বাংলাদেশ, , শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

উন্নয়নের স্বার্থে বস্তুনিষ্ট সংবাদ পরিবেশনে আরো দায়িত্বেশীল হতে হবে : ডাঃ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন

  প্রকাশ : ২০১৯-১১-০৩ ১২:৫৬:৩০  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : গণমাধ্যম সমাজের দর্পন এবং সাংবাদিকতা এক মহান পেশা। যা আমাদের সমাজে অনেক চ্যালেঞ্জিং ও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। সেই চ্যালেঞ্জকে সাহসিকতার সহিত কিছু তরুণ ও তরুণী সদা হাসি মুখে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে উদ্যম ভয়-ডরহীন কাজে যোগ দেয়। যা একসময় কল্পনাও করা যেতনা। প্রসঙ্গক্রমে, সাংবাদিকতা কি এবং কেন এর চাহিদা এবং বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ইংরেজিতে Journalism শব্দটির অর্থ সাংবাদিকতা। “জার্নাল” শব্দের অর্থ হচ্ছে কোনকিছু প্রকাশ করা আর “ইজম” শব্দের মানে হচ্ছে কোনকিছু অনুশীলন বা চর্চা করা। তাহলে প্রশ্ন করা যেতে পারে সাংবাদিকতা কি? সাংবাদিকতা হল বিভিন্ন ঘটনাবলী, বিষয়, ধারণা ও মানুষ সম্পর্কিত প্রতিবেদন তৈরী ও পরিবেশনা। যা উক্ত দিনের প্রধান সংবাদ এবং তা সমাজ ও রাষ্ট্রে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এই পেশায় শব্দটি তথ্য সংগ্রহের কৌশল ও সাহিত্যিক উপায় অবলম্বনকে মুদ্রিত, টেলিভিশন, বেতার, ইন্টারনেট এবং পূর্বে ব্যবহৃত নিউজরিল সংবাদ মাধ্যমের অন্তর্গত। সাংবাদিকতার যথোপযুক্ত নিয়মের ধারণা ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন রকম হয়ে থাকে। সাংবাদিক যা করেন তা হচ্ছে সাংবাদিকতা। অন্যদিকে সাংবাদিকতা হচ্ছে কাজ। এদের কাজ হচ্ছে তথ্য সংগ্রহ করা, প্রতিবেদন লেখা এবং সম্পাদনা করা। সংবাদ হলো চলতি ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ। যা পাঠকের আগ্রহ উদ্দীপ্ত করে। যেকোনো পেশার মতো সাংবাদিকতা আজকের দিনে একটা বহুচর্চিত পেশা। এই পেশার এত চর্চার কারণ বোধহয় সাহসিকতা, নির্ভীকতা ও সত্যের জন্য লড়াকু মানসিকতা’র জন্য। অগোচরে পড়ে থাকা তথ্যকে সকলের গোচরে নিয়ে আসাই তো সাংবাদিকের কাজ আর এটাই তো সংবাদ। আগামী যত দিন যাবে, মানুষের তথ্যনিভর্রতা আরো বাড়বে, এবং সংবাদের প্রয়োজনীয়তা’ও একসময় অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠবে আশা করা যায়। সাংবাদিকতা হল সেই কাজ যেখানে এটা প্রমাণিত, কলমের ধার তলোয়ারের চেয়ে বেশি। সংবাদদাতা বা সাংবাদিক বিভিন্ন স্থান, ক্ষেত্র, বিষয় ইত্যাদিকে ঘিরে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংবাদ সংগ্রহসহ বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংগ্রহপূর্বক সংবাদ কিংবা প্রতিবেদন রচনা করে সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রেরণ করে থাকেন। পেশাজীবি হিসেবে একজন সাংবাদিকের প্রত্যেক গণমাধ্যমের একটা নীতিমালা থাকে। সেটা সম্পাদকীয় নীতি। অর্থাৎ গণমাধ্যম কী সমর্থন করবেন, কী বিরোধিতা করবেন ইত্যাদি। এই নীতিমালা গ্রহণের ব্যাপারে গণমাধ্যম মোটামুটি স্বাধীন। তবে কোনো গণমাধ্যম ইচ্ছে করলেই দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করতে