মুহাম্মদ সাফাত বিন ছানাউল্লাহ্ /পরিস্হিতি২৪ডটকম : প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাহিত্য পাঠে মানুষ অজানাকে জানতে পারে। লেখনী ও গবেষণার মাধ্যমে মানুষ ইতিহাসের যে পরিক্রমা সম্পর্কে ধারনা পায় ও নতুনত্বের দিকে অগ্রসর হয়। আলোকিত ও কালজয়ী মহাপুরুষদের সম্পর্কে জেনে প্রজন্ম আলোর শুদ্ধ পথে পরিচালিত হওয়ার উৎসাহ পায়। সেই রকম বাংলাদেশের ও ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন প্রতœ ইতিহাস ও ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস এবং সাহিত্য সংস্কৃতির স্মরণীয় বরণীয় মানুষ মণীষীদের অর্জনের মহাকর্ম-কান্ডগুলো নব প্রজন্মের কাছে প্রতিনিয়ত তুলে ধরার চেষ্টায় লিপ্ত আমাদের চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান ইতিহাসবিদ সোহেল মুহাম্মদ ফখরুদ-দীন। দীর্ঘ ২ যুগেরও অধিক সময় ধরে কান্তিহীনভাবে এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক পত্র পত্রিকায় এই বিষয়ে তিনি নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন। এক হাজারেরও অধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ইতিমধ্যে গ্রন্থ আকারে প্রকাশ পেয়েছে ৩৩টি গ্রন্থ। আমাদের চট্টগ্রামের কালপঞ্জি শিরোনামে তাঁর একটি গ্রন্থের মাধ্যামে চট্টগ্রামের প্রাচীন সময়ের মহামূল্যবান ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া যায়। চট্টগ্রামের মুসলমান আগমনের ইতিহাস নামে তাঁর একটি ও ঐতিহাসিক গ্রন্থ রয়েছে। এই গ্রন্থের মাধ্যমে চট্টগ্রামে মুসলমান আগমনের ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়। সোহেল মুহাম্মদ ফখরুদ-দীন একজন ইতিহাস গবেষক, গ্রন্থ প্রনেতা, প্রতœতত্ত্ব গবেষক, সংগঠক ও প্রাচীন পুঁথিপত্র সংগ্রাহক।
সোহেল মুহাম্মদ ফখরুদ-দীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সূতিকাগার চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার সাতবাড়ীয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা:- বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক ও সুবক্তা মাওলানা মোহাম্মদ আলী চন্দনাইশের ঐতিহ্যবাহী বার আউলিয়া হামেদীয়া ফাজিল মাদ্রাসায় একটানা সুদীর্ঘ ৪০ বছর শিক্ষকতা করে বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছেন। মাতা:- রত্নাগর্ভা মোছাম্মৎ শামসুন নাহার আলী।
সোহেল মুহাম্মদ ফখরুদ-দীন প্রতিনিয়ত লেখালেখির মাধ্যমে অবিরাম কলম বর্ষণ করে বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে তুলে ধরছেন কৃতি ব্যক্তিত্বদের জীবনী, দেশের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারত থেকে বের হয়েছে তাঁর প্রায় ৩৩টি গ্রন্থ। গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বহু সম্মাননা। সোহেল মুহাম্মদ ফখরুদ-দীনের লেখা বহু গ্রন্থ থেকে ১০ টি গ্রন্থের পরিচিতি ও সারসংপে আলোচনা তুলে ধরছি- চন্দনাইশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ১ম খণ্ড : মুলত এটি বীর চট্টলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সূতিকাগার হিসেবে খ্যাত চন্দনাইশের প্রামাণ্য দলিল। বইটিতে লেখক চন্দনাইশে জন্মগ্রহণকারী দেশের বরেণ্য খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের জীবনী, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, মহান ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ সহ নানান আন্দোলন সংগ্রামে চন্দনাইশের ভূমিকা, মহান সূফী সাধক যাদের মাধ্যমে পবিত্র ইসলাম ধর্ম আলোকিত হয়েছে তাদের জীবন ও কর্ম প্রকাশিত হয়েছে। (গ্রন্থটির ২য় খণ্ড প্রকাশের অপোয়)
চট্টগ্রামে মুসলমান আগমনের ইতিকথা : আমাদের বীর চট্টগ্রাম তৎকালিন ইসলামাবাদে পবিত্র ধর্ম ইসলামের প্রচার প্রসারে কারা ভূমিকা রেখেছিলেন লেখক বইটিতে গবেষণার মাধ্যমে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছেন।
