পরিস্থিতি২৪ডটকম : বিশ্বের নানান প্রান্তে প্রতিদিনই নানান দিবস পালন হয়। এর কোনটি জাতীয়,কোনটা আর্ন্তজাতিক। আর প্রতিটি দিবসের প্রতিপাদ্য থাকে আলাদা আলাদা এবং একেকটি দিবসের গুরুত্ব থাকে একেক রকম। আর এই ধারাবাহিকতায় প্রতিটি দিবসের ন্যায় আজকের এই বিশেষ দিবস।যেহেতু আমি এজজন পেশাজীবি, চিকিৎসা পেশার সাথে সংযুক্ত আছি তাই এই দিবসটিকে শ্রদ্ধা আর সম্মানের সাথে স্মরণ করছি। কর্মই হোক আর মর্মই হোক অথবা নিছকই প্রতীকীই হোক প্রায় হাজারো দিবসের মাঝে আজ চিকিৎসক দিবস। এই দিবস উপলক্ষে পেশাজীবি সকল সহকর্মী, অগ্রজ ও অনুজদের প্রতি শুভেচ্ছা নিবেদন করছি।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চিকিৎসার জন্য স্বভাবতই ডাক্তারদের শরণাপন্ন হ’তে হয়। তাই সমাজে ডাক্তারদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তাছাড়া ডাক্তারী পেশা ও মানবিকতা একই সুতোয় গাঁথা। কারণ ডাক্তারগণ মানুষের যত বেশী সেবা করার সুযোগ পান, অন্য পেশাজীবীরা ততটা পান না। একজন আদর্শ ডাক্তার মানুষকে সুস্থ করে নিজের ডবল দায়িত্ব হিসাবে দেখেন। একটি দায়িত্ব মানুষ হিসাবে, আরেকটি ডাক্তার হিসাবে। কাজেই একজন ডাক্তারকে আগে ভালো মানুষ হ’তে হয়, তাহ’লে তিনি পরবর্তীতে আদর্শ ডাক্তার হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন।কিন্ত পরিতাপের বিষয় ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক সব দেশে সব সময় একটি অতি সংবেদনশীল ও নাজুক সম্পর্ক।অন্যদিকে ডাক্তারদের ওপর মানুষের নির্ভরতা এত বেশি যে অনেক সময় বলা হয় ডক্টর ইজ নেক্সট টু গড। কিন্তু নির্ভরতা যেখানে বেশি, আস্থার সংকটও সেখানে মাঝেমধ্যে তীব্র হতে পারে।আর মৃত্যুই যখন অনিবার্য, চিকিৎসকের ভুল সেখানে হবেই’-এ কথা সকলেরই জানা। কেননা চিকিৎসকরা তো রক্ত মাংসেরই মানুষ।আর জেনে শুনে কেউ এত ভূল করেনা বা করা উচিত ও নয় । কিন্তু একটু এদিক ওদিক হলে প্রায়ই চিকিৎসায় ‘গাফিলতি, অবহেলার’ অভিযোগে, এমনকি ‘ভুল চিকিৎসার’ অভিযোগে ডাক্তারদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে।তা কোন ভাবে কাম্য নয় ।আর স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে ডাক্তার রোগীর সম্পর্কের ব্যাপারটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়।অপরদিকে ক্যালেন্ডারের পাতা অনুসারে বছরের প্রতিটি দিনের ২৪ ঘন্টাই এমনকি প্রতিটি পাবর্ণেও আমাদের চিকিৎসক সমাজ আনন্দকে বিসর্জন দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসহায় অসুস্থ মানুষের পাশে পাশে থাকে। তারা নিজেদের আনন্দকে বিসর্জন দিয়ে অন্যকে সুস্থ করে তোলায় ব্যস্ত থাকে আর রোগীর স্বজনদের মুখে হাসি ফোটাতে সচেষ্ট থাকেন। আর বিশেষত বাংলাদেশের চিকিৎসকরা বিশেষ গর্ব অনুভব করেন, আমাদের গর্ব ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ কালে কালে যুগে যুগে বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলনেই চিকিৎসক সমাজের রয়েছে প্রত্যক্ষ ভূমিকা। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পেশাজীবী শ্রেণির মধ্যে সর্বাধিক শহীদ হন চিকিৎসকরা। বাংলাদেশের দক্ষ চিকিৎসকগণ পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রতি নিয়তই সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন তাঁদের মেধা-মনন-প্রজ্ঞা-নিষ্ঠা আর একাগ্রতা দিয়ে। এই চিকিৎসকদের একটু ভুল বা সাধারণের প্রত্যাশিত সেবার বাইরে কিছু একটা ঘটলেই বিপত্তি সৃষ্টি হয়। চিকিৎসকদের চৌদ্দ গোষ্টি উদ্ধারে নেমে পড়ি। আর