বাংলাদেশ, , রোববার, ৫ মে ২০২৪

একটি স্বাধীন দেশের ইতিহাসের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন

  প্রকাশ : ২০১৯-১২-০৪ ২০:৫৩:৫৮  

একটি স্বাধীন দেশের ইতিহাসের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
                                                       …ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন

পরিস্হিতি২৪ডটকম : হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শুধু একটি নাম নয়, একটি আদর্শের প্রতীক, নেতৃত্বের প্রতীক, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের প্রতীক, ত্যাগ আর দেশের প্রেমের প্রতীক।’ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের স্রষ্টা ও দ্রষ্টা। পৃথিবীতে প্রত্যেক জাতি, দেশ কিংবা সম্প্রদায়ের মধ্যে মহামানবের আবির্ভাব ঘটেছে। সেসব মহামানব ওই জাতি, দেশ কিংবা সম্প্রদায়ের মুক্তির জন্য নিয়ে আসেন মহান বার্তা। পৃথিবীতে এসব মহান ব্যক্তির জন্ম হয় শত বছর, হাজার বছর কিংবা আরও বেশি সময়ের ব্যবধানে এবং এদের সংখ্যা খুবই কম। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তি ও কাব্য এই লাল-সবুজের স্বাধীন বাংলাদেশ। জাতিরাষ্ট্রের স্রষ্টা হিসেবে তার কৃতিত্ব বিশ্বে নজিরবিহীন। ‘বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে এই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হতো না।’ কেননা তিনিই এ বাঙালি জাতির জন্য বিশ্বের মানচিত্র বদল করে দিয়ে গেছেন। নতুন মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস পরিক্রমায় এ মহামানব এসেছিলেন বিশ্বের বুকে বাঙালি জাতির ঠিকানা নিশ্চিত করতে। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাঙালি জাতির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর জন্ম সর্বোৎকৃষ্ট জন্ম, যে জন্ম না হলে আমাদের স্বাধীনতার জন্ম হতো না। ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এ বিশাল ভূখণ্ড তাই সবসময় তার শূন্যতা অনুভব করে। প্রতিটি বাঙালির হৃদয়মন্দিরে তার স্থান অব্যয়, অক্ষয়, অম্লান। এ বাংলা নামের ভূখণ্ডের নামকরণ করেন তিনি বাংলাদেশ। গোপালগঞ্জ জেলার মধুমতি নদীর তীরবর্তী টুঙ্গিপাড়া গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে শেখ লুৎফুর রহমান ও সাহেরা খাতুনের ঘর আলোকিত করে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ (বাংলা ২০ চৈত্র ১৩৫৯) শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব কেটেছে গ্রামের অন্য দশটি সাধারণ ছেলের মতো হেসে-খেলে দুরন্তপনায়। শেখ মুজিব প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন গিমাডাঙ্গা টুঙ্গিপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। অতঃপর গোপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুল থেকে ১৯৪২ সালে তিনি মেট্রিক পরীায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯৪৪ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে আইএ (এইচএসসি) এবং ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসে বিএ পাস করেন। সে বছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করায় তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে। উল্লেখ্য ৬১ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবুর রহমানের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় ১৪ আগস্ট, ২০১০ সালে। অল্পবয়স থেকেই তাঁর রাজনৈতিক প্রতিভার প্রকাশ ঘটতে থাকে। ১৯৪০ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। কট্টরপন্থী এই সংগঠন ছেড়ে ১৯৪৩ সালে যোগ দেন উদারপন্থী ও প্রগতিশীল সংগঠন বেঙ্গল মুসলিম লীগে। এখানেই সান্নিধ্যে আসেন হুসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে রক্ষণশীল কট্টরপন্থী নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কর্তৃত্ব খর্ব করতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ। ভাষা আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিব।

