বাংলাদেশ, , শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

বাল্যবিবাহ বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে : ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন

  প্রকাশ : ২০১৯-০৯-১৯ ১৯:০৫:২৮  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : বিবাহ সামাজিক বন্ধনের স্বীকৃতি, কিন্তু বাল্যবিবাহ আইনত অপরাধ। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ একটা মারাত্মক সমস্যা। অশিক্ষা, দারিদ্র, নিরাপত্তাহীনতা ও সামাজিক নানান কুসংস্কারের কারণে আইনের তোয়াক্কা না করে বাল্যবিবাহ হয়ে আসছে। মূলত বাল্যবিবাহ হল অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির আনুষ্ঠানিক অথবা অনানুষ্ঠানিক বিবাহ। আইনত এই বিয়ের বয়স সর্বনিম্নভাবে নির্ধারিত ১৮ বৎসর, বিশেষত মেয়েদের ক্ষেত্রে এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে বিবাহের বয়স নুন্যতম ২১ বৎসর। কিন্তু বিশেষ ক্ষেত্রে অভিবাবকের অনুমতি সাপেে এই বয়সের আগেও বিয়ের অনুমতি দেয়া হয়। যদিও আইন অনুযায়ী বিয়ের বয়স ১৮ বৎসর, তারপরও কিছু কিছু দেশের নিজস্ব প্রথাকেই আইনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। বাল্যবিবাহে মেয়ে এবং ছেলে উভয়ের উপরই প্রভাব পড়ে। বাল্যবিবাহ বলতে বুঝায় যখন সম্পর্ক স্থাপনকারী পদ্বয়ের যে কোন একজন শিশু। সূনির্দিষ্ট ভাবে “১৮ বছরের নিচে যে কোন বিয়েই বাল্যবিবাহ” ১৮ বছরের কোন মেয়ে বিয়ের দায়দায়িত্ব ও সন্তান ধারণের জন্য শারিরীক, জৈবিক ও মানসিক ভাবে সক্ষম হয় না। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বাল্য বিবাহের হার বিশ্ব দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। যেখানে শতকরা ৫২ ভাগ মেয়ে শিশুর বিবাহ হয় ১৮ বছরের মধ্যে, শতকরা ১৮ ভাগ মেয়ে শিশুর বিয়ে হয় ১৫ বছরের মধ্যে। মূলত বাল্যবিবাহ হলো নারী ও কিশোরী মেয়েদের অধিকার লংঘন। বাংলাদেশে প্রতি দুইজনে একজন কিশোরী মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। বিয়ের পরই নববধূর কাছে সমাজ একটা সন্তান প্রত্যাশা করে, যেটা অল্প- বয়ষ্ক মেয়েদের অকাল গর্ভধারনের দিকে ঠেলে দেয়। এটি তাদের যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ন। এ ছাড়া খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে গেলে একটা মেয়ে লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত হয়। এর ফলে দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থার উপর ও বিরুপ প্রভাব পড়ে। প্রায় ০২ জনের মধ্যে ০১ জন মেয়ে শিশুর ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়। দক্ষিণ এশিয়ার শিশু বিবাহের ঘটনা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে শিশু বিবাহের হার সর্বোচ্চ বেশী (৫২%), একই ভাবে ভারতে (৪৭%), নেপালে (৩৭%) এবং আফগানিস্থানে (৩৩%) এই ভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে ১৩০ মিলিয়ন মেয়ে শিশুর বিয়ে হয়ে যাবে। বিভিন্ন কারণে বাল্যবিবাহ সংগটিত হয়ে থাকে। তৎমধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ সমূহ হল- ১. আর্থিক নিরাপত্তার জন্য। ২. একজন ভালো বরকে হাত ছাড়া করতে না চাওয়া। ৩. ভ্রান্ত জন্ম নিবন্ধন সনদের সহজ প্রাপ্যতা। ৪. অবৈধ বাল্য বিবাহ বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ব্যাপক ভাবে না থাকা। ৫. কন্যা শিশুর বিদ্যালয়ে না যাওয়া কিংবা বিয়ে দেওয়ার জন্য সামাজিক চাপ। ৬. যৌন হয়রানি এবং নির্যাতন থেকে কন্যা শিশুকে রা করা। ৭. কন্যা শিশু যখন দেখতে বড় লাগে বা শারিরীক ভাবে বড় দেখায় তখন বিয়ের জন্য চাপ বেড়ে যাওয়া। ৮. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দ্বারা প্রভাবিত হওয়া। বাংলাদেশে মেয়েদের বিয়ের আইনগত বয়স ১৮ বছর, কিন্ত বিয়ের একটা বড় অংশই সম্পন্ন হয় মেয়েদের আইনগত বয়স ১৮ বছরের পূর্বেই। এক বেসরকারী জরিপ অনুযায়ী ২০-২৪ বছরের বিবাহিত নারীদের শতকরা ৫৯ জনের বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের পূর্বেই। বাল্যবিবাহের ফলে মৃত্যু ঝুকি সহ নানান ঝুকি থাকে। যা চাপ পড়ে সামাজিক ও সমাজ ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর। আর এই বাল্যবিবাহের শেষ পরিণতি হয় ভয়াবহ। কেননা নারী শিক্ষার অগ্রগতি ব্যহত হওয়া ছাড়াও বাল্যবিবাহের কারণে মাতৃমৃত্যুর ঝুকি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রাথমিক ভাবে, অল্প বয়সে বিবাহিত মেয়েরা গর্ভবতী হওয়ার জন্য জোড়ালো চাপের সম্মুখীন হয়। যেমন- বাংলাদেশে ১৫-১৯ বছরের বিবাহিত কিশোরীদের মধ্যে প্রায় তিন ভাগই সন্তানের মা অথবা গর্ভবতী। অল্প বয়সে গর্ভধারন মারাত্বক স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসাবে চিহ্নত। প্রথমত, অপরিণত মা যারা পরিণত পর্যায়ে আছে, তাদের ক্ষেত্রে মাতৃমৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশী। সন্তান জন্মদানের সময় অল্প বয়সের মায়েদের মৃত্যুর হার পরিনত বয়সের মায়েদের দ্বিগুণ। দ্বিতীয়ত, ১৪ বছরের নীচের মায়েদের শিশু মৃত্যুর হার, ২০ বছরের অধিক বয়সের মায়েদের শিশু মৃত্যুর চেয়ে ৫০% বেশী। বাল্য বিবাহ একটি সামাজিক অন্যায় একে প্রতিহত করে এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরী। মা হতে গিয়ে প্রতি ২০ মিনিটে একজন মা মারা যাচ্ছেন৷ অন্যদিকে প্রতি ঘন্টায় মারা যাচ্ছে একজন নবজাতক। নবজাতক বেঁচে থাকলেও অনেক সময় তাকে নানা শারীরিক ও মানষিক জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়৷ অপ্রাপ্তবয়স্ক মা প্রতিবন্ধী শিশু জন্মদান করতে পারে৷ এছাড়া এতে গর্ভপাতের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়৷ বাল্য বিবাহের ফলে বিবাহ বিচ্ছেদের আশংকা তৈরী হওয়া ছাড়াও নানা পারিবারিক অশান্তি দেখা দেয়৷ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে উল্লেখিত পদপে গুলো ভূমিকা রাখতে পারে যেমন- বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনটি বাস্তবায়নে ব্যাপক প্রচার/প্রচারনা করা প্রয়োজন৷ রেডিও, টেলিভিশনে ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে বাল্য বিবাহের কুফল সম্পর্কে জনগনকে সচেতন করা যেতে পারে৷ গ্রাম পর্যায়ে উঠান বৈঠক ও মা সমাবেশ এ ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হবে৷ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজনে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎনিক বিবাহ বন্ধ সহ মামলা রজ্জু করা যেতে পারে৷ অনলাইন জন্ম নিবন্ধন সনদ ব্যতীত এবং জন্মসনদ সঠিকভাবে যাচাই বাচাই না করে কোন অবস্থায় নিকাহ রেজিষ্টার যেন বিবাহ নিবন্ধন না করেন, সেরূপ আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে৷ প্রতিটি ইউনিয়নে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা যেতে পারে৷ নবম ও দশম শ্রেনীর পাঠ্য বইতে এ বিষয়টি অর্ন্তভুক্ত করা হলে এর সুফল পাওয়া যাবে৷ জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে বেসরকারী সংস্থাগুলো ও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে৷ শেষ কথা সরকারের দিন বদলের অঙ্গীকার রয়েছে ২০২১ সালের মধ্যে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৫৪ থেকে কমিয়ে ১৫ করা হবে এবং মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৩.৮ থেকে কমিয়ে ১.৫ করা হবে৷ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা না গেলে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না। বাল্য বিবাহ সংকুচিত করে দেয় কন্যা শিশুর পৃথিবী। আমরা যদি সবাই সচেতন হই তাহলে কন্যা শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে৷ দেশে মা ও শিশুর অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে। তাই বাল্য বিবাহ বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷ এখন থেকেই।

লেখক :প্রাবন্ধিক, কলামিষ্ট ও কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক,

বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি (বাপউস)।



ফেইসবুকে আমরা