বাংলাদেশ, , মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

করোনা আক্রান্ত প্রতিটি মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করুন : ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন

  প্রকাশ : ২০২০-০৬-০৪ ১৩:৪৪:০৫  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : যাপিত জীবনে বর্তমান সময়ে এক কঠিন শিক্ষার নাম করোনা ভাইরাস। কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস নাম অদৃশ্য এই ভাইরাসটির বিরুদ্ধে বিশ্ব এক হয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, এই ভাইরাসটি থামানোর জন্য। বাংলাদেশেও এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের দেশে এই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ৪৩টি জেলায় লকডাউন (অবরুদ্ধ) করা হয়েছিল। স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী এসব জেলায় সড়ক ও নৌপথে প্রবেশ এবং বের হওয়া নিষিদ্ধ ছিল। কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিল জেলার অভ্যন্তরে যাতায়াতও। কিন্তু এই বিধিনিষেধের অনেকটাই কার্যত ছিল কাগজে-কলমে। মানুষ ঘরে না থাকায় বাস্তবে লকডাউন পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। ফলে এসব জেলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুযায়ী দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে এই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়েছে। বর্তমানে করোনায় আক্রান্ত পুরো দেশ। আর নীরব যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে মানুষ এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে। এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে ইতিমধ্যে মহামারি ঘোষণা করা হয়েছে। একের পর এক আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ, খসে পড়ছে প্রাণ। এ তথ্য প্রযুক্তির যুগে আমরা কমবেশি সবাই অবগত হয়েছি এ করোনা বিষয়ে। এ রোগের এখনো পর্যন্ত কোনো ঔষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। গবেষকরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারপরেও কি থেমে আছে চিকিৎসাসেবা? তাবৎ বিশ্বের চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ করে তুলতে। একজন রোগীর সুস্থ হওয়ার জন্য যেটা আগে দরকার তা হল সেবা। একমাত্র সঠিক সেবার মাধ্যমে সুস্থ করা যায় করোনা আক্রান্তসহ সবধরনের রোগীকে। যার কারণে আক্রান্ত রোগীদের এক তৃতীয়াংশ সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছেন। আজকে সারা বিশ্বে একটা শ্লোগান “ঘরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন”। নিজেকে বাঁচতে হবে, অন্যকেও বাঁচাতে হবে। কেননা নভেল করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯)-এর সংক্রমণে বিশ্বজুড়ে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়েই চলছে। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনার বিরুদ্ধে গোটা মানবজাতি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। কার্যত এক অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে লড়ছে সারাবিশ্ব। এই করোনা ভাইরাস সংক্রমণ একদিকে যেমন বৈশ্বিক দুর্যোগ, তেমনি প্রতিটি দেশের জাতীয় দুর্যোগও। চীনে গত ৩১ ডিসেম্বর প্রথম করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগী শনাক্তের খবর আসে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে এখন পর্যন্ত ২১৫টি দেশ ও অঞ্চলের ৬৪ লাখের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন প্রায় ৪ লাখের কাছাকাছি লোকজন। এই ভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করেছে। আমাদের দেশে সর্বপ্রথম ৮ মার্চ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্তের তথ্য প্রচার করা হয়। এরপর থেকে দেশে এখন মোট রোগী প্রায় ৫৫ হাজারের কাছাকাছি। দিন দিন আক্রান্তের হার বাড়ছে, সাথে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। কেননা মানুষ সরকার ঘোষিত নিয়মকানুন মানছে না। মানছে না সামাজিক দূরত্বের বিষয়। নানান অজুহাতে আর চলচাতুরীতে হাটবাজারসহ পাড়ার অলিগলিতে, মহল্লায় আড্ডা দিচ্ছে। ভিড় জমাচ্ছে। আমাদের দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বেশ কয়েক ধাপে এই ছুটি বাড়িয়ে তা ৩০ মে পর্যন্ত করা হয়েছিল। বর্তমানে সাধারণ ছুটি শেষে সীমিত পরিসরে সবকিছু খুলে দেওয়া হয়েছে। বেঁধে দেওয়া হয়েছে নিয়মকানুন। দেশে করোনা ভাইরাসের লক্ষণ ও তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার ঘটনা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি করোনা পজেটিভ জানার পর আক্রান্ত রোগীর পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও বাড়ছে। এতে সংক্রমণ যেমন বাড়ছে, তেমনি প্রশাসনের মাথা ব্যথার কারণ হয়েও দাঁড়িয়েছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্ক কাটাতে এবং নমুনা পরীক্ষা পরবর্তী পজেটিভ জানার পর রোগীর পলায়নরোধে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রশাসনের মাধ্যমে শনাক্তের পরই রোগীকে করোনা পজেটিভের তথ্য জানানোর পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে। কেননা করোনা আক্রান্ত