পারবে না। সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করতে পারবে না। কারণ এগুলো রাষ্ট্রীয় নীতি এর বাইরে একটি গণমাধ্যম মোটামুটি স্বাধীন সম্পাদকীয় নীতি গ্রহণ করতে পারে। গণমাধ্যমের মালিক বা মালিক গোষ্ঠী তাদের পছন্দমতো কিছু নীতি ঠিক করতে পারে। সেই নীতির আলোকেই প্রতিটি গণমাধ্যম পরিচালিত হয়। গণমাধ্যমে কর্মরত সব সাংবাদিক সেই নীতি অনুসরণ করেই কাজ করে থাকেন। এটা মোটামুটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি পথ। সংবাদপত্রের একটি স্বাভাবিক কাজ হলো : বিভিন্ন সংবাদের প্রতিবাদ ছাপানো। অনেক সময় নানা কারণে সংবাদপত্রে ভুল তথ্য প্রকাশিত হয়। তখন যার সম্পর্কে লেখা তিনি বা তার অফিস প্রতিবাদ করেন। সেই প্রতিবাদপত্রও সংবাদপত্রে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করতে হয়। সংবাদপত্র তথা রিপোর্টারের নিজস্ব বক্তব্য থাকলে প্রতিবাদপত্রের সঙ্গে তা যুক্ত করা যায়। কিন্তু প্রকাশিত রিপোর্টের প্রতিবাদ পাঠানো হলে তা প্রকাশ করতেই হবে। এ ব্যাপারে সংবাদপত্রের কোনো অজুহাত ধোপে টিকবে না। কিন্তু আজকাল দেখা যায় অনেক সংবাদপত্রে, এমনকি বহুল প্রচারিত খ্যাত পত্রপত্রিকাতেও ‘প্রতিবাদ বিজ্ঞপ্তি’ প্রকাশ করা হয় না। এজন্য সম্পাদক অবশ্যই দায়ী। অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ করেন, তাহলে সেই সম্পাদকের শাস্তি হতে পারে। কেননা দেশের স্বার্থ আর সাংবাদিকতার স্বার্থ পরস্পরবিরোধী নয়। সাংবাদিকতা পেশা সম্মানজনক, মানুষের সেবা করার জন্য এই পেশা। সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের কাজ ট্রায়াল নয়, বরং সাংবাদিক ও সংবাদপত্র ঘটনার সকল তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরবে। সত্য হচ্ছে শেষ কথা, প্রেক্ষাপট আর মতাদর্শ যাই থাক না কেন একজন সাংবাদিকের দায়িত্ব হচ্ছে সত্য উদ্ঘাটন ও সত্যের বিকাশ ঘটানো। একজন সাংবাদিককে আত্মসচেতনতার মাধ্যমে পেশার দায়িত্ব ও নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। দ্রুত ও বেশি সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গুরুত্ব খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।’ তবে ফেইক নিউজ যেন দ্রুত ছড়িয়ে না পড়ে সে বিষয়ে নজর রাখতে সবার সংবাদ সজ্ঞান হওয়া দরকার। খুশির সংবাদ হলো বছরে পাঁচশ’র বেশি ছাত্র-ছাত্রী সাংবাদিকতায় স্নাতক শেষ করছেন। এদের বেশিরভাগই সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন। সেই হিসাবে বলা যায় নীতি-নৈতিকতার বিষয়ে আমাদের জানা-বোঝার ঘাটতি নেই। এখন কেবল বিবেকের কাছে নিজেকে ছেড়ে দিতে হবে। আর হলুদ সাংবাদিকতা মানেই ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশন, দৃষ্টি আকর্ষণকারী শিরোনাম ব্যবহার করা, সাধারণ ঘটনাকে একটি সাংঘাতিক ঘটনা বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা, কেলেংকারির খবর গুরুত্ব সহকারে প্রচার করা, অহেতুক চমক সৃষ্টি ইত্যাদি। সাধারণ ঘটনাকে কয়েকটি কলাম জুড়ে বড় আকারের ভয়ানক একটি শিরোনাম করা, ছবি আর কাল্পনিক নক্সার অপরিমিত ব্যবহার। ভুয়া সাাৎকার, ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে এমন শিরোনাম