স্বাধীন বাংলাদেশ আর দেশের রাজনীতিতে এক মহিয়সী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব
: লায়ন ডাঃ বরুণ কুমার আচার্য বলাই
পরিস্হিতি২৪ডটকম : স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বাংলার স্বাধীনতা তথা স্বাধীনতা পূর্ব ইতিহাসে যে নারীর ত্যাগ ও সংগ্রাম জড়িয়ে আছে তিনিই সেই মহীয়সী নারী। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় রেনু এবং আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাতা। বাঙালি জাতির সুদীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি পদেেপ সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা। ছায়ার মতো অনুসরণ করেছেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শকে বাস্তবায়ন করার জন্য। ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তাঁর ডাকনাম ছিল রেণু। পিতার নাম শেখ জহুরুল হক এবং মাতার নাম হোসনে আরা বেগম। এক ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট। মাত্র তিন বছর বয়সে বাবাকে ও পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারান তিনি।
বড় হন দাদা শেখ কাশেম এর কাছে। বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব প্রথমে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ও পরবর্তীতে সামাজিক কারণে গৃহশিকের কাছে পড়াশুনা করেন। তার স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। যেকোনো পরিস্থিতি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা, অসীম ধৈর্য ও সাহস নিয়ে মোকাবেলা করতে পারতেন তিনি। দাদার চাচাতো ভাই শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রেণুর বিবাহ হয়। তখন থেকে রেণুর শাশুড়ি বঙ্গবন্ধুর মাতা সায়েরা খাতুন তাঁকে নিজের সন্তানদের মতো মাতৃস্নেহে লালন-পালন করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পবিবারের সবার প্রতি ছিল তার সমদৃষ্টি। স্বামী শেখ মুজিবুর রহমান যখন কলকাতায় থাকতেন বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছার সময় কাটতো নানা রকম বই পড়ে। দেশপ্রেমের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগ্রামে নিজেকে জড়িত রেখেছেন বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। স্বামীর রাজনীতিতে সবরকম সহায়তা করতেন তিনি। ছাত্ররাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত শেখ মুজিব এর যখনই অতিরিক্ত অর্থের দরকার হতো তখনই নিজের পিতৃ সম্পত্তি থেকে অর্জিত অর্থ বিনা দ্বিধায় প্রেরণ করতেন বেগম শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তেও সংসার ও রাজনীতির কর্মময় জীবনের বর্ণনায় বার বার স্ত্রী বেগম মুজিবের নাম উচ্চারণ করেছেন। মনেপ্রাণে তিনি একজন আদর্শ বাঙালী নারী ছিলেন। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা, অসীম ধৈর্য ও সাহস নিয়ে জীবনে যে কোন পরিস্থিতি দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করতেন। স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বান্তকরণে সহযোগিতা করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, কারাগারে আটক নেতাকর্মীদের খোঁজখবর নেয়া ও পরিবার-পরিজনের যে কোন সঙ্কটে পাশে দাঁড়াতেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন ছায়ার মতো অনুসরণ করে তাঁর প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অফুরান প্রেরণার উৎস হয়েছিলেন বেগম মুজিব। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামী করে পঁয়ত্রিশ জন বাঙালি নৌ ও সেনাবাহিনীর সদস্য ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলাকে পাকিস্তানের সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে অভিহিত করে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে বাঙালি রাস্তায় নামে। আগরতলা মামলা দায়ের করার পর তৎকালীন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গ্রেফতারের হুমকি দেয়। লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বিষয়ে বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জোরালো আপত্তি জানান এবং এক রকম প্রতিহত করেন। কেননা এই মহীয়সী নারী দেশের সার্বিক আন্দোলনের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাত করে তিনি সকল বিষয় অবহিত করেন। বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ, তাই বেগম মুজিবের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র নামে খ্যাত মামলা প্রত্যাহার করতেই হবে। বঙ্গবন্ধু যেন শক্ত থাকেন সে বিষয়ে তিনি পরামর্শ দেন। বেগম ফজিলাতুন্নেছার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান বেগবান হয়। প্রবল গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত হলেন ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯। পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি বাঙালিরা তাদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়ে বরণ করে নেয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টি মাস অসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল ও ধৈর্য্য নিয়ে বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। এমনকি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ও ২৩ মার্চের পতাকা উত্তোলনে বঙ্গবন্ধুর প্রধান উদ্দীপক ও পরামর্শক হিসেবে বিবেচনা করা যায় বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছকে। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের পরদিন ১৭ ডিসেম্বর তার ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বন্দিদশার অবসান ঘটে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লন্ডনে যান। সেখান থেকে বেগম মুজিবের সঙ্গে তার প্রথম কথা হয়। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। অবসান ঘটে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার দীর্ঘ প্রতীক্ষার। এরপর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজেও বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়ান তিনি। অনেক বীরাঙ্গনাকে বিয়ে দিয়ে সামাজিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন জীবনদান করেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শেখ ফজিলাতুন্নেছার মতো ধীরস্থির, বুদ্ধিদীপ্ত, দূরদর্শী, নারীর সাহসী, বলিষ্ঠ, নির্লোভ ও নিষ্ঠাবান ইতিবাচক ভূমিকা শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হতে সহায়তা করেছে। জনগণের কল্যাণে সমগ্র জীবন তিনি অকাতরে দুঃখবরণ এবং সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছেন। সেই বিবেচনায় বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব স্মরণীয় একটি নাম। একটি ইতিহাস। মনেপ্রাণে একজন আদর্শ নারী। সন্তানদের সার্থক মাতা। বিচণ উপদেষ্টা ও পরামর্শদানকারী। সাহসী বঙ্গমাতা। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর সুখ-দুঃখের সাথী এবং বঙ্গবন্ধুর প্রেরণা ও শক্তির উৎস ছিলেন এই মহীয়সী নারী। তার সদয় আচরণ ও বিনয়ে মুগ্ধ ছিল সবাই। সন্তানদের যেমনি ভালবেসেছেন তেমনি শাসন করেছেন। পিতা মাতা উভয়েরই কর্তব্য তিনি শেষ দিন পর্যন্ত পালন করে গেছেন। বেগম মুজিব ছিলেন কোমলে কঠোরে মিশ্রিত এক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সাহসী নারী। স্বামীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সন্তানদের গড়ে তোলেন। তার কাছে সহযোগিতা চেয়ে কেউ কখনও রিক্ত হস্তে ফিরে যায়নি। কারাগারে আটক নেতাকর্মীদের খোঁজখবর নেয়া থেকে শুরু করে পরিবার-পরিজনদের যে কোন সংকটে পাশে দাঁড়াতেন তিনি। বহু কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে ও ছেলেমেয়েদের শিার জন্য তিনি সহযোগিতা করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে জাতির পিতার হত্যাকারীদের হাতে বেগম মুজিবও নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। কিন্তু বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে অন্যতম এক প্রেরণাদায়িনী মহীয়সী নারী হিসেবে বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিষ্ট ও মরমী গবেষক।