আমাদের প্রিয় নবী (দ.) এর মহান সাহাবী যিনি ১০ জন বেহেশতের সুসংবাদ প্রাপ্ত সাহাবীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাদ্বিঃ) সর্বপ্রথম কয়েকজন সঙ্গী সহ চট্টগ্রামে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে আসাম হয়ে চীন পর্যন্ত গিয়েছিলেন পরবর্তীতে এই মহান সাহাবায়ে রাসুল (দ.) এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরো অনেক বিখ্যাত আউলিয়ায়ে কেরাম (রহঃ) এই জনপদে ইসলাম প্রচার করেছিলেন গ্রন্থটিতে লেখক গবেষণা করে তথ্যের মাধ্যমে অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।
দিওয়ান-ই-ওয়েসি : দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার কৃতি সন্তান, বিশ্ববরেণ্য সূফী সাধক ও গ্রন্থ প্রণেতা, রাসুলনোমা পীর খ্যাত হযরত সূফী ফতেহ আলী ওয়েসি (রহঃ) মাজার কলকাতা, মাণিকতলা যিনি রাসুল (দ.) প্র্রেমে বিভোর একজন আশেকে রাসুল (দ.) ছিলেন। নবী প্রেমে যিনি অসংখ্য নাতে রাসুল (দ.) লিখেছিলেন সেই মহান সুফি সাধকের কয়েকটি নাত শরীফ বাংলা, উর্দু এবং ইংরেজী ভাষায় বইটিতে অনুবাদ করা হয়েছে।
প্রাচীন চট্টগ্রামের কালপঞ্জি : হাজার হাজার বছরের ইতিহাস খ্যাত চট্টগ্রামের ঐতিহ্য বইটিতে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হয়েছে। মোঘল আমল থেকে মহান ভাষা আন্দোলন, পরবর্তীতে মহান মুক্তিযুদ্ধ সহ চট্টলায় জন্ম নেয়া ইতিহাসের খ্যাতিমানদের কথা, হাজার বছরের বিভিন্ন প্রতœতত্ত্ব যেগুলো পৃথিবীর বুকে চট্টগ্রামের পরিচয় বহন করে গ্রন্থটিতে বিস্তারিত ভাবে উঠে এসেছে।
Mowlana Moniruzzaman Islamabadi Pioneer of Muslim Renaissance :
চন্দনাইশের কীর্তিমান মহাপুরুষ, উপমহাদেশ খ্যাত সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, গ্রন্থ গ্রণেতা, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্বাধীনতা সংগ্রামী, শিক্ষাবিদ ও ইসলামী চিন্তাবিদ ইতিহাসের কালজয়ী মহাপুরুষ হযরত মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর বিশাল কর্মময় জীবন। বইটিতে মহামনীষী হযরত মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী যিনি উপমহাদেশে প্রথম বাংলা পত্রিকা “হাবলুল মতিন” সম্পাদনা করেছিলেন।
সাংবাদিকতা, রাজনীতি ও সমাজকর্মে বিশ্ববিখ্যাত এই মনীষী যিনি এই চট্টগ্রামে প্রথম মুসলিম আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন। একজন সংগ্রামী হিসেবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করে বৃদ্ধ মাওলানা ইসলামাবাদী জেল জুলুমের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন বইটিতে বিস্তারিত ভাবে উটে এসেছে।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষন – বিজয়ের বাংলাদেশ : সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজধানীর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে যে অমর ভাষন দিয়েছিলেন সেটি ইউনেস্কো কর্তৃক সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। মূলত সেই ভাষনের উপর লেখা এই বইটিতে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আত্মত্যাগ কারী সাতজন বীরশ্রেষ্ঠর জীবনী ও প্রকাশিত হয়েছে।
অথৈ : বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল ইতিহাস মঞ্চ ও চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রের যৌথ আয়োজনে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত আন্তর্যাতিক ইতিহাস ও সাহিত্য সম্মেলন উপলে স্বারক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। বইটিতে বাংলাদেশ-ভারত-নেপালের বরেণ্য কবি, সাহিত্যিক ও লেখকদের কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। মোহনা : এটিও বাংলাদেশ-ভারত-নেপালের খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক ও লেখকদের কবিতা ও প্রবন্ধ সংকলন। বইটিতে তিন দেশের সাহিত্যিক, কবি ও প্রাবন্ধিকদের রচনাবলী লিপিবদ্ধ রয়েছে। জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ : বইটিতে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, বাঙালী জাতীর অবিসংবাদিত নেতা জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবনের নানা দিক তুলে ধরেছেন লেখক। এই বইটির মাধ্যমে পাঠক সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে। শুদ্ধ পথের পথিক : চট্টগ্রাম তথা উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফি সাধক যারা পবিত্র ধর্ম ইসলাম প্রচার ও প্রসার ও তরিকতের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে আলোর পথ দেখিয়েছেন সেই মহামানবদের জীবন ও কর্ম অত্যন্ত সুন্দরভাবে তথ্যবহুল আলোচনা করেছেন লেখক বইটিতে। এছাড়াও ইতিহাসবিদ, প্রতœতত্ত্ব গবেষক সোহেল মোহাম্মদ ফখরুদ-দীন রচিত গ্রন্থের তালিকা- ১) শাহ শরফুদ্দিন (রাহঃ) এর জীবনী ও কেরামত। ২) হযরত কালু শাহ (রাহঃ) জীবনী ও কারামত। ৩) ফজিলাতুল কদরের সাহিত্যকর্ম। ৪) সৃষ্ট চন্দনাইশ (১ম খন্ড)। ৫) সৃষ্ট চন্দনাইশ ( ২য় খন্ড)। ৬) উদ্ভাসিত মনীষী। ৭) মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর জীবন কর্ম। ৮) মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর অপ্রকাশিত সাাতকার। ৯) একজন জাহিদুল হক ও প্রতিবন্ধকতা জয়ের গল্প। ১০) সোহেল মো.ফখরুদ-দীনের নির্বাচিত প্রবন্ধ। ১১) চট্টগ্রামের সোনার মানুষ। ১২) শুদ্ধপথের পথিক। ১৩) অথৈ। ১৪) মোহনা (১ম খন্ড)। ১৫) মোহনা ( ২য় খন্ড)। ১৬) চট্টগ্রামের কালপঞ্জি। ১৭) শানে মোস্তফা (সা:)। ১৮) কিরাত বাংলা (১থেকে ৯ম খন্ড)। ১৯) বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ। ২০) বিজয়ের বাংলাদেশ। ২১) চন্দনাইশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য (১ম খন্ড)। ২২) ত্রিরতœ।২৩) চট্টগ্রামে নজরুল অভিভাষন। ২৪) চট্টগ্রামে মুসলমান আগমনের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ২৫) চট্টগ্রামে মুসলমান আগমনের ইতিহাস ( ২য় খন্ড)। ২৬) দিওয়ানে ওয়াইসি (রাহ:)। ২৬) মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী পাইনিওয়ার অব মুসলিম রেনেসা। ২৭) সোনামনিদের ইতিহাস বিষয়ক সাধারনজ্ঞানের সিরিজ বই (শিশু শ্রেনীথেকে ৪র্থ শ্রেনী ৫ টি), ২৮) বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন। এছাড়াও সোহেল মুহাম্মদ ফখরুদ-দীনে সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যাও ১৫ টি। পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা এক হাজারেরও অধিক। সোহেল মোহাম্মদ ফখরুদ্দিন ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী ছাড়াও দুই সন্তানের গর্বিত জনক। তিনি একজন পবিত্র কোরআন শরীফ হাফেজ। বর্তমানে তিনি সংস্কৃতি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অধ্যায়ন করে চলেছেন। ধর্মিয় গণ্ডির মধ্যে থেকেও তিনি লালন করেন অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনাকে। বাংলাদেশের প্রতœতত্ত্ব সংরণ ও আবিস্কারে তাঁর সংগ্রাম দীর্ঘদিনের। তিনি চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র এর সভাপতি। সার্কভুক্ত দেশ সমূহের বাংলা ভাষা চর্চা ও ইতিহাস প্রচার প্রসারের লক্ষে আন্তর্জাতিক মানের সংগঠন বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল ইতিহাস মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। ২০১৯ সালে জাতীয় গ্রন্থ মেলায় তাঁর ৫টি নতুন গ্রন্থ প্রকাশ হচ্ছে। ১) শত মণীষীর জীবনী, ২) ভাষা আন্দোলনে ২১-১৯ এ শহীদ, ৩) চট্টগ্রামে জাতীয় কবি নজরুল, ৪) চন্দনাইশের ইতিহাস (২য় খণ্ড), ৫) ঢোল। ইতিহাস সচেতনতা ও সাধনায় সোহেল মুহাম্মদ ফখরুদ-দীন প্রতিনিয়ত মানুষ ও মানবতার জন্য কাজ করে এগিয়ে যাক এটি আমার প্রত্যাশা। তাঁর গ্রন্থগুলোর মাধ্যমে আমরা ও নতুন প্রজন্ম প্রাচীন ইতিহাস জানতে সম হব। আমি তাঁর বইগুলো সফলতা কামনা করছি।
লেখক: কবি, ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক।
সদস্য, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র।