বাংলাদেশ, , শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

সমাজের প্রতি স্তরে মানবতা প্রতিষ্ঠা হোক মানুষের কল্যাণে : ডা. বরুণ কুমার আচার্য

  প্রকাশ : ২০২০-০২-০৪ ১৪:৩২:৩৫  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : আজকের আধুনিক বিশ্বে মানবতা, মানব সভ্যতা ও মানবাধিকার বিষয়টি বহুল আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে মূল্যায়িত হচ্ছে। সমাজে, রাষ্ট্রে এমনকি আন্তর্জতিক ভাবে এই বিষয়সমূহের গুরুত্ব অপরিসীম। কারন জীবনের জন্য যেমন অক্সিজেন প্রয়োজন তেমনি জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজন মানবতা, আদর্শ নৈতিকতা মানবাধিকার। সাধারণত মানবতা বলতে আমরা বুঝি মানবীয় জাগতিক ও পরলৌকিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে তা অনুশীলন করা। যে অনুশীলনের মাধ্যমে সমাজ সভ্যতা বিনির্মিত হয়, মূলত সেটিই মানবতা বা মানব সভ্যতা। মানবতা বা মনুষ্যত্ব যা একটি মানুষ হওয়ার প্রথম গুণ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এটি দিনদিন মানুষের মাঝ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, যেটি প্রাণীদের মাঝে এখনও বিদ্যমান। সড়ক পথে মৃত্যুর মিছিল, ধর্ষণ, মারামারি, কাটাকাটি তারই বহিঃপ্রকাশ। আজ যদি মানবতা টিকে থাকতো তাহলে এসব শব্দের ব্যবহারও আমাদের করতে হতো না। মানবতা ও মনুষত্যের বিষয়টি মানুষের চিন্তা চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভরশীল। এটি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। কেননা একজন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী ব্যাক্তির কাছে নীতি নৈতিকতার বিষয়টি সুনির্দিষ্ট কিন্তু একজন নাস্তিকের কাছে নৈতিকতার বিষয়টি আপেকি। যেভাবে হউক না কেন সমাজে বসবাস করতে হলে তবে প্রথমে মনুষত্য বা মানবতার বিষয়টি অনুশীলন করা প্রয়োজন । এই বিশ্বের সকল মানুষের ধর্ম যদি মানবিকতা হত তাহলে কোন মানুষ আরেকজন মানুষকে হত্যা করতে পারতো না। কেননা মানুষ হয়ে মানবিকতাই সবচেয়ে বড় ধর্ম হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখজনক যে মানুষ আজকে ধর্মের কারণে বিভক্ত, ধর্মের কারণে তার মানবিক গুণাবলী আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এই কথাটি চিন্তা করলে বুঝতে পারবেন। মৌলবাদ আর গোঁড়ামি থাকলে এটা আপনার কাছে অর্থহীন মনে হবে। মানুষের ধর্ম যদি মানবিকতা হতো, তাহলে মতার জন্য, দম্ভের জন্য মানুষে মানুষে যুদ্ধ হতো না। পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্র যদি একটি করে মানবিক রাষ্ট্র হতো তাহলে একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের অধিকার হরণ করত না, একটি রাষ্ট্র মানবিক হলে সে তার নিজের দেশের নাগরিকদের অধিকারও হরণ করে না। মানুষের মধ্যে যদি মানবিকতা থাকত তাহলে পৃথিবী আর স্বর্গের মধ্যে তফাৎ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হতো। পৃথিবীর এক অংশে দুর্ভিক্ষ আর অন্য অংশে প্রাচুর্যের পাহাড় থাকত না। সাম্য আর মানবতার বাণী সারা বিশ্বে একসাথে ধ্বনিত হতো। মানুষ জন্মগতভাবে একটি ধর্মে বিশ্বাসী হয়, কিন্তু সে যখন পরিপূর্ণ, বিবেকবান আর সভ্য মানুষ হয় তখন মানবিক ধর্মটাকে প্রাধান্য দেওয়া যৌক্তিক বলে আমি মনে করি। মানবতা তখনই সবোর্ৎকৃষ্ট পর্যায়ে অবস্থান করে যখন তা পরিপূণর্ভাবে যথার্থস্থানে প্রয়োগ করা যায়। অন্যথায় মানবতা কথাটির প্রকৃত কোনো অর্থ প্রকাশ পায় না। সবার অন্তরে যেমন মানবতা বিরাজমান থাকে না তেমনই সব ক্ষেত্রে মানবতার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো ঠিক নয়। মানুষ থেকে মানবতার সৃষ্টি আবার মানুষ দ্বারাই সেই মানবতার ধ্বংস করা হয়। সর্ব অবস্থায় একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের সবচাইতে দুবর্ল