১৯৪৮ সালে ভাষার প্রশ্নে তাঁর নেতৃত্বেই প্রথম প্রতিবাদ এবং ছাত্র ধর্মঘট শুরু হয় যা চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে। পঞ্চাশের দশক তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের কাল। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠেন দূরদর্শীতা এবং প্রজ্ঞাসম্পন্ন এক কুশলী রাজনৈতিক নেতা। এসময় শেখ মুজিব মুসলিম লীগ ছেড়ে দেন এবং হোসেন সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা ভাসানীর সাথে মিলে গঠন করেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। তিনি দলের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ জাতির কল্যাণে চিন্তামগ্ন থাকতেন। ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৯ শহিদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুদিবসে তিনি তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের নামকরণ করেন “বাংলাদেশ” নামে। যা তাকে পিতার ভূমিকায় নিয়ে যায়। তাই পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ঢাকসু’র ভিপি আসম আব্দুর রব বঙ্গবন্ধু শেখ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির জনক’ উপাধি দেন। ৭ই মার্চ, বাঙালি জাতির নতুন দিগন্তের সূচনার এক ঐতিহাসিক দিন। এ দিন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির ভবিষ্যৎ দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি বলেন- “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। তবু এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” ৭ই মার্চের ভাষণ থেকেই আঁচ করা যায় যে তিনি আগাম যুদ্ধ প্রস্তুতির নির্দেশনা দিয়েছেন। ২৫ মার্চ রাত্রে গ্রেফতারের পূর্বমুহূর্তে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, This is my last message to you. From today Bangladesh is independent. তার ডাকে সমগ্র বাঙালি মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভায় সমবায়, কৃষি ও বন বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালের প্রাদেশিক মন্ত্রীসভায় শিল্প, শ্রম ও দুর্নীতি দমন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তিনি পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত হন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান মতা না ছাড়তে চাইলে এর পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে তিনি প্রধানমন্ত্রীত্বও গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু সরকার পরিচালনার সময় পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে ৩ বছর। স্বাধীনতা লাভের পরই খুব দ্রুততম সময়ে তিনি রাষ্ট্রের জন্য যুগোপযোগী একটি অত্যাধুনিক সংবিধান প্রণয়নে সম হন, যা বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে। সাড়ে ৩ বছরে তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি করে দিয়ে গেছেন; বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির পথনির্দেশ করে গেছেন তিনি। এ সময়ের মধ্যে তিনি বাংলাদেশের জন্য চীন ও সৌদি আরব ছাড়া বিশ্বের অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি আদায়ে সম হন। এ স্বল্প সময়ে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মানুষের মুখে দুই বেলা ভাত তুলে দেয়ার জন্য যা যা করণীয় তার প্রায় সবই করে গেছেন। সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর সাড়ে ৩ বছর ছিল আদর্শ স্বর্ণযুগ; সোনার বাংলার গোড়াপত্তনের যুগ। এ সাড়ে ৩ বছরে তিনি কৃষি, খাদ্য, শিল্প, ব্যাংক, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাণিজ্য, দারিদ্র্য দূরীকরণসহ প্রায় সব বিষয়ে অসামান্য অবদান রেখেছেন, যা রীতিমতো গবেষণার দাবি রাখে। তৎকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধুর গৃহীত পদপেগুলো আজও সমুজ্জ্বল। মাত্র সাড়ে ৩ বছরে রাষ্ট্রীয় পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের কাঠামো, রূপরেখা দান, বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু এসবও নজিরবিহীন ঘটনা। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং এর একটি সফল আর্থসামাজিক চরিত্রদানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরলস সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও কৃতিত্ব অবিস্মরণীয়। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলাদেশ হবে একটি আধুনিক রাষ্ট্র, যেখানে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না, রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা করার ক্ষেত্রে ধর্ম কোনো মুখ্য বিষয় বা ভূমিকা পালন করবে না। তিনি মনে করতেন, ধর্ম হবে জনগণের অন্তরের ব্যক্তিগত বিষয়, আর তিনি নিজেও সেটা মানতেন। বঙ্গবন্ধুর যে বিশাল স্বপ্ন ছিল এই বাংলাদেশকে ঘিরে, তা বিশাল ধাক্কা খায় সপরিবারে তাকে নির্মম, নির্দয়, অমানবিক, জঘন্য ও নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে। থমকে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। এরপর দীর্ঘ ২১ বছর পর তারই সুযোগ্য জ্যেষ্ঠ কন্যা দেশগর্ব প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব নেন বাংলাদেশের; সুযোগ পান বাংলার দুঃখী মানুষের জন্য কিছু করার। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথ ধরে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে সফল ও সঠিকভাবে পরিচালনা করছেন। বর্তমানসহ মোট তিনবার জননেত্রী শেখ হাসিনা মতায় থাকার কারণে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা এগিয়ে যাচ্ছে কাঙ্খিত লক্ষ্যের দিকে। শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের গুণে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের উন্নয়নের রোল মডেল। গতিশীল ও যুগোপযোগী নেতৃত্বের কারণে শেখ হাসিনা এক অনন্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও মুক্তির মূর্ত প্রতীক শেখ হাসিনা এ জাতির জন্য আশীর্বাদ। শেখ হাসিনা যদি ক্ষমতায় না আসতেন, তাহলে হয়তো কোনোদিনই সম্ভব হতো না বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ সম্পন্ন করা এবং রায় কার্যকর করা। শেখ হাসিনার সব কৃতিত্বই যদি বাদ দিই, তবু শুধু বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কারণে ইতিহাসে তার স্থান চিরঅম্লান। দেশি-বিদেশি সব বাধা অতিক্রম করে এ দুইটি মহান কাজের জন্য তিনি বাঙালি জাতির হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। আর এ দুইটি কাজই হলো শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় অর্জন। বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতায় দেশ এগিয়ে চলছে দুর্বার গতিতে। আর জাতিরজনকের স্মৃতি অম্লান করতে আগামী ২০২০ সালকে মুজিব বর্ষ পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার, যা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এ বছরে ৮ ডিসেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে মুজিব বর্ষ গণনা। এই মুজিব বর্ষ উদযাপনের মধ্যে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণে মাধ্যমে জাতির কাছে বর্ণাঢ্য ইতিহাস হয়ে থাকবে ইতিহাসের এই কিংবদন্তি নেতা।

লেখক: কলামিষ্ট, প্রাবন্ধিক ও কেন্দ্রীয় মহাসচিব, বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি।



ফেইসবুকে আমরা