বাংলাদেশ, , শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

আমার দেখা এক মহিয়সী নারী লুৎফুন্নেসা আহমেদ : দিদারুল আলম চৌধুরী

  প্রকাশ : ২০২০-০৯-০৬ ১১:০৪:০৭  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : “দুনিয়াতে মানুষের চেয়ে বড় আর কিছু নেই। আর মানুষের মাঝে মনের চেয়ে বড় নেই।” স্যার উইলিয়াম হ্যামিলনের বাণীটি দিয়ে শুরু করতে চাই। কেননা আমার মতে, তিনি যথার্থই বলেছেন। নশ্বর এই পৃথিবীতে মানুষের আগমন-প্রস্থান চিরচারিত নিয়মে হয়। তাই তো চির সত্য প্রবাদ, জন্মিলে মরিতে হইবে। তারপরেও কিছু মানুষ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণের পর তাঁর নিজস্ব কর্মগুণে মানুষের মাঝে স্মরণীয় হয়ে থাকেন। লুৎফুন্নেসা আহমেদ এমন এক মহিয়সী নারী ও স্মরণীয় ব্যক্তি। যিনি নিজের মেধা, শ্রম, কর্মচিন্তা আর সৃষ্টিশীল সুকুমারবৃত্তির চর্চায় যিনি নিজেকে তৈরি করেছেন হাজারোজনের একজন হিসেবে। এছাড়াও তিনি সাদামনের বিশাল হৃদয়ের এক মহানুভব ব্যক্তিত্ব। যাঁর শিশুসুলভ সরল হাসি যে কারো মন জয় করে নিতে পারে। তাঁর মতো ব্যক্তির জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করার জ্ঞান ও যোগ্যতা কিছুই রাখি না। তারপরেও তাঁদের প্রতিষ্ঠিত সুপার গ্রুপে দীর্ঘদিন ধরে চাকরির সুবাদে কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করতেই এই লেখা। বর্তমান যুগটা বড়ই যান্ত্রিক। এ যুগে মানুষ বড় আত্মকেন্দ্রিক। নিজের জগত নিয়ে ব্যস্ত হওয়ায় অন্যকিছু নিয়ে ভাবার সময় কারোর নেই। মূলত এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে কেউ কারো নয়। স্বার্থপর পৃথিবীতে নিজস্বার্থ ছেড়ে নিঃস্বার্থ হওয়া সাদা মনের মানুষ পাওয়া ভার। কিন্ত এই কঠিন ব্যস্তবতায়ও কিছু মানুষ থাকে যাঁদের জন্যই বোধকরি আমরা এগিয়ে যাবার আলো দেখতে পাই। তেমনি একজন আলোকিত মানুষ লুৎফুন্নেসা আহমেদ। যিনি ১৯৬০ সালে জন্মগ্রহণ করেন এই বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামের এক বনেদি পরিবারে। তাঁর পিতা মরহুম নুরুল হক ছিলেন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)’র তৎসময়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) পদে আসীন।