পরিহার করা জরুরী। সৎ ও নিষ্ঠাবান সাংবাদিকরা এসব কিছু মোকাবিলা করেই তাদের পেশার সম্মানকে অমলিন করে রাখছেন। এবং সাংবাদিকদের সকল বিষয়ে জ্ঞান থাকা জরুরি। এ পেশা মূলতঃ শুধু জীবিকার মাধ্যম নয়, দেশ-জাতি এবং মানুষ ও মানবতার কল্যাণে সেবার মাধ্যমও বটে। তাই এই মহান পেশার সেবকদের ওপর যখন জুলুম ও নির্যাতন নেমে আসে তখন আমরা ব্যথিত হই। তবে আমরা এর চাইতে বেশি ব্যথিত ও মর্মাহত হই তখন, যখন দেখি কোন সাংবাদিক ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক বিবেচনায়, অহংকার কিংবা প্রলোভনের কারণে সাংবাদিকতার নীতিমালা এবং কর্তব্যবোধ বিসর্জন দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকতা পেশাকে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ব্যবহারের আহবান জানিয়েছেন এবং তিনি বলেছেন গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে কখনও বালকসুলভভাবে ব্যবহার করা উচিত নয়। আমরা সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। কিন্তু এটাকে বালখিল্যভাবে ব্যবহার করা উচিত নয় এবং সবারই এ ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত। দেশের জন্য কল্যাণজনক হবে এমন ভূমিকাই গণমাধ্যমের পালন করা জরুরী। সাংবাদিকগণ অন্তত গঠনমূলক দায়িত্বশীল ভূমিকাটা পালন করবে যেটা দেশের কল্যাণের কাজে লাগবে। মিডিয়ার মাধ্যমে সাংবাদিকরা এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলের দু:স্থ জনগণের কথা, বিপন্ন জনমানুষের কথা তুলে আনেন ফলে সরকারের তাঁদের পাশে দাঁড়াতে সুবিধা হয়। বস্তুতপক্ষে শুধু সাংবাদিকতা কেন, যে কোনও পেশায় নীতি ও নৈতিকতা একটা বড় ব্যাপার। মানুষের কাছে সঠিকটা সবসময় তুলে ধরতে হবে। এটাই তো জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে ওঠা উচিৎ। আর আধুনিক যুগে ইয়োলো জার্নালিজম নামক টার্মটা কথায় কথায় উঠে আসে বটে, কিন্তু এই ডিজিটাল যুগে ইয়লো জার্নালিজম করা খুব মুশকিল। বরং, পেইড নিউজ তার জায়গা করে নিয়েছে জনমানসের মতাদর্শ যে কোনও বিষয়ে গড়ে দিতে। একজন সাংবাদিক সত্যিকার অর্থে তখন সফল হয়, যখন সে সর্বত্র সঠিক সংবাদ পরিবেশন করার লক্ষ্যে তার জ্ঞান, বিদ্যা ও উপস্থিত বুদ্ধির সমন্বয়ে উপস্থাপন ও তথ্য উপাত্ত সঠিক ও নির্ভুলের সাথে সোর্স নির্বাচন ভালো হয়। অথচ বিপুল সম্ভাবনার এ বাংলাদেশে একটি গণমাধ্যম যদি সঠিক অবস্থানে থেকে দায়িত্ব পালন করে, তাহলে অংশগ্রহণমূলক যে উন্নয়নের কথা বলা হয়, তা শুরু হবে। তৃতীয় বিশ্বে গণমাধ্যমের কাজটা সন্তানের প্রতি মা-বাবার মতো। জনগণকে সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণে রাখা। উন্নয়নের চলকগুলো সাধারণের আলোচনায় নিয়ে আসা। সরকারের নজরে আসে, তেমন সুযোগ তৈরি করতে সাহায্য করা, জাতিগত উন্নয়নে জাতীয়-আন্তর্জাতিক সব সুবিধা পাওয়ার জন্য তথ্য সরবরাহ করা এবং তা রক্ষণাবেণে সচেতনতা তৈরি করা হয়। তাহলে এই বস্তুনিষ্ট ও দায়িত্বশীলতা মধ্যে আজকের গতিশীল বাংলাদেশের উন্নয়নের পথ আরো সুগম হবে। গঠিত হবে কাঙ্খিত সোনার বাংলাদেশ।

লেখক: কলামিষ্ট, প্রবান্ধিক ও কেন্দ্রীয় মহাসচিব, বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি।



ফেইসবুকে আমরা