হলেও আতঙ্কের কিছু নেই। এখন থেকে বিআইটিআইডিতে নমুনা পরীক্ষার আগে রোগীর ঠিকানা ও মুঠোফোন নম্বর নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয় করোনা পজেটিভ কেউ পালিয়ে যাওয়া খুবই আতঙ্কের। কারণ করোনা পজেটিভ কোনো ব্যক্তি যেখানে যাবেন, সেখানে লোকজন সংক্রমিত হবেন। এখনো মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়নি। তাই করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবরে অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। এর মধ্যে কেউ কেউ পালিয়ে যাচ্ছেন, আত্মগোপন করছেন। এটি প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য খুবই বিরক্তিকর। কারণ একজন করোনা পজেটিভ রোগীকে যতদ্রুত আইসোলেশনে পাঠানো যাবে তত বেশি মঙ্গল। তাই নমুনা পরীক্ষায় করোনা পজেটিভ আসা ব্যক্তিদের বিষয়ে আগে প্রশাসনকে খবর দেওয়া উচিত। অন্যদিকে, তথ্য গোপন শুধু চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়, আক্রান্ত ব্যক্তির নিজের পরিবার ও আশেপাশের মানুষের মধ্যেও সংক্রমণের হার বৃদ্ধিতে কাজ করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এ প্রবণতা মহামারি ভাইরাস রোধে সরকারের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করবে। তথ্য গোপন করা যে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ, সেটিও জনসাধারণকে জানাতে হবে। এ ধরনের অপরাধে অনূর্ধ্ব ৬ মাসের কারাদণ্ড বা এক লাখ টকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে এ আইনে। যতই দিন যাচ্ছে, ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে আক্রান্ত সংখ্যা। ্এ রোগের কোনো চিকিৎসা না থাকার কারণে মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, যারা আক্রান্ত হচ্ছে তারা পাচ্ছে না কাক্সিক্ষত চিকিৎসাসেবা। রোগীর তুলনায় নানানভাবে চিকিৎসাসেবা অপ্রতুল। এর একমাত্র চিকিৎসা ঘরে থাকা কিংবা মানুষের মধ্যে পারস্পরিক দূরত্ব মেনে চলাচল করা। সরকার সাধারণ ছুটি দীর্ঘায়িত করে মানুষকে ঘরে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তবে যারা সরকারি চাকরিজীবী, তারা ঘরে হয়তো থেকেছেন এবং মাস শেষে মাসিক ভাতা উত্তোলনের মাধ্যমে ঘরের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করেছেন। অন্যদিকে প্রেসের কর্মচারী, পরিবহন শ্রমিক, অন্যান্য পেশায় যাঁরা জড়িত রয়েছেন, তাঁরা আছেন জীবিকার চিন্তায়। ঘরের বাইরে গেলে জীবন যাওয়ার আশঙ্কা, আবার ঘরে বসে থাকলে কাজকর্মহীন, তখন তাদের খাওয়া-দাওয়া আসবে কোথা থেকে। সরকারি বেসরকারিভাবে যতই ত্রাণের ব্যবস্থা করুন না কেন, মধ্যবিত্ত পর্যায়ে এই ত্রাণ পৌঁছায়নি। আর তাই মানুষ জীবিকার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য বের হচ্ছে এবং যারা বাধ্য হয়ে ঘরের বাইরে যাচ্ছে, তারাই আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এই পরিস্থিতিতে করোনা রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জটি দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে ও আরও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তা রুখতে না পারলে আগামী দিনগুলোতে আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব ও সুপরামর্শে দুর্যোগকালীন এই মুহূর্তে চিকিৎসাসেবাসহ সকল বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আপোষহীন নির্দেশনা দিয়ে আসছেন। সরকারি বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে দিনদিন করোনা আক্রান্তের চিকিৎসাসেবায় ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রত্যেকটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেটর স্থাপনসহ পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের নির্দেশ প্রদান করেছেন, যা মাইলফলক ও ইতিবাচক দৃষ্টান্ত। তারপরেও সকল সীমাবদ্ধতার মাঝে নানা অপ্রতুল কার্যাদি রয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও ডাক্তারদের অবহেলা বা হাসপাতালগুলো রোগী ভর্তিতে অনীহা প্রকাশ উদ্বেগকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে সাধ্যমত চেষ্টা চললেও বাস্তব সত্য হচ্ছে করোনা চিকিৎসা আমাদের দেশে এখনো আশাপ্রদ নয়। প্রতিদিন গণমাধ্যমে করোনা রোগীর হয়রানির খবর আমরা প্রত্যক্ষ করি। আর এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ প্রতিনিয়ত আছেই এবং হাসপাতালগুলোর অব্যবস্থাপনার খবরও ফলাও করে প্রকাশিত হতে আমরা দেখি। আমরা এসব চিত্র দেখতে চাই না। প্রতিটি আক্রান্ত ব্যক্তি যেন চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত না হন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে ও এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিভাগকে যথেষ্ট উদ্যোগী হয়ে নানান কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এই পেশায় জড়িত চিকিৎসকগণ আরও দায়িত্বশীল আচরণ করে মমত্ববোধের পরিচয় দেবেন এবং করোনা আক্রান্ত প্রত্যেক মানুষের চিকিৎসা যেন নিশ্চিত হয় আর এই ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো প্রাণ যেন খসে না পড়ে সেদিকে নিশ্চিত নজর রাখতে হবে এবং নাগরিকদেরও উচিত হবে যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি (বাপউস)।



ফেইসবুকে আমরা