বাংলাদেশ, , শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

তারুণ্যের অবক্ষয়ে সামাজিক বিপর্যয় : ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন

  প্রকাশ : ২০২০-০২-১৭ ১৯:২৮:৩৭  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : তরুণরাই জাতির ভবিষ্যৎ। আর একটি সমাজ, রাষ্ট্রকে অনাদিকাল ধরে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বড় সম্পদ হল তরুণ প্রজন্ম। একারণে যুগে যুগে কালের বিবর্তনে কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা তরুণ প্রজন্মের জয়গান গেয়েছেন সর্বদা। এই তরুণ প্রজন্মের বেড়ে ওঠা ও প্রাপ্ত শিক্ষার ওপর সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা নির্ভর করে। তাই তরুণ প্রজন্ম এবং তার ভবিষ্যৎ ও নীতি-নৈতিকতা নিয়ে বর্তমান প্রজন্মকেই ভাবতে হবে। বুঝতে হবে, চলমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে তরুণ প্রজন্ম নিজে নিজে বেড়ে উঠবে বিষয়টা এমন নয়। সুষ্ঠু ও সুপরিকল্পিত পরিকল্পনার মাধ্যমে তাদের গড়ে তুলতে হয়। সে জন্যে প্রয়োজন হয় যত্ন ও পরিচর্যার। বিগত কয়েক দশক ধরে সেই যত্ন ও পরিচর্যার অভাবেই সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক অবক্ষয়, নতুন প্রজন্ম ধাবিত হচ্ছে অধঃপতনের দিকে। তাই আমরা যদি এখন থেকেই সচেতন না হই, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না গ্রহণ করি তাহলে তরুণ প্রজন্মের ধ্বংস অনিবার্য। যা সমগ্র জাতির জন্য এক মহা সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কেননা মানুষ সামাজিক জীব। ব্যক্তির যেমন চাহিদা আছে, তেমনি সমাজেরও চাহিদা আছে। সমাজ মানুষ থেকে সব সময় সামাজিক আচরণ প্রত্যাশা করে। সমাজপ্রত্যাশিত আচরণ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য একান্ত কাম্য। বর্তমানে বিশ্বসভ্যতা থেমে নেই। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্প ও প্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্বসভ্যতা। আধুনিক সভ্যতার দৌড়ে হারিয়ে যাচ্ছে প্রচলিত নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। ক্রমশই বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। নষ্ট হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা এবং ছিন্ন হচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক। অস্থির হয়ে উঠছে সমগ্র সমাজব্যবস্থা। দেশে চলছে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম দুর্ভিক্ষ। মূলত অবক্ষয় শব্দের আভিধানিক অর্থ ক্ষয়প্রাপ্তি। সামাজিক মূল্যবোধ তথা সততা, উদারতা, সৌজন্যবোধ, শিষ্টাচার, নিয়মানুবর্তিতা, কল্যাণবোধ, নান্দনিক সৃজনশীলতা ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলী লোপ পাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলে সামাজিক অবক্ষয়। আর এই অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব, অসহিষ্ণুতা ও সর্বগ্রাসী অশ্লীলতার মতো আরো কিছু বিষয়। বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে একে অপরের মাঝে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব প্রকট। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তা লক্ষ্য করা যায়। অতীতের সুসমৃদ্ধ তরুণ প্রজন্মের ইতিহাসকে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের ইতিহাসের সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে পরিবার, সমাজ, দেশ সর্বোপরি বিশ্ববিবেককে হতাশ হতে হয়। কেননা তরুণকে দেখে যেখানে মানুষের আশায় বুক বাধাঁর কথা সেখানে মানুষ বর্তমান তরুণ প্রজন্মের দানবীয় রূপ দেখে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে ঘরমুখো নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করছে। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম মানে একপ্রকার মূর্তিমান দানব। বর্তমানে মানবিক চিন্তা ও মানবিকতা তরুণ প্রজন্ম থেকে বিদায় নিয়েছে। মাদকাসক্ত এ তরুণ প্রজন্ম তাদের নেশার পণ্য যোগাড় করতে এমন কোন কাজ নেই তারা করছে না। সে ক্ষেত্রে তারা তাদের মানবীয় রূপকে বিসর্জন দিয়ে দানবীয় রূপকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ফলে তারা ছিনতাই, অপহরণ ও ভাড়টিয়া হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। সে পেশায় নিজেকে একজন পরিণত ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় দিতে সুশীল পোষাক পরিচ্ছদের বিপরীতে অশালীন ও অরুচিকর পোষাক, চুলের ডিজাইন করছে যা যেকোনো সভ্য সমাজের ভাবনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তার অরুচিকর বৈশিষ্ট্য বাস্তবায়নের আগেই তার বাহ্যিক রূপ বলে দেয় সে কত ভয়ংকর। এমনি ভয়ংকররূপে রাস্তার ধারে দাড়িয়ে মহিলাদের উত্যক্ত করা, মোবাইল টান দেওয়া, ছিনতাই, জনসংকীর্ণ এলাকায় নারী নির্যাতন, কোচিং সেন্টারে জোরপূর্বক নারী নিপীড়ন ইত্যাদী সাবলীল ও ভয়হীনভাবে করে যাচ্ছে। ফলে ধীরে ধীরে তার কাছ থেকে মানবতাবোধের বিলুপ্তি ঘটছে এবং বিকৃত মানবিক গুণাবলীর চর্চার প্রতি ধাবিত হচ্ছে। এ সময়ে একটি শঙ্কা হল বর্তমান সমাজের তরুণ তরুণীদের লাগামহীন বিপথগামীতার দিকে ধাবিত হওয়ার যে দৌড় শুরু হয়েছে তা অতিদ্রুত প্রতিরোধ করা না গেলে আগামী ১০ বৎসরের মধ্যে সভ্য সমাজের দাবি নিয়ে বসবাস করা যাবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন অভিভাবক, উদ্বিগ্ন শিক্ষকসমাজ, উদ্বিগ্ন পুরোসমাজ। মনোবিজ্ঞানের দাবি অনুযায়ী ১১-২০ বৎসরের এ সময়কালকে ঝড় ঝাঞ্চার সময়কাল বলা হয়। এ সময়ে সন্তান পিতামাতা ও শিক্ষকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও পরিচর্যায় থাকার কথা সেখানে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের পরিবারের প্রতি অবাধ্যতা ও আনুগত্য হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি পড়ালেখার প্রতি অমনোযোগিতা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই তরুণ প্রজন্ম লক্ষ্যহীন গন্তব্যে স্বাধীনমনে খোলা আকাশে মুক্ত পাখির ন্যায় বিচরণকে গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। তরুণ শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেটে, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটস এ্যাপ, ইমু, ইনস্টগ্রাম, ফেসবুক এগুলোর মধ্যে বিচরণকে গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। ফলে পড়ালেখার প্রতি নিস্ক্রীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফেসবুকের কল্যাণে শিক্ষির্থীরা, অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ হয়ে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার বিষয়ে চিন্তা করার ক্ষেত্রে উদাসীন। অনেক তরুণ পরীক্ষায় পাশ করে যাচ্ছে, কিন্তু সুশিক্ষিত তরুণ মেধাবী প্রজন্ম বের হয়ে আসছে না। আমাদের সমাজের একটা শ্রেণি আদর্শ ও নৈতিকতা বিবর্র্জিত উন্মাদনাকে তারুণ্যের জয়গান বলে চালাতে চান। কিন্তু আজকের এ পরিস্থিতিতে তাকে তারুণ্যের জয়গান বলা হবে নাকি নিছক বিপথগামিতা বলা হবে তা ভেবে দেখা দরকার। আমাদের সমাজটা যদি একটা নদী হয়, তাহলে তরুণ প্রজন্ম সেই নদীর স্রোত। তাদেরকে যে দিকে পথ করে দেওয়া হবে সেদিকেই তাঁরা প্রবাহিত হবে। সমাজ, দেশ ও পরিবারের সঙ্গে তারুণ্যের বৈরী সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে দিন দিন। দূরত্ব তৈরি হচ্ছে আকাশ-পাতাল। সমাজের আশা-আকাক্সা আর সুন্দর স্বপ্নের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে তারুণ্য। তারুণ্যের এ অধঃপতনের জন্য সবকিছুর ওপর দায়ী আমাদের অসুস্থ রাজনীতি। যে রাজনীতি তারুণ্যের হাতে বই আর কলমের বদলে অস্ত্র তুলে দিয়েছে, সে অস্ত্র দিয়ে প্রতিপকে হত্যা করছে, নিজেরা নিজেরা খুনোখুনি করছে। টেন্ডারে কাজ পেতে গোলাগুলি করছে। দখল করতে মানুষ হত্যা করছে। আদর্শহীন দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি তারুণ্যের স্বপ্নকে ছোবল মেরে বিবর্ণ করে দিচ্ছে। সমাজকে তবিত করছে। আমরা সবাই সাক্ষীগোপাল হয়ে সেসব দেখছি। মূলত পরিবার সমাজের প্রাচীনতম ক্ষুদ্রতম প্রতিষ্ঠান হলেও মানুষের জীবনে এর প্রভাব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর জন্মের পর তার মৌলিক চাহিদা মেটানো থেকে শুরু করে তার সামাজিকরণ তথা তার ব্যাক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হচ্ছে তার পরিবার। কেননা সামাজিক মূল্যবোধ তথা ধৈর্য, উদারতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃষ্টিশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলি লোপ পাওয়ার কারণেই সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয় দেখা দেয়; যা বর্তমান সমাজে প্রকট। কেননা সমাজ রক্ষা করা না গেলে পরিবার রক্ষা করা যাবে না, ব্যক্তিকে রক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়বে, রাষ্ট্রও হয়ে পড়বে বিশৃঙ্খল। বাংলাদেশে সমাজ পরিবর্তনের উপাদানগুলো ব্যাখ্যা করা জরুরি। সমাজ পরিবর্তন মানে সামাজিক কাঠামো ও সমাজের মানুষের কার্যাবলি এবং আচরণের পরিবর্তন। তাদের মানসিকতার পরিবর্তন। মনে রাখতে হবে বিশৃঙ্খল সমাজে বসবাস করে উন্নত রুচি ও সংস্কৃতির অধিকারী হওয়া যায় না। আমরা চাই, পরিকল্পিত ও বিন্যস্ত সমাজ। নীতিবোধ ও চারিত্রিক মূল্যবোধ সমাজ গঠনের প্রধান শক্তি, যা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। সামাজিক জীবন ব্যক্তির কাছে এক আশীর্বাদ, এর পূর্ণতা লাভ করে সামাজিক বন্ধনের মাধ্যমে। সমাজ ব্যবস্থা এমনই হওয়া উচিত, যাতে ব্যক্তির স্বপ্ন ভঙ্গ না হয়। কিন্তু আমরা কী দেখতে পাচ্ছি। সমাজে অপরাধ এতটাই বেড়েছে যে একদিকে ব্যক্তির অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ অন্যদিকে সমাজও ধীরে ধীরে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। এটা প্রতিরোধে প্রয়োজন সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা, প্রয়োজন তীব্র সামাজিক আন্দোলন। এই দায়িত্ব নিতে হবে পরিবার ও সমাজকেই। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও যথেষ্ট করণীয় রয়েছে। সমাজের এক শ্রেণির বর্বর পাষণ্ড মানুষের হাতে অনেকের জীবনই বিপন্ন হয়ে পড়ছে, অবলীলায় জীবন চলে যাচ্ছে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বিনষ্ট করছে। মনে রাখতে হবে নানা ছলে, প্রতারণায়, এমনকি প্রকাশ্যে সমাজের ভেতর ঢুকে পড়ছে দুর্বৃৃত্তরা। ঢুকে পড়েছে রাজনীতির ভেতর। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে অপহরণ, ধর্ষণ, হত্যা করছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও মানুষকে জিম্মি করে অর্থের পাহাড় করে তুলেছে। এরা দেশ ও সমাজের শত্রু। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ধরনের ভয়াবহ চিত্র উদ্বেগজনক। লোভী মানসিকতার কারণে এবং মানবিক মূল্যবোধ লোপ পাওয়াতে অন্যায়টাকেই তারা স্বাভাবিক মনে করছে। সামাজিক সুস্থতা আনয়নের পাশাপাশি নতুন সমাজ নির্মাণের জন্য এ ধরনের অবক্ষয় ও বৈষম্যকে প্রতিরোধ করতে হবে যে কোনো মূল্যে এবং এর কোনো বিকল্প নেই। এই সর্বগ্রাসী সামাজিক অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করা। সেই সাথে প্রয়োজন পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করা। এছাড়া সকল প্রকার অশ্লীলতা শুধু বর্জনই নয় ক্ষেত্রবিশেষে এর প্রতিরোধও করতে হবে। যার শুরুটা হতে হবে নিজ গৃহ থেকে। সামাজিক সমস্যা দূর করতে রাষ্ট্রের সহযোগিতার হয়তো প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু মূল দায়িত্ব সমাজ তথা পরিবারকেই নিতে হবে। সন্তানকে আরো বেশি সময় দিতে হবে; হুমকি-ধামকি নয়, সহজ-সরলভাবে বুঝিয়ে রক্ষা করতে হবে বিপথগামিতা থেকে, আর সুফল-কুফল সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। তাহলে তরুণ প্রজন্ম রা পাবে অবয় থেকে। এভাবেই রোধ হবে সামাজিক বিপর্যয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি (বাপউস)।



ফেইসবুকে আমরা