্রায় বেঁচে থাকুক হাজার বছরের ইতিহাস। যে ইতিহাসে কোরআন হাদিস শাস্ত্র সহ ২৮টি বিষয়ে পড়ালেখার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রী আলোকিত জীবন পাবে।
লেখক: সোহেল মো. ফখরুদ-দীন, ইতিহাসবেত্তা ও গ্রন্থপ্রণেতা।