পড়ালেখায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে লূৎফুন্নেসা আহমেদ চট্টগ্রামের আরেক ধনাঢ্য পরিবার, এলিট পেইন্টস গ্রুপ অব কোম্পানিজ’র প্রতিষ্ঠাতা, শিল্পপতি মরহুম সিরাজ উদ্দিন আহমেদের দ্বিতীয় সন্তান সেলিম আহমেদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ছিলেন আমি যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম সেই গ্রুপের চেয়ারম্যান। তাঁর স্বামী সেলিম আহমেদ ছিলেন ঐ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এ ছাড়াও এই মহিয়সী নারী যুক্ত ছিলেন এবি ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সাথে। এমনকি তিনি অসংখ্য দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন আমৃত্যু। তিনি বুঝতেন, মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্যে। নিঃর্স্বাথভাবে বিপদগ্রস্ত ও ক্ষুধার্ত মানুষের সাহায্য ও সেবা করাই মানবর্ধম। এ মহৎ ও পুণ্যময় কাজই সর্বোত্তম ইবাদত, তাই মানবসেবার কাজের মধ্য দিয়ে নেশার মত ছুটে বেড়ান অসহায় মানুষের খোঁজ। বিপদগ্রস্ত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আর্থিক সহযোগিতা, অসুস্থ মানুষের চিকিৎসাসেবা দায়িত্ব নেয়া, ছিন্নমূল পথশিশুদের বস্ত্র প্রদান, সু-শিক্ষার ব্যবস্থা, খাবার বিতরণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মী ও প্রতিষ্ঠানে অনুদান, বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান করে দেওয়াসহ সবখানে তাঁর পদচারণা। কিন্তু তিনিসহ এই পরিবারটি ছিল প্রচারবিমুখ। কখনোই তিনি দান করে প্রচারণা করতেন না এবং তা প্রকাশও করতেন না। তাই বর্তমান করোনা মহামারির এই সময়ে তাঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে জানাজাতে অসংখ্য মানুষের সমাগম হয়। লুৎফুন্নেসা আহমেদের কাছে ধর্মীয় অনুশীলন ও অনুশাসন ছিল এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।আমি দেখেছি তিনি সেসময়ের পবিত্র রমজানমাসে তাঁর গ্রুপের কর্মকর্তাদের খতমে তারাবির নামাজের জন্য নিজেদের ড্রযিংরুমে কোরআনে হাফেজ নিয়োগ দিয়ে নিমিজের ব্যাবস্হা করতেন।চিন্তা করতাম কতটুকু ধর্মপরায়ন ও উদার হলে এ কাজ সম্ভব।
তিনি বুঝতেন, অসহায় মানুষের প্রতি সমাজের সার্মথ্যবান ও বিত্তশালদের সাহায্য ও সহানুভূতির হাত সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন। নিজেকে নতুনভাবে ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে দেখেছি নিজের অর্জিত সবটুকুই বিলিয়ে দিতে। মানবিক সহজাত গুণাবলির মধ্যে অন্যের ব্যথায় সমব্যথী হওয়া এবং পরের বিপদে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা একটি মহৎ গুণ। হিতৈষী মনোভাব ও সহমর্মিতার গুণ ছাড়া মানবিকতা ও মহানুভবতার বিকাশ পূর্ণতা পায় না। এই মহৎ ও সুন্দর গুণটি যার মধ্যে বিদ্যমান, তিনি সমাজ তথা রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বেেত্র উত্তম কাজের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন। আমি তাঁদের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি সুপার রিফাইনারী প্রাইভেট লিমিটেডে কর্মরত থাকাকালীন ১৯৯৮ সালের শেষের দিকে একটি ঘটনা দিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণ করছি। তখন সবেমাত্র বেসরকারিভাবে জ্বালানী তেল শোধনাগার হিসেবে সুপার রিফাইনারী পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করেছে। যেদিন আমরা প্রথম ব্যাচের উৎপাদন শেষ করি, সেদিন রাত প্রায় বারোটার অধিক। আমাদের কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি (লুৎফুন্নেসা আহমেদ) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তাঁর স্বামী সেলিম আহমেদও উপস্থিত ছিলেন। প্রথম ব্যাচের উৎপাদিত প্রোডাক্ট নামার পর দোয়া মোনাজাত শেষ করে উৎপাদিত পণ্য এম.টি.