বাংলাদেশ, , বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

নীরব ঘাতক বায়ুদূষণ রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী : এ কে এম আবু ইউসুফ

  প্রকাশ : ২০১৯-১২-০৫ ১৯:৫৮:১৬  

নীরব ঘাতক বায়ুদূষণ রোধে  কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী
                                                       …. এ কে এম আবু ইউসুফ

পরিস্হিতি২৪ডটকম : বায়ু পৃথিবীর চারদিক বেষ্টনকারী গ্যাসীয় আবরণ যা পৃথিবীর অভিকর্ষের টানে পৃথিবী-সংশ্লিষ্ট হয়ে রয়েছে। আর বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর জীবজগৎকে ক্ষতিকর বিকিরণ এবং মহাজাগতিক ধ্বংসাবশেষ থেকে রক্ষা করে। নানাবিধ গ্যাসের মিশ্রণে বায়ু গঠিত, যার মধ্যে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের পরিমাণ সর্বাধিক। ফুসফুস মারফত বায়ুর অক্সিজেন গ্রহণ করেই আমরা বেঁচে আছি। তবে বায়ুর গঠন স্থির নয়। এর প্রধান পরিবর্তনশীল দুটি উপাদান হলো জলীয়বাষ্প ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড। বায়ুর গ্যাসীয় সাংগঠনিক উপাদানগুলো হচ্ছে: নাইট্রোজেন ৭৮.০৯%, অক্সিজেন ২০.৯৫%, আর্গন ০.৯৩%, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ০.০৩% এবং সামান্য পরিমাণে নিয়ন, হিলিয়াম, মিথেন, ক্রিপটন, হাইড্রোজেন, জেনন এবং ওজোন। এই বায়ু বা বাতাস ছাড়া মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। তবে তা হতে হবে নির্মল বায়ু। নির্মল বায়ু যেমন মানুষকে বাঁচাতে পারে, তেমনি দূষিত বায়ু মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। প্রকৃতির দান এই অমূল্য সম্পদ নির্মলই থাকে। কিন্তু মানুষই তাকে দূষিত করে। আমরা জানি যে, বাযুর অন্যতম উপাদান অক্সিজেন মানুষ গ্রহণ করে আর কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে। গাছপালা কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন ত্যাগ করে। বায়ুতে অধিক অক্সিজেনের জন্য অধিক গাছপালার প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে গাছপালা কেটে উজাড় করায় বায়ুতে অক্সিজেনের পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বায়ু দূষণের মাত্রাও বাড়ছে। বায়ুদূষণ ((Air Pollution) প্রাকৃতিকভাবে অথবা মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে সৃষ্ট ক্ষতিকর ও বিষাক্ত পদার্থের দ্বারা বায়ুমণ্ডলের দূষণ। বায়ুদূষণপূর্ণ কোন একটি এলাকায় বায়ুতে অবমুক্ত ক্ষতিকর পদার্থসমূহের পরিমাণ অন্যান্য স্থানের তুলনায় অধিকতর হওয়ায় সহজেই দূষণের ক্ষতিকর প্রভাবসমূহ শনাক্ত করা যায়। বায়ুদূষণের প্রধান উৎসসমূহ হচ্ছে গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়া, বিদ্যুৎ ও তাপ উৎপাদনকারী যন্ত্র থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া, শিল্পকারখানা এবং কঠিন বর্জ্য পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া। বায়ুদূষণের আরও একটি কারণ অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের ঊর্ধ্বে বায়ুমণ্ডলের ওজোনস্তরে ক্রমবর্ধমান ফাটল সৃষ্টি হওয়া। মানবজাতি, উদ্ভিদরাজি, পশুপাখি এবং জলজ প্রতিবেশ ব্যবস্থার ওপর অ্যাসিড বৃষ্টি সংঘটনের মাধ্যমেও বায়ুদূষণ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে আসছে।

