বাংলাদেশ, , শনিবার, ৪ মে ২০২৪

জাতীয় শিশু দিবস হোক শিশুর প্রতি সহিংস বন্ধের অঙ্গীকার : ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন

  প্রকাশ : ২০২০-০৩-১৫ ১৫:৩৯:৪৩  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী ১৭ মার্চ। আজকের দিনটিতেই আবার জাতীয় শিশু দিবস। সারাদেশে দিনটি জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে সাড়ম্বরে উদযাপিত হবে। স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার এই মহান নেতার জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। কোনো বিশেষ ঘটনা বা আনন্দের দিনকে শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি আনন্দের দিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু একজনই জন্মেছিলেন। যাঁর জন্ম না হলে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হতো না। এজন্য ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনটিকে শিশু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ছাড়াও অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার বিশ্ব শিশু দিবস পালন করা হয় এই দেশে। ১৯২০ সালের এই দিনেই গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর বাবার নাম শেখ লুৎফর রহমান। মায়ের নাম সায়েরা খাতুন। তাঁদের চার মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে শেখ মুজিব ছিলেন তৃতীয়। বাবা-মা তাঁকে আদর করে ডাকতেন খোকা বলে। সেই ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন প্রতিবাদী। অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করতেন না। তার প্রমাণ পাওয়া যায় শেখ লুৎফর রহমানের কথা থেকেই। দেশের ক্রান্তিলগ্নে বঙ্গবন্ধু যখন লড়ে যাচ্ছিলেন তখন এক সাক্ষাৎকারে শেখ লুৎফর রহমান বলেছিলেন, ‘সে তো ছোটবেলা থেকেই প্রতিবাদী, অন্যায় সহ্য করতো না। কোথাও অন্যায়-অনিয়ম দেখলে প্রতিবাদ করতো।’ শেখ লুৎফর রহমানের কথার প্রমাণ দেখেছে সারা বিশ্ব। যা হোক, ফিরে আসা যাক শেখ মুজিবের কৈশোরে। কিশোর বয়সেই শেখ মুজিবের প্রতিবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ দেখা গিয়েছিল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানসিকতা, গরিব-দুঃখী মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও তাদের দুঃখ দূর করার প্রতিজ্ঞা তাঁকে রাজনীতিতে নিয়ে আসে। এমনিতেই বঙ্গবন্ধু শিশুদের অত্যন্ত আদর করতেন, ভালোবাসতেন। শিশুদের সাথে গল্প করতেন, খেলা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন আজকের শিশুরাই আগামী দিনে দেশ গড়ায় নেতৃত্ব দেবে। তরুণ প্রজন্ম এই মহান নেতার আদর্শ থেকেই দেশ গড়ার অনুপ্রেরণা লাভ করে। যারা বাংলাদেশকে বিশ্বাস করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণ করে তাদের মাঝেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকবেন জন্ম থেকে জন্মান্তরে। মূলত “আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত” এই নীতিবাক্যটি আমরা সবাই জানি। শিশুরাই আগামীর কর্ণধার। শিশুরা নিষ্পাপ। তা জানার পরও আমাদের দেশের শিশুরা আজকাল প্রায়ই দুর্বৃত্তদের ঘৃণ্য টার্গেটে পরিণত হচ্ছে। কোমলমতি শিশুরা শিকার হচ্ছে খুন, গুম, অপহরণ, নির্যাতনসহ বিভিন্ন সহিংসতার। কারণে অকারণে নির্যাতিত হচ্ছে শিশুরাই। দুর্বৃত্তদের সহিংসতার লোলুপ দৃষ্টি এড়াতে পারছে না শিশুদের। কোমলমতি শিশুরা ধর্ষিত ও নির্যাতিত হচ্ছে গৃহশিক্ষকের হাতে, মক্তব্যের মৌলভীদের কু-মানস ও দুশ্চরিত্রের নগ্ন থাবায়। এমনকি অহরহ বলাৎকারের ঘটনাও ঘটছে। আজ শিশুরা নিরাপদ নয় মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডায়। নানানভাবে শ্লীলতাহানিসহ অঘটন ঘটছেই। তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই ঘৃণিত কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে সোচ্চার থাকতে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়াও নির্যাতনের পর গুম, খুনসহ নানান অঘটনে বিব্রত সমাজব্যবস্থা। কিছু মানুষের রূপধারী দুর্বৃত্তরা প্রতিনিয়ত এই অঘটন ঘটাচ্ছে। তারা বেমালুম ভুলে গেছে মানবিকতা ও মানবতা। শিশুহত্যা সমাজে এক ধরনের মানবিক বিপর্যয়। বর্তমানে বাংলাদেশে শিশুদের নিরাপত্তা চরম ঝুঁকির মুখে। বর্তমানে সারা দেশেই কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের শিশুর ওপর নির্মম ও বর্বরোচিত আচরণ দংশন করছে মানবতাবোধকে। চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্র“য়ারিতেই একাধিক শিশু খুন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে। শিশু অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে, যা সভ্য সমাজের জন্য মোটেই কাম্য হতে পারে না। শিশুরা যে শুধু দুর্বৃত্তদের দ্বারাই আক্রান্ত বা আহত নিহত হচ্ছে তা-ই নয়। শিশুরা নিজ পরিবারের সদস্য এমন কী নিজ গর্ভধারিণী মা, বা জন্মদাতা বাবার হাতেও খুন হচ্ছে। অনেক সময় পারিবারিক কলহে পড়ে মা-বাবাসহ আত্মীয়স্বজনরা শিশুর সর্বনাশ করছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের হিসাবে, গত চার বছরে এক হাজার ৬৯ জন শিশুহত্যা, এক হাজার শিশু ধর্ষণ এবং প্রায় ৫০০ শিশু অপহরণের শিকার হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে অনেক ঘটনা, মা-বাবা বা স্বজনদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কেন এমন সমাজবিরোধী ঘটনা ঘটছে তার মূল কারণ সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব, অপ্রতিরোধ্য শিশুশ্রম, পরকীয়া, সম্পদের লোভ, বেকারত্ব, ভিনদেশী কালচার-সংস্কৃতির প্রভাব, অনলাইন প্রযুক্তিতে পর্নোগ্রাফির প্রসার ও সহজলভ্যতা, বেপরোয়া জীবনযাপন, পাচার, কর্তৃত্বের বিরোধ-শত্র“তা, ব্যক্তি স্বার্থপরতা ইত্যাদি নেতিবাচক প্রভাবে সমাজের বিবেকবর্জিত কতিপয় নোংরা মস্তিষ্কের লোক শিশুদের প্রতি নৃশংস আচরণে সম্পৃক্ত হচ্ছে। তাই এসব নৃশংসতা বন্ধ করতে হলে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ অতি গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে যেখানে কোনো ধরনের বৈষম্য ব্যতিরেকে শিশুদের তাদের মাতাপিতার জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা, ধর্ম, রাজনৈতিক বা অন্যান্য মতামত, জাতীয় উৎস, নৃগোষ্ঠীগত বা সামাজিক উৎস, সম্পত্তি, অমতা, জন্মগত বা অন্যবিধ মর্যাদা অধিকার দিয়েছে। এখন প্রশ্ন জাগে, এতসব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের বিধান থাকা সত্ত্বেও কি চলতে থাকবে শিশুদের প্রতি সহিংসতা? সরকারের উচিত এ সহিংস আচরণ থেকে শিশুদের রা করার জন্য সচেতন উদ্যোগ গ্রহণ করা। তাছাড়াও শিশুদের প্রতি নৃসংশতা বন্ধ এবং তাদের সুরার জন্য পরিবারের ভূমিকার পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা খুবই জরুরী। শিশু নির্যাতন ও হত্যার মতো অমানবিক ঘৃণ্য অপরাধ প্রতিরোধ করতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। কোমলমতি শিশুদের জীবনের নিরাপত্তায় শিশু নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ দেশের প্রতিটি মানুষের ঐকান্তিক দাবি। আইন প্রয়োগে শিথিলতার কারণে আমাদের দেশে অব্যাহতভাবে শিশুর প্রতি নৃশংসতা বেড়েই চলেছে। তাই এখনই সময় শিশুদের প্রতি সহিংসতা ও নৃশংসতা বন্ধ করতে জরুরী পদপে গ্রহণ। আমরা আর কোনো কোমলমতি শিশু হত্যার খবর শুনতে চাই না। আমাদের বিবেক জাগ্রত হোক। জাগ্রত হোক মানবিক মূল্যবোধ। বন্ধ হোক শিশুর প্রতি সহিংসতা ও যত অনাচার। স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তা বাস্তবায়নের জন্য দেশের নতুন প্রজন্মকে সোনার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আসুন, শিশুদের কল্যাণে আমরা আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করি। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি। দলমত নির্বিশেষে সবাই মিলে বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতামুক্ত স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলি। আর বিদ্যমান এই সামাজিক অবস্থায় শিশুর বেড়ে ওঠার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি কীভাবে করা যায় তার পদক্ষেপ গ্রহণ করে শিশুর প্রতি নির্যাতন বন্ধে ব্যক্তিগত-পারিবারিক-সামাজিক-রাষ্ট্রীয় সংবেদনশীলতার ক্ষেত্রে তৈরি করা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক শিশুদের প্রতি নৃসংসতা বন্ধসহ নানাধরনের সহিংসতা ও অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলা এবং শিশুরা সুন্দরভাবে বেড়ে উঠুক, ইতিবাচক সামাজিক পরিচর্যা অব্যাহত থাকুক, এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি (বাপউস)।



ফেইসবুকে আমরা