পরিস্হিতি২৪ডটকম : সামাজিক অস্থিরতা, অপসংস্কৃতি, আকাশ সংস্কৃতি, নারীকে নিয়ন্ত্রণ করা, মাদকসেবীদের সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি নানা কারণে সামাজিক অবক্ষয় বেড়ে গেছে। এছাড়াও ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফির ব্যাপক প্রসার এবং বিকৃত রুচির মানসিকতাও এই জন্য দায়ী। মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অভাব ও সামাজিক অবক্ষয়ে অস্থিতিশীল হচ্ছে সমাজ ও দেশ। কলুষিত হচ্ছে মানুষনামক সংজ্ঞাটি। বাড়ছে নারীর প্রতি সহিংসতা। উদ্যোগজনকহারে নারী ও শিশু নির্যাতনের খবর ছড়িয়ে পড়ছে পাল্লা দিয়ে, যা কোন মতে কাম্য নয়। বর্তমানে দেশে দিন দিন বাড়ছে ধর্ষণ নামের নির্মমতা। শুধু নারীই নয়, শিশু-কিশোরও শিকার হচ্ছে এই বর্বরতার। ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণই শেষ নয়, খুন করা হচ্ছে নৃশংসভাবে। গত কয়েক মাস ধরে যেন ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর খুনের উৎসব চলছে। এভাবে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নারী। বাদ যাচ্ছে না ৫/৬ বছরের কম বয়সী কন্যা শিশুও। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তিন বা চার বছরের দুধের শিশুও শিকার হচ্ছে এই বিকৃত যৌনতার। এতেই থামছে না ধর্ষক। ধর্ষণের পর ধর্ষিতাকে খুনও করা হচ্ছে। কিন্তু সমাজে ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর লোকলজ্জায় এসব ঘটনার সিংহভাগই প্রকাশ করছে না ভিকটিম। সামাজিক অসম্মানের ভয়ে তা লুকিয়ে যাচ্ছে তাদের পরিবার। দীর্ঘ মেয়াদে হেনস্থার ভয়ে করছে না মামলা। বরং জানাজানি হওয়ার ভয়ে নারীর উপর এসব ঘটনায় ভিকটিম ও পরিবার এমনভাবে চেপে যাচ্ছে যেন কিছুই ঘটেনি।
তারপরও ছিটেফোঁটা যে ক’টি ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে তাতেই এখন আঁতকে উঠার মতো পরিস্থিতি। এই চিত্র এখন সারা দেশের। এর মধ্যে কিছু কিছু ধর্ষণের নির্মমতা হতবাক করে দিচ্ছে সবাইকে। ৫/৬ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৬০ বছরের বৃদ্ধাও রেহাই পাচ্ছেন না ধর্ষণের হাত থেকে। সৎ পিতা, শিক্ষক, নিকটাত্মীয় কারো হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না ভিকটিমরা। কর্মক্ষেত্র, চলন্ত বাসে, এমনকি নিজের ঘরে পর্যন্ত নেই নিরাপত্তা। এ যেন এক অন্তবিহীন ঘূর্ণিঝড়ের করাল থাবা। সাধারণত অতৃপ্ত যৌন আকাঙ্খা, দেয়ালে নগ্ন পোস্টার, যৌন উত্তেজক অবৈধ বইয়ের রমরমা ব্যবসা, অশ্লীল পত্রপত্রিকা, অশ্লীল ছায়াছবি প্রদর্শন, পর্নোগ্রাফি, চলচ্চিত্রে নারীকে ধর্ষণের দৃশ্যের মাধ্যমে সমাজে রাস্তাঘাটে বাস্তবে ধর্ষণ করার উৎসাহ যোগান, নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার, ইন্টারনেটে অশ্লীল সাইটগুলো উম্মুক্ত করে দেয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, যৌন উত্তেজক মাদক ইয়াবার বহুল প্রসার ইত্যাদি কারণে দিন দিন ধর্ষণ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ। এই বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। একদিকে বাড়ছে ধর্ষণের মাত্রা অন্যদিকে বাড়ছে মানুষের উদ্বেগ। সবকিছুকে ছাড়িয়ে ধর্ষণ এক মহামারীতে রূপান্তরিত হয়েছে সারা দেশ জুড়ে। নতুন নতুন পদ্ধতি, নতুন নতুন প্রক্রিয়ায় এগিয়ে চলে ধর্ষণের হার। গণধর্ষণ, পালাক্রমে ধর্ষণ, উপুর্যোপুরি ধর্ষণ, আটকে রেখে ধর্ষণের খবর বেরোচ্ছে প্রতিদিন। আইনের কঠোরতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা কোন কিছুই যেন রোধ করতে পারছেনা ধর্ষণের মহামারী। ক্রমেই মহামারী আকার ধারণ করছে ধর্ষণ এবং ধর্ষণ শেষে হত্যা। উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত, শিশু থেকে তরুণী সমাজের সব ক্ষেত্রে, সব বয়সেই ঘটে যাচ্ছে ধর্ষণের ঘটনা। একের পর এক ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেই চলেছে, আমরা নির্বিকার। এর শেষ কোথায়? নারী ও শিশুকন্যার প্রতি এ সহিংসতার প্রতিকার কী? যখন একটি শিশুর হামাগুড়ি দেবার বয়স, যখন তার টলমলে পায়ে সদ্য হাঁটতে পারার বয়স, যখন মায়ের কোল ছেড়ে প্রথম গুটি গুটি পায়ে নার্সারিতে যাবার, খেলতে যাবার বয়স, ঠিক তখনই তার শরীরে বসে যাচ্ছে যৌন নির্যাতনের হিংস্র থাবা। যে থাবার বিষাক্ত নখে ছিঁড়িয়ে যাচ্ছে তার সুকোমল প্রত্যঙ্গ। অতি পরিচিত, নিকট আত্মীয় কখনও বা পরিবারেরই বয়স্ক সদস্যদের দ্বারা ঘটছে। কখনও বা কোনো স্বল্প পরিচিত, অপরিচিতও আদর করে চকলেট দেবার ছলে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে ফেলে রেখে যাচ্ছে। শুধু যৌন বিকৃতি চরিতার্থের জন্যে নারী এমনকি দুধের শিশুর ওপরও যে বল্গাহীন নিষ্ঠুর আচরণ, তার প্রতিবিধানে সমাজ, সরকার এত উদাসীন কেন? যে ট্রমা নিয়ে ওই নির্যাতিত শিশুরা বড় হবে, ধর্ষিত নারীর দিন অতিবাহিত হবে, ভবিষ্যতে পারিবারিক, সামাজিক সম্পর্ক গুলিকে কি তারা বিশ্বাস করতে পারবে? সম্মান করতে পারবে? সেই সম্পর্কগুলিতে শেষাবধি তাদের কোনো আস্থা জন্মাবে কি? সারাজীবন যে ত নিয়ে তারা পথ চলবে কোনো কিছু দিয়েই কি মুছে ফেলা সম্ভব তা? এইসব নারী ও শিশুদের ওপর নির্মম অত্যাচারের রক্তের দাগ আমাদের প্রত্যেকের হাতেও লেগে যাবে, যদি আমরা সবাই তার বিরুদ্ধে এখনই সোচ্চার না হই। ক্যান্সার রোগীকে সুস্থ করতে আক্রান্ত সেলগুলিকে যেমন সমূলে উৎপাটন করতে হয়, সমাজে ছড়িয়ে পড়া ওই ধর্ষক নামক ক্যান্সার সেলগুলিকেও তেমনি উপড়ে ফেলতে হবে। সম্প্রতি ঘরে-বাইরে নারীরা যেভাবে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, তা অনাকাঙ্খিত ও অনভিপ্রেত। যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের মাত্রা সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিমাসে ৩০০টিরও বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। প্রকৃত অর্থে এ সংখ্যা আরও বেশি হবে সংগত কারণে যে, গ্রাম-গঞ্জ এমনকি শহরেও অনেকেই লোকলজ্জার ভয়ে ধর্ষণের কথা প্রকাশ করতে চান না। যেহেতু ধর্ষণের শিকার নারীটির ওপরই সামাজিকভাবে ঘৃণা বর্ষিত হয়। এমনকি এজন্য ধর্ষিতার পরিবার-পরিজন কিংবা তার অভিভাবকদেরও সুনজরে দেখা হয় না বললেই চলে। তাই অনেকে ধর্ষণের শিকার হয়েও থানায় মামলা করেন না। আর থানায় মামলা দিতে গেলেও অনেক অনাকাঙ্খিত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় ধর্ষিতাকেই। এরপর সাহস করে যারা ধর্ষণের মামলা থানায় বা আদালতে করেন সেই মামলার সিংহভাগ অভিযুক্তই রেহাই পেয়ে যায় নানান কারণে। এছাড়া ধর্ষণের মামলা তদন্ত করতে গিয়েও একশ্রেণীর পুলিশ কর্মকর্তা ধর্ষিতাকেই নানাভাবে হেনস্তা করে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। আইনবিদদের মতে, যৌনতা মানুষের জীবনের