বাংলাদেশের মানুষদের ভুল ধারণা রয়েছে যেটার জন্য প্রতিনিয়তই তারা চিকিৎসকদের গালিগালাজ করে থাকেন। বাংলাদেশের আপামর জনগনের ধারণা কেবলমাত্র চিকিৎসকরাই্ জনগণের করের টাকায় মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করেন আর তাই জনগণের প্রতি, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা শুধুমাত্র চিকিৎসকদেরই। যারা এই ধারণা পোষণ করেন তাদের প্রতি বিনয়ের সাথে বলতে চাই, প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ব্যক্তিই জনগণের করের টাকায় পড়েন। সেই হিসেবে প্রশাসনের আমলা থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য, উকিল, বিচারপতি, প্রকৌশলী, শিক্ষকসহ সকল পেশার মানুষই কোন না কোনভাবে জনগনের করের টাকায় পড়েছেন। সুতরাং জনগণের করের টাকায় পড়ায় দায় শুধুমাত্র চিকিৎসকরা নেবেন কেন? আর জনগনের অন্যতম মৌলিক অধিকার চিকিৎসা সেবা প্রদানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র তার জনগনের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য চিকিৎসক তৈরি করবে এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মেধাবীরা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তাঁদের মেধা দিয়ে চিকিৎসক হবার জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক নির্বাচিত হন। এভাবেই চিকিৎসক তৈরি হয়। আর এই মহান পেশায় নিবেদিতদের মধ্যে গুটি কয়েকজনের অনিচ্ছাকৃত ভুল বা অবহেলার জন্য সকলেই দোষী হতে পারেনা। মনে রাখতে হবে বিগত শতকগুলোতে জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিজ্ঞানের অবিস্মরণীয় উন্নতির সাথে সাথে অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের। চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত এবং যারা এ পেশার বাইরে, তারাও চিকিৎসার বর্তমান এবং অতীত তুলনা করলে বিস্ময়ে হতবাক না হয়ে পারবেন না। বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা মানুষকে অবাক অভিভূত করছে না শুধু, আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে, রোগ নির্ণয় ও রোগ সারাতে যেমন অগ্রগতি হয়েছে, তেমনি মানুষের সুস্থ জীবন যাপনের নিশ্চয়তা বাড়াতে নানা ধরনের গবেষণা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে পিছনে তাকালে দেখা যায়, কি অসাধ্যই না সাধন করেছে বিজ্ঞানের কল্যাণে। অতীতে যে সকল স্বাস্থ্যগত সমস্যাকে মনে হত প্রকট এবং অনতিক্রম্য, ক্রমে ক্রমে বিজ্ঞানীদের চেষ্টায় তার অনেকগুলোকেই অতিক্রম করতে পেরেছে মানুষ। অতীতে রোগ নির্ণয় পদ্ধতি, ওষুধপত্র এমনকি পাঠ্য বইও ছিল সীমিত। শুধু তাই নয়, চিকিৎসার ধারণা এবং রোগ নির্ণয় পদ্ধতি ভুলে ভরা ছিল। ভুল হয়তো নয়, অজানা ছিল। অনেক ক্ষেত্রেই আল্লাহর উপর ভরসা করা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে রোগ, রোগ নির্ণয়, ওষুধ, এক কথায় সর্বক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি সাধন করেছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, জয় করা গেছে বহু দুরারোগ্য ব্যাধিকে, শল্য চিকিৎসায় অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে, জিনতত্ত্ব জানবার সাথে সাথে উন্মোচন হয়েছে অনেক জটিল রোগের কারণ ও ব্যাখ্যা।