আমাদের এই বাংলাদেশে প্রধানত দুটি উৎস থেকে বায়ুদূষণ ঘটছে শিল্প কারখানাসমূহ নির্গত ধোঁয়া এবং যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া। এ ছাড়াও ইটের ভাটা, সারকারখানা, চিনি কল, কাগজ কল, পাটকল, বস্ত্র কারখানা, স্পিনিং মিল, ট্যানারী শিল্প, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরী, রুটি ও বিস্কুট কারখানা, রাসায়নিক ও ঔষধ শিল্প, সিমেন্ট কারখানা, মেটাল ওয়ার্কশপ, করাত কল প্রভৃতি শিল্প কারখানা বায়ুদূষণ ঘটাচ্ছে। এছাড়াও কর্ষিত জমি থেকে উৎপন্ন ধুলা এবং উপকূলীয় দ্বীপসমূহ ও উপকূলীয় ভূমি এলাকায় সন্নিকটস্থ সমুদ্র তরঙ্গসৃষ্ট লবণ কণা দ্বারা বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। বায়ুদূষণের এসকল উৎস থেকে প্রচুর পরিমাণে ধোঁয়া, বাষ্প, গ্যাস ও ধুলিকণা উৎপন্ন হয়, যা কুয়াশা ও ধোঁয়াচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের কয়েক প্রকার শিল্প কারখানা যেমন ট্যানারী কারখানাগুলি প্রতিনিয়ত হাইড্রোজেন সালফাইড, অ্যামোনিয়া, কোরিনসহ আরও কয়েক প্রকার গন্ধহীন রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করছে যেগুলি একদিকে যেমন বিষাক্ত তেমনি অন্যদিকে স্থানীয় জনগণের বিরক্তি ও পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ সকল দূষক মাথাধরা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি করছে এবং অধিক হারে নগরায়নের কারণে নগরে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে অধিকতর হারে বায়ুদূষণ ঘটছে। দেশের শহরগুলোতে বায়ুদূষণের জন্য মানুষ ক্ষতিগ্রস্হ হয় বছরে চারমাস। শীতকালীন মৌসুমে। বর্ষাকালে বায়ুদূষণ থাকে না। শীতকালে বায়ুদূষণের মূল কারণ ক্ষুদ্র বস্তুকণা। এমনিতেই প্রতিবছরই শীতের মৌসুমে বৃষ্টির স্বল্পতা থাকায় বাতাসে ধুলোর পরিমাণ বেড়ে যায়। এর সঙ্গে জনবহুল এই নগরে বিপুল সংখ্যক যান চলাচলের কারণে ধুলায় সর্বোচ্চ মাত্রায় সিসা, ক্যাডমিয়াম, দস্তা, ক্রোমিয়াম, নিকেল, আর্সেনিক, ম্যাঙ্গানিজ ও কপারের উপস্থিতি বাড়ছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে সৃষ্ট ধুলা-বালু বায়ুদূষণের ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করেছে। উদ্বিগ্ন হওয়ার বিষয় যে, দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্হ সেসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশ্বে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান। বাংলাদেশের জলবায়ু তথা প্রকৃতির এই যে পরিবতর্ন তা মানবসৃষ্ট। এই পরিবর্তনে প্রকৃতি কোনোভাবে দায়ী নয়, আমরা মানুষই দায়ী। বতর্মানে মানুষ নিজেদের স্বার্থে প্রকৃতির ওপর যেভাবে নিযার্তন চালাচ্ছে অতীতে এতটা বিধ্বংসীরূপে দেখা যায়নি কখনো। তাই এর দায়ভার মানুষকেই বহন করতে হবে। বাংলাদেশের মহানগরীগুলোতে এখন আর আগের মতো জীবন্ত প্রবাহমান খাল বিল পুকুর জলাশয় চোখে পড়ে না। চোখে না পড়ার কারণ হলো খাল, বিল, পুকুর, ছোট বড় জলাশয়গুলো এখন ভরাট করে বিভিন্ন শিল্পকারখানা দোকান-পাট গড়ে তোলা হয়েছে এবং হচ্ছে। নদী নালা খাল বিল পুকুর জলাশয় না থাকলে ধুলোবালি বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। একটি কথা সবার মনে রাখা উচিত, প্রকৃতির বিরুদ্ধে কমর্যজ্ঞ যত বেশি চলাব আমরা, প্রকৃতি তত বেশি বিরূপ রূপ ধারণ করবে। এটা প্রকৃতির স্বভাবধর্মী আচরণ। মূলত বেঁচে থাকার এই প্রধান অনুষঙ্গ বায়ু এখন অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর মানে অবস্থান করছে। যাপিত জীবনে উন্নয়নের বিকল্প নাই। কিন্তু এই উন্নয়ন জনমুখী ও পরিবেশবান্ধব হওয়া বাঞ্ছনীয়। উন্নয়নের সময় খেয়াল রাখা উচিত, এই উন্নয়নের কর্মযজ্ঞের সময় বা এর পর যেন পরিবেশ হুমকির মুখে না পড়ে। সাধারণ জনগণ যেন বেকায়দায় না পড়ে। মূলত পরিবেশ রার কথা মাথায় রেখে উন্নয়ন করলে সুফল সুনিশ্চিত। অথচ পরিবেশ রায় যে কাজ হচ্ছে সেখানে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিবেশবাদীদের