পরিস্হিতি২৪ডটকম : সুস্থসবল জাতি গঠন ও জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত পুষ্টিকর খাবারের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই সুস্থ জাতি এবং কর্মক্ষম জনশক্তি গড়ে তুলতে ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ রাখতে নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্য ভেজাল এমন পর্যায়ে দাড়িয়েছে যে, কোন সচেতন মানুষের পক্ষে খাদ্য স্বস্তির সঙ্গে খাওয়া দুস্কর হয়ে পড়েছে। আর খাদ্যে ভেজালের রাহু থেকে কিছুতেই মুক্তি মিলছে না আমাদের। ফলমূল যাই খাই না কেন, মনে হয় বিষ খাচ্ছি না তো? আর মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সারাদেশে-ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের নানা পণ্যে ছেয়ে গেছে। শিশুর গুড়ো দুধ থেকে বৃদ্ধের ইনসুলিন, রুপচর্চার কসমেটিক থেকে শক্তি বর্ধক ভিটামিন, এমন কি বেঁচে থাকার জন্য যা অপরিহার্য-সেই পানি এবং জীবন রাকারী ওষুধ পর্যন্ত এখন ভেজালে ভরপুর। মাছ, দুধ, শাক সবজি ও ফলমূলে ফরমালিন, হলুদে সিসা, মরিচে ইটের গুঁড়া, সরষের তেলে কেমিক্যাল, মশার কয়েলে বিপদজনক উপাদান, গরুর গোশতে হরমোন, মরগির খাবারে বিষাক্ত উপকরণ। টোকাই থেকে ধনীর সন্তান, ভেজালের ভয়াবহতা থেকে নিরাপদ নয় কেউ -যেন ভেজালেই জন্ম, ভেজালেই বেড়ে ওঠা, ভেজালের রাজ্যেই বসবাস।
এতে উদ্বিগ্ন সাধারণ জনগণ। কারণ সাধারণ জনগণই ভোক্তা। আর এই ভোক্তাদের টার্গেট করেই উৎপাদনকারীরা বাজারজাত ও বাজার সম্প্রসারণ করে। আমাদের দেশে খাদ্যে ভেজাল, খাদ্যে বিষক্রিয়ার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি এর ব্যাপ্তি যে হারে বাড়ছে তাতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ। দেশি-আন্তর্জাতিক সব গবেষণায় দেশে খাবারের বিষয়ক্রিয়ার বিষয়টি বারবার উঠে আসছে। ফুটপাথ থেকে শুরু করে অভিজাত হোটেল রেস্টুরেন্ট বা নামিদামী ব্রান্ডের পণ্যও এখন ভেজালমুক্ত নয়। বাজার, দোকান, সুপার শপ কোথাও ভেজালমুক্ত খাদ্যপণ্য মিলছে না। মাছেও ফরমালিন, দুধেও ফরমালিন। মৌসুমী ফলমূল গুলোতে দেওয়া হচ্ছে কার্বাইডসহ নানা বিষাক্ত কেমিক্যাল। শাক-সবজিতে রাসায়নিক কীটনাশক, জিলাপি-চানাচুরে মবিল। ব্রেড, বিস্কুট, সেমাই, নুডলসসহ সব রকম মিষ্টিতে টেক্সটাইল-লেদারের রং। আর মুড়িতে ইউরিয়া-হাইড্রোজেনের অবাধ ব্যবহার চলছে। শিশুখাদ্য দুধও ভেজালমুক্ত রাখা যাচ্ছে না। অতিরিক্ত রেডিয়েশনযুক্ত গুঁড়া দুধ আমদানি হচ্ছে দেদারছে। ছানার পরিত্যক্ত পানির সঙ্গে ভাতের মাড়, এরাররুট আর কেমিক্যাল মিশিয়ে প্রস্তুতকৃত সাদা তরল পদার্থকে ‘গাভীর দুধ’ বলে সরবরাহ করা হচ্ছে। নোংরা পানি ব্যবহার করে আইসক্রিম বানানো হচ্ছে ময়লা-আবর্জনার স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে। ভাবলেই আতংকিত হতে হবে। এতকিছুর পরেও খাদ্যপণ্যে ভেজাল মেশানোটা রীতিমতো অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। চাল, আটা, লবণ, চিনি, ভোজ্যতেল, আলু থেকে শুরু করে রুটি, কেক, মিষ্টি, বিস্কুট কিছুই ভেজালের ছোবল থেকে বাদ যাচ্ছে না। জীবনধারণের জন্য সবচেয়ে জরুরি পানি পর্যন্ত নিরাপদ থাকছে না। যত্রতত্র নকল কারখানা বানিয়ে পুকুর-ডোবা এবং ওয়াসার পানি সরাসরি গামছায় ছেঁকে বোতলজাত করা হচ্ছে। সে পানিতে থাকছে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম-লেড-ইকোলাই। অথচ এগুলোই ‘বিশুদ্ধ মিনারেল পানি’ হিসেবে নামিদামি কোম্পানির সিলমোহরে সরবরাহ হচ্ছে। কলা, আম, পেঁপে, পেয়ারা, আনারস থেকে শুরু করে আপেল, আঙ্গুর, নাশপাতিসহ দেশি-বিদেশি প্রায় সব ফলেই মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল। অপরিপক্ব ফল পাকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ও তা উজ্জ্বল বর্ণে রূপান্তরের জন্য অধিক ক্ষারজাতীয় টেক্সটাইল রং ব্যবহার হচ্ছে অবাধে। উদ্বেগের বিষয় সারাদেশ আজ ভেজালে সয়লাভ, এক শ্রেনীর ব্যবসায়ী ও তাদের একটি চক্র রাতারাতি প্রচুর অর্থ বিত্তের মালিক হওয়ার জন্য জনগনকে জিম্মি করে ভেজালের রাজত্ব কায়েম করছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে ভেজাল খাদ্য গ্রহনের ফলে মানুষ নানান রোগব্যাধীর শিকার হচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে জটিল ও কঠিন রোগে। আমাশয়, অ্যাপেন্ডিক্স, রক্তচাপ, ক্যান্সার, হৃদরোগ সহ নানাবিধ জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। সাধারণত ভেজাল যুক্ত খাদ্য খাইয়ে মানুষকে মৃত্যুর