অপরদিকে ডাক্তারের কাছে রোগের ইতিহাস ও রোগীর শারীরিক পরীক্ষা আজ হয়ে উঠেছে কম গুরুত্বপূর্ণ, ক্লিনিক্যাল জাজমেন্ট কমে যাচ্ছে। যেহেতু এতে অহেতুক সময় নষ্ট করার চাইতে ল্যাবরেটরীতে রোগ নির্ণয় অনেক সহজ ও নিরাপদ, ডাক্তাররা পরীক্ষার উপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এতে চিকিৎসা বিদ্যার মূল আর্টই অনেকাংশে যাচ্ছে হারিয়ে। চিকিৎসকের ক্লিনিকেল স্কিল কাজে না লাগালে এক সময় হয়তো চিকিৎসক নয়, ল্যাবরেটরিতে রোবটই চিকিৎসা করার ভার পুরোপুরি নিয়ে নিতে পারবে। অপরদিকে চিকিৎসক আর রোগীর দূরত্ব বাড়াচ্ছে কতিপয় কারন। সাধারণত রোগীর কথা মনোযোগ সহকারে না শুনে, ভালো ভাবে রোগীকে পরীক্ষা না করায় অনেক রোগ সঠিক ভাবে নির্ণয় হচ্ছে না বা ভুল হচ্ছে। তাতে ডাক্তার রোগীর সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে। ডাক্তাররা যদি রোগীর রোগের ইতিহাস ভালোভাবে শোনেন, তবে অনেক রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। তাতে করে অযথা অপ্রয়োজনীয় ব্যয় সাপেক্ষ পরীক্ষা নিরীক্ষা এড়ানো সম্ভব। আর্থিক অসামর্থের দরুন অনেক ব্যয়বহুল টেস্ট করা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না। অনেক ক্ষেত্রেই অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যয়ভার রোগীকে মাথা পেতে নিতে হচ্ছে, সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে সুচিকিৎসার সুযোগ। পরীক্ষা নিরীক্ষা রোগ নির্ণয়ে অবশ্যই সহায়ক, কিন্ত অপপ্রয়োগে রোগীকে গিনিপিগ বানানো অযৌক্তিক ও অনৈতিক। দেখা যায়, অনেক নামি দামী ক্লিনিকে না বুঝেই চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগী নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসেন। এছাড়াও কর্পোরেট সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে চিকিৎসা সেবার উপরও, বেশির ভাগ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বা হাসপাতালের কাছে রোগী এখন রোগী নন, বরং ক্লায়েন্ট এবং সেবাদান কোন পেশা নয়, বরং বাণিজ্য। চিকিৎসা সেবা চিকিৎসকদের কাছ থেকে ক্রমেই চলে যাচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি, কর্পোরেট অফিস, চেইন প্রতিষ্ঠান বা ব্র্যান্ড ওষুধ কোম্পানিদের হাতে, যারা চিকিৎসা সেবাকে আর সেবা নয়, বরং মুনাফাভিত্তিক ব্যবসা হিসেবই দেখতে অভ্যস্ত। আর চিকিৎসকরাও এদের হাতের পুতুল হতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি হয়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন চিকিৎসকদের আত্মবিশ্বাস কমেছে, নৈতিকতা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে তেমনি রোগীও তার আস্থা হারাচ্ছেন, শ্রদ্ধার অভাব দেখা দিচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের বেড়েই চলেছে। উন্নতির সাথে সাথে একালে এই অন্ধকারটুকু যোগ হয়েছে চিকিৎসা জগতে এবং বেড়েই চলেছে রোগী চিকিৎসকের টানাপোড়েন। এ থেকে বেড়িয়ে আসতে চিকিৎসকদের সেবা প্রদানকালে দায়বদ্ধতার চেয়ে মানবিকতাকে গুরুত্ব দেওয়া বেশী প্রয়োজন।আমরা বিশ্বাস করি চিকিৎসক,প্রাইমারি চিকিৎসক, সেবিকা, স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই চিকিৎসা সেবাকে সার্বজনীন করা সম্ভব। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বমানের স্বাস্থ্য সেবাকে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে তৃণমূলে পৌঁছে দেবার যে অক্লান্ত প্রচেষ্টা তা সফল হবে। সাধারণের আস্হা বাড়বে অগ্রসৈনিক আমাদের চিকিৎসক সমাজের প্রতি। পরিশেষে চিকিৎসক আর রোগীর অম্লমধুর সম্পর্ক দূরীভুত হয়ে গড়ে উঠবে সৌহার্দ্যতা এটাই কামনা করছি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, সাবেক সভাপতি বৃহত্তর চট্টগ্রাম ডেন্টাল এসোসিয়েশন।