একটি অন্যতম অধিকার। তবে এই যৌনতাকে বিকৃত করে উপস্থাপনই হচ্ছে ধর্ষণ। ধর্ষণের সঙ্গে যৌনতার চেয়েও মতার বিষয়টি বেশি সম্পর্কিত। আমি পুরুষ, আমার মতা আছে যেকোনো সময় যেকোনো নারী বা শিশুকে ভোগ করার। একজন যৌনকর্মীরও অধিকার আছে তিনি কার সঙ্গে যৌনকাজ করবেন আর কার সঙ্গে করবেন না। একজন যৌনকর্মী যদি ‘না’ করেন, তা মানা নাহলে তা হবে ধর্ষণ। কিন্তু এই বিষয়গুলো সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়নি বলেই ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। ধর্ষকের হাত থেকে তিন বছরের শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। পরিচিতজনদের মাধ্যমে ধর্ষণের ঘটনাও বাড়ছে। সবকিছুর মূলে আছে মূল্যবোধের অভাব। অবাধ পর্নোগ্রাফির বিস্তার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্বল্প পরিচয়ের পর ওই ছেলের সঙ্গে বাছবিচার না করে মেলামেশা, বিভিন্ন চ্যানেল, বিশেষ করে পাশের দেশ ভারতের বিভিন্ন চ্যানেলে যা দেখানো হয়, তা-ও ধর্ষণের মতো অপরাধকে উসকে দিচ্ছে। বিজ্ঞাপন দেখে একটি ছোট ছেলেও জানতে পারছে, শরীরকে উত্তেজিত করতে হলে কী খেতে হবে। ছেলেমেয়েরা ইন্টারনেটে কোন সাইট দেখছে, তা-ও অভিভাবকেরা কখনো নজরে আনছেন না। ধর্ষণের পরীায় ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নিয়ে এত আলোচনার পরও তা বন্ধ হয়নি। বর্তমানে ধর্ষণের শিকার হয়ে অনেকেই সাহস করে মামলা করছেন যা শুভ উদ্যোগ। এই বিষয়ে পরিবার ও সমাজের আরো জোরালো ভূমিকা থাকা চাই। ধর্ষণ কোন সাধারণ অপরাধ নয়। এটি একটি গর্হিত ও অমার্জনীয় অপরাধ। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে এ অপরাধের কঠোর শাস্তি রয়েছে। এই কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধের মাত্রা দেশে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এর একটি মাত্র কারণ, ধর্ষকরা শাস্তির মুখোমুখি না হয়ে নানাভাবে ছাড়া পেয়ে যায়। ফলে এমন অপরাধ দেশে বেড়েই চলেছে। ধর্ষণের অপরাধীদের কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়াতে একশ্রেণীর বিকৃত মানসিকতার মানুষ প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে মেয়েদের ইজ্জত-সম্ভ্রম লুটে নেবার দুঃসাহস করে। যারা ধর্ষণের মতো মারাত্মক অপরাধ করে তাদের বিবেকের মৃত্যু ঘটে। তারা মানুষ থাকে না। পশুতে পরিণত হয়। আর এদের প্রতিহত এবং নিরপরাধ নারীদের রা করতেই তৈরি হয়েছে কঠোর আইন। ঘৃণিত এই ধর্ষকদের আইনানুগভাবে বিচারের মুখোমুখি করতে পারলেই বাংলাদেশের মেয়েরা সমাজে নিরাপদে নির্বিঘেœ চলাফেরা করতে যেমন সম হবে, তেমনই অপরাধের সংঘটকরাও অনেকটা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকবে। গুটি কয়েক অমানুষের এই পশু সূলভ আচরনের জন্য ত্রিশ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। কলুষিত সমাজ ব্যবস্থা গ্রাস করছে নৈতিকবোধ বিপর্যস্ত হচ্ছে মূলবোধ, নষ্ট হচ্ছে মানবিক সচেতনতা। কঠোর হাতে এর দমন চাই। কতিপয় মানুষের বিকৃত জিজ্ঞাংসা যেন নষ্ট না করে শুভচেতনা, মানুষত্বের ধারণা এবং মঙ্গল সাধনা। এই বিষয়ে সজাগ হতে হবে। জেগে উঠুক মানুষ, অপেক্ষার দিন আর নাই। প্রয়োজন অপরাধীর প্রকাশ্যে মৃত্যুদন্ড চাই। সহ্যের সীমা অতিক্রম করে ফেলছে মানবিক বোধহীন মানুসের বর্বরতা।
লেখক: মরমী গবেষক, কলামিষ্ট, গ্রন্থপ্রণেতা।