ঝুকিতে ফেলা এবং খুন করা উভয়ে আইনের চোখে সমান অপরাধী। কিন্তু দিনদিন নকল ও ভেজালের মাত্রা যেভাবে বেড়েই চলেছে আইনের দুর্বলতার কারনে তা রোধ করা যাচ্ছে না। খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার বিক্রীকরে ব্যবসায়ীরা যে পরিমান মুনাফা করে সে তুলনায় ভেজাল বিরোধী অভিযানের জরিমানা অত্যন্ত নগন্য বলে মনে করেন ক্রেতা ও ভোক্তাগন। যে কারনে ভেজাল খাদ্য/পন্য উৎপাদন ও বিক্রেতারা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে অনবরত তারা ভেজাল খাদ্য/পন্য উৎপাদন ও বিক্রী করছে। এসব খাবার খেয়ে সাধারণ মানুষ নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। মহাখালী পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউটের খাদ্য পরীাগারের তথ্যানুযায়ী, দেশের ৫৪ ভাগ খাদ্যপণ্য ভেজাল ও দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত হয়। সারা দেশ থেকে স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের পাঠানো খাদ্যদ্রব্যাদি পরীক্ষাকালে এ তথ্য বেরিয়ে আসে। বেসরকারী এক গবেষণায় বলেছেন, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩ লক্ষ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা দেড় লাখ, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ । এ ছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এই পরিসংখ্যানটি আমাদের ভাবিয়ে না তুলে পারেনা। এত কিছুর পরেও দেশে নিরাপদ খাদ্য, ভোক্তা অধিকারসহ জনস্বার্থে অনেক আইন ও বিধি-বিধান এবং কর্তৃপ থাকলেও আইন প্রয়োগ সবসময় যথাযথভাবে হয় না। আইন প্রয়োগে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে প্রয়োগের মাত্রাগুলোও রং বদলায়। সে কারণে আইন না মানার সংস্কৃতি ক্রমশ বাড়ছে। সরকারদলীয় সংশ্লিষ্টতা, প্রভাবশালী ও বড় ব্যবসায়ীদের েেত্র আইন প্রয়োগে শিথিলতার কারণে আইনের প্রয়োগ বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আবার সরকারের বিভিন্ন দফতর ও বিভাগের সঙ্গে কার্যকর আন্তঃসমন্বয় না হওয়ার কারণেও আইনের প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ১৯৭৪ সালের বিশেষ মতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেয়া এবং ভেজাল খাদ্য বিক্রির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া ১৪ বছরের কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা প্রয়োগ করার কোনো নজির নেই। আশার বিষয় বর্তমানে চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে নিয়মিত বাজার তদারকি ও ভেজাল বিরোধী অভিযান চলমান আছে এবং কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানকে ভেজালের দায়ে জরিমানা করা হচ্ছে ও কিছু দোকান সিলগালা করা হচ্ছে। এই অভিযানের কিছুটা সুফল ভোগ করছে সাধারণ ক্রেতা তথা জনসাধারণ। আমরা আশা করব, রোজার পরেও ভেজালবিরোধী অভিযান কঠোর থাকবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। ভেজাল পণ্য ও অসাধু ব্যবসায়ীদের ঠেকাতে এই ধরনের অভিযান নিয়মিত থাকলে ভেজালকারীদের দৌরাত্ম্যে অনেকাংশে কমে আসবে বলে আশা করা যায়। তবে ভেজাল ঠেকাতে সচেতনতার বিকল্প নেই। আইন দিয়ে ভেজাল ঠেকানো সম্ভব নয়। এ জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। খাদ্যে নকল ও ভেজাল বন্ধে সরকারী উদ্যোগ যতেষ্ট নয়। এই জন্য দরকার সামাজিক সচেতনতা। প্রতিটি পাড়া মহল্লায় খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। শিা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো এই ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। অতএব, ভেজালের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু আইন করে সবকিছু হবে না। মানুষের জীবন নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলছে তারা দেশ ও জাতির শত্রু। খাদ্যে ভেজালকারীদের সামাজিকভাবে চিহ্নিত করে কঠোর সাজার ব্যবস্থা করতে হবে। ভেজাল বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকার আরও নতুন নতুন পদক্ষেপ নিবে এটি আমরা দেখতে চাই। আসুন দল মত নির্বিশেষে সম্মিলিতভাবে স্ব স্ব অবস্থান থেকে ভেজাল উৎপাদন ও বিক্রেতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ভেজাল নামক দানবটিকে চিরতরে উৎখাত করে ভেজালমুক্ত স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলি। এটাই হোক আমাদের আগামী দিনের অঙ্গীকার।
লেখক: কলামিষ্ট ও প্রাবন্ধিক।
সভাপতি, বৃহত্তর চট্টগ্রাম ডেন্টাল এসোসিয়েশন