সমন্বয় নেই। সমন্বয় নেই সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের। এই সমন্বয়হীনতার সংস্কৃতির কারণে পরিবেশ সুরায় গতিশীলতা আসছে না। বায়ুদূষণকে সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, গ্যাস কোম্পানিগুলো, বিদ্যুৎ বিভাগ, বিআরটিএ এবং পুলিশের সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি। পরিবেশের উপর নেমে আসা বিপর্যয় নিয়ে আজ বিশ্বের মত বাংলাদেশও উদ্বিগ্ন। কারণ আজ মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকার কারণে মানুষ বায়ু দূষণের শিকার হচ্ছে। যারা পথে-ঘাটে চলাচল করেন, বাসে-টেম্পোতে চলেন তারা সবাই বায়ুদূষণ দ্বারা আক্রান্ত। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, ঢাকা শহরে প্রতিবছর বায়ুদূষণের কারণ ১৫ হাজার মানুষ অকালে মারা যায় এবং ৬৫ লাখ মানুষ মারাত্মক অসুস্থতা, ৮৫ লাখ মানুষকে ছোট-খাটো অসুস্থতার শিকার হয়। বিশ্বব্যাংক এবং ইসম্যাপ পরিচালিত দ্য ঢাকা অটো ক্লিনিক প্রোগ্রাম শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায়, বায়ুদূষণের মারাত্মক ফলস্বরূপ। এক সমীক্ষা অনুসারে, গত ৮ বছরেই মৃত্যুবরণ করেছে ৮ হাজার ১৩৯ জন এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছে ২২ লাখ ২১ হাজার ৬৩৮ জন। এদের মধ্যে ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৩৯জন। একই রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ৫ লাখ ৬৫ হাজার ৮৫৬ জন এবং অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন আরো ১১ হাজার ৪৭৪ জন। তাই উন্নত বিশ্ব বায়ুকে দূষণমুক্ত রাখতে কী কী পদ্ধতি ব্যবহার করছে, সেসব যেমন আমাদের ব্যবহার করতে হবে, একইসঙ্গে মানুষকেও এ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। বায়ুকে নির্মল করে তুলতে হলে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সরকারকে যেমন আরো দায়িত্বশীল হতে হবে তেমনি পরিবেশ রায় যারা নিয়োজিত তাদের দায়িত্ব পালনের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এই দূষণরোধে নেই সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ এবং অভিজ্ঞতা যা কাজে লাগিয়ে বাস্তবায়ন করা যায় দূষণমুক্ত বসবাসযোগ্য পরিবেশ। জাতীয়ভাবে পরিবেশ রক্ষার জন্য এবং পানি সুরক্ষার জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত, সচেতন হওয়া উচিত। সর্বোপরি, পরিবেশদূষণ প্রতিরোধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সচেতনতা ও উদ্যোগ নিলে দূষণ কমিয়ে আনা সম্ভব। এর জন্য নতুন নতুন পরিবেশবান্ধব টেকনোলজি প্রয়োজন পড়বে। দূষণ একটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাই আন্তঃদেশীয় যোগাযোগের মাধ্যমে দূষণ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। দূষণের কারণে ধীরে ধীরে মৃত্যু আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এটা মানুষকে বোঝাতে হবে। সরকার এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন। সরকার বায়ুদূষণ রোধে নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে। এই উদ্যোগকে সফল করতে হলে তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সমাজের সকল স্তরে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং বায়ুদূষণ রোধে কঠিন পদপে নিতে হবে। কেননা এই বায়ু যেমন জীবনের জন্য অপরিহার্য অনুষঙ্গ, তেমনি এর দূষণ মানুষের মৃত্যুর অনিবার্য কারণ। তাই এই নীরব ঘাতক বায়ুদূষণ যেকোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে। মূলত বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ও আগামী প্রজন্মকে সুন্দর বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে দেওয়ার লক্ষ্যে সবাই মিলে একটি দূষণমুক্ত সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ গড়তে হবে। না হয়, প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য দেশ রেখে যাওয়া সম্ভব হবে না।



ফেইসবুকে আমরা