টি নিয়ে উনার দুই হাতে কবজির উপর পর্যন্ত মেখে ফেললেন। আমিসহ কোম্পানির অন্য দুই কর্মকর্তা প্রণব বাবু ও মরহুম মহসিন সাহেব হতবাক হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ম্যাডাম, আপনি এই দুর্গন্ধযুক্ত এমটিটি কেন হাতে মাখছেন? এটা কী করতেছেন? উনি প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, এই ঘ্রাণ একদিন আমাদের সুগন্ধি ছড়াবে। আসলে তাই হয়েছিল। সুপার রিফাইনারী লিমিটেডের সুনাম দিনদিন এত বেশি ছড়িয়ে গিয়েছিল, যা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ঠাঁই করে নিয়েছে। আর কোম্পানিটি দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখতে শুরু করেছিল। প্রতি বছর বছর গড় প্রবৃদ্ধিতে দেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিতে গণ্য হলো। শুধুমাত্র এটা সম্ভব হয়েছিল মহিয়সী এই নারীর বদান্যতা ও তাঁর স্বামীর দুরদর্শিতার গুণে। পরবর্তীতে অবশ্যই তাঁদের দেখাদেখিতে ও ব্যবসায়িক সাফল্য দেখে বর্তমানে বেসরকারি খাতে ছোট-বড় ১৪টির মতো রিফাইনারী গড়ে উঠেছে। লুৎফুন্নেসা আহমেদের ব্যবসা উন্নয়নের পাশাপাশি দানশীলতার হাত এত বেশি প্রসারিত ছিল, তিনি কখনো কোনো ধর্মের গরিব অসহায়দের বিমুখ করেননি। কেননা ইসলামসহ অপরাপর সব ধর্মেই একে অপরের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতাকে সর্বোত্তম কাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে এবং মানবতার মঙ্গল সাধনে এই গুণটির গুরুত্ব অত্যধিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন এক মহানুভব ব্যক্তি। যাঁর নিদর্শন বিশ্বে আর একটিও নাই। আমরা সেই নবীর উম্মত হিসেবে তাঁকে অনুসরণ করা আমাদের কর্তব্য। তাই আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি, আমরা কারণে-অকারণে কাউকে কষ্ট দিব না। কেউ আমভাদের কষ্ট দিলে কিংবা অন্যায় আচরণ করলে উদার মনে তাঁকে মা করে দেব। আমরা ক্ষমাশীল মানুষ হতে চেষ্টা করব। তাহলে ক্ষমাশীল আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করবেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ হয়ে বিদেশি চিকিৎসাধীন ছিলেন। অপক্ষায় ছিলাম একদিন আশার বাণী আসবেই, তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। ফিরে আসবেন আমাদের মাঝে। কিন্তু আচমকা এ দুঃসংবাদ শুনতে হবে কল্পনাও করিনি। কিন্তু গত ২৬ আগস্ট তিনি দুরারোগ্য ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ৬০ বৎসর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি তাঁর একমাত্র সুযোগ্য পুত্র সুপার গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাজির আহমেদ, পুত্রবধূ, আত্মীয়-স্বজনসহ অসংখ্য গুণগ্রাহীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে পরপারে চলে যান। তাঁর চলে যাওয়াটা ছিল আমার জন্য বেদনাদায়ক। এই মহামারিতে অসংখ্য পরিচিত মুখকে হারালাম। তাঁদের মধ্যে আমার মাতৃতুল্য লৎফুন্নেসা আহমেদকে হারাতে হল, যা আমার জন্য খুব পীড়াদায়ক। মানুষকে মূল্যায়ন করার যে দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর ছিল তা অনন্য। কেননা আমাদের সমাজে শিক্ষিত মানুষের অভাব নেই, কিন্তু বিবেকবান মানুষের বড়ই অভাব। কিন্তু তাঁর মধ্যে সেই গুণটি ছিল, তিনি মানুষকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারতেন। তিনি ছিলেন আমার মাতৃতুল্য। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হয়েও কখনো উচ্চবাক্যে কথা বলতে তাঁকে দেখিনি। নানান প্রতিকূল পরিবেশে ধৈর্য ধরে পথ চলেছেন তিনি। আমাকে উপদেশ দিতেন নিজের মতো করে। যেকোনো সময় আপদে-বিপদে খবরাখবর নিতেন। আজ তাঁর এই চলে যাওয়া আমাকে ব্যথিত করেছে। মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন। আর শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।

লেখক: কলামিস্ট ও কর্পোরেট হাউস কর্মকর্তা ।



ফেইসবুকে আমরা