দিকটি খুঁজে আর সময় সুযোগ বুঝে চরমভাবে আঘাত করে। তখন মানুষের গায়ে শত জোর থাকলেও মানুষ ও মানবতা হিংস্র রূপ ধারণ করে। চলমান সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানবতার দোহাই দিয়ে চলে হাজারো নৈতিকতাবিরোধী কমর্কাণ্ড। মানবতা শব্দের সঙ্গে গভীরভাবে যে শব্দটি জড়িয়ে আছে তা হচ্ছে নিঃস্বার্থ কারণ কোনো ব্যক্তি যখন মানুষের কল্যাণে কাজ করে তখন তা থাকে সম্পূর্ণ স্বাথের্র বাইরে। কিন্তু বতর্মানে একেবারে স্বাথের্র বাইরে মানুষ কাজ করে তা স্থিরভাবে বলা কিছুটা বোকামির পরিচয় দেয়া হবে। তাতে প্রত্যভাবে নিজস্ব কোনো স্বার্থ না থাকলেও পরোভাবে রয়েছে নানান ধরনের স্বার্থ বতর্মানে আমাদের দেশে মানবকল্যাণ, মানবসেবা, মানবাধিকার নামে যে সংগঠনগুলো ভাসমান তারা কি তাদের নির্ধারিত নীতি অনুযায়ী কাজ করে না কি অন্য পথে হাঁটে তা ভাবার বিষয়। শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে কোথায়ও বাদ নেই মানবতাপ্রেমীী ব্যক্তির উপস্থিতি। শুধু মুখে মুখে তারা মানবতাপ্রেমী না কি কর্মেও তার পরিচয় মিলে তা চিন্তার বিষয়। শহর থেকে গ্রামে যেখানেই দৃষ্টি ফেলি না কেন, মানবকল্যাণ নামে যে দিকটি আমাদের চোখের সামনে ভাসে তা হচ্ছে, নিজের বা প্রতিষ্ঠানের প্রচার প্রসারের মাধ্যমে সবার দৃষ্টি আকষর্ণ করা। বড় বড় সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, লিফলেট, ব্যানার টানিয়ে মিডিয়া ডেকে মানুষকে সাহায্য করার নাম কোনোভাবেই মানবতা হতে পারে না। মানুষ আজ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। চোখের সামনে যে মানবাধিকার সংস্থাগুলো ঘুরে বেড়ায় তার অধিকাংশই অচল বলা যায়। মানুষকে অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে দেখেও তারা একদম নীরব। সরকারি লাইসেন্স ও নিবন্ধন ব্যাতিত অনেক মানবাধিকার সংস্থা দেশের বিভিন্ন স্থানে কমিটি গঠন করে নিেিবর্ঘœ চালাচ্ছে তাদের খুশিমতো কাযর্ক্রম। দেশ ও বিদেশ থেকে আসা অর্থও সাহায্য কতটা দরিদ্র মানুষের নিকট পৌঁছাচ্ছে, নাকি আগেই ভোগ হয়ে যাচ্ছে, তা তারা ব্যতিত অন্য কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারবে না। তারপরও বলবো মানুষ মানুষের জন্য, মানুষের বিপদের সময় পাশে থেকে সহযোগিতা করাই মানুষের ধর্ম। একজন মানুষ, মানুষের জন্যই। বিপদে-আপদে, সমস্যা-সংকটে ছুটে এসে সাহায্য করবে এমন প্রত্যাশা মানুষ মাত্রই করতে পারে। মানব জীবনের সম্পূর্ণতা আর তৃপ্তির জন্য সমাজের অসহায়-পীড়িতদের জন্য কিছু করা দরকার। আমাদের সবারই সুযোগ রয়েছে মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার। আমি, আপনি, এভাবেই এগিয়ে আসতে পারি সকলেই। দাঁড়াতে পারি বিপদে মানুষের পাশে। এই পৃথিবীর মধ্যে সব চাইতে বড় আদালত মানুষের বিবেক। আমরা অনেক মানুষ আছি, আমাদের বিবেক আছে ঘুমিয়ে। সমাজে কিছু মানুষ আছেন যারা স্বপ্ন দেখেন মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করার। মানুষের জন্য মানবতা, মানবতার জন্যই মানুষ, অসহায় এবং বঞ্চিত মানুষের উপকারে নিজেকে আত্মনিবেদন করার এবং অন্যকে এতে উৎসাহিত করা। শত শত বছর ধরে মানুষের জীবন পাল্টে দেওয়া থেকে শুরু করেজীবনের নতুন অর্থ নির্মাণের ক্ষেত্রে এগুলোর ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। অনেক বছর বাঁচলেই কেবল বড় মানুষহওয়া যায় না। একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে যদি একটি প্রাণ বাঁচে; একজন মানুষ বাঁচার স্বপ্ন দেখে তাতেই হয়তো জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এইভাবেই সমাজের প্রতি স্তরে মানবতা প্রতিষ্ঠাতা হউক মানুষের কল্যাণে, দুর হউক হিংসা বিদ্বেষ এবং ধনী গরিব বৈষম্যতা, এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: প্রাবন্ধিক, মরমী গবেষক ও গ্রন্থপ্রণেতা।



ফেইসবুকে আমরা