পরিস্হিতি২৪ডটকম : সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে সমাজের মানুষের একটি সাধারণ মূল্যবোধ, যা সমাজের অধিকাংশ মানুষের রীতিনীতি, বিশ্বাস প্রথা-প্রতিষ্ঠান ও দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত। বা যে কোন সমাজের রীতিনীতি, মনোভাব এবং সমাজের অন্যান্য অনুমোদিত আচার-অচরণের সমন্বয়কেই সামাজিক মূল্যবোধ বলা হয়। সুতরাং এক কথায় বলতে গেলে সামাজিক মূল্যবোধ হলো মানুষের ন্যায় অন্যায়, স্বাচ্ছন্দ্য ও অস্বাচ্ছন্দবোধের এমন এক অনুভূতিক বিশ্বাস যা পরোভাবে মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং যে আচরণ সমাজ, ব্যক্তি, দল ও গোষ্ঠীর নিকট প্রত্যাশিত। পান্তরে সারা পৃথিবীতে শিার হার বাড়ছে, মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে: শিক্ষার সুফল যেন সমাজ পাচ্ছে না। আবার বিশ্ব সভ্যতা যান্ত্রিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, হারাচ্ছে মানবিকতা। ফলে ক্রমশই বাড়ছে সামাজিক বিশৃঙ্খলা, বাড়ছে অশ্লীলতা, নষ্ট হচ্ছে সামাজিক সম্পর্কগুলো, সমাজ হয়ে উঠছে অস্থির। মানব সমাজে পচন দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে এর বহি: প্রকাশ ঘটছে। অন্যদিকে বিশ্ব থেমে নেই, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্প, প্রযুক্তি, সভ্যতা, উন্নয়ন সবকিছুই এগিয়ে চলছে। কিন্তু সবকিছু কেমন যেন লক্ষ্যহারা হয়ে পড়েছে, যেন পথহারা পথিকের ন্যায় কোথাও ঐক্য ও সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গোটা বিশ্ব আমাদের সমাজ, মানব সমাজ। এ সমাজের অংশ হিসাবে আমাদের দেশ এবং সমাজও নানা সামাজিক অস্থিরতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। মানব সমাজের সার্বিক পরিবেশকে দুটি অংশে পৃথক করা যায়। একটি সামাজিক পরিবেশ, আর অন্যটি প্রাকৃতিক পরিবেশ। এদুটোর একটিও আর সুস্থ ও স্বাভাবিক নেই, হয়ে পড়েছে ভারসাম্যহীন। বৈজ্ঞানিক মহল থেকে এ ব্যাপারে বার বার সতর্ক সংকেত দেয়া হচ্ছে। এর পরও নষ্ট হচ্ছে মানুষের মানসিকতা, ভারসাম্য হারাচ্ছে জীবনের স্বাভাবিক গতি। এর প্রভাব সরাসরি এসে পড়ছে ব্যাক্তিগত জীবনে। অথচ সুন্দর সামাজিক জীবন সব সময়ই আনন্দময় এবং তা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ। কেননা মাঝে মাঝে সবারই একা লাগে। কিন্তু দীর্ঘদিন সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকলে বিষয়টি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ধারণা নেওয়া যাক বিচ্ছিন্ন কারা: সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতার অনেক কারণ থাকতে পারে, হয়ত কেউ তার চারপাশের মানুষের সঙ্গে মিশতে পারছে না। হয়তো তাদের জীবনযাত্রায় মিল নেই। তবে বয়স হওয়ার কারণেই একা হয়ে পড়েন বেশিরভাগ মানুষ। অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডেলেইড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অধ্যাপক ডেবি ফকনার বলছেন, “সবারই একা লাগতে পারে এবং সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হতে পারে, কিন্তু বয়স্কদের বেলায় এটি বেশি দেখা যায়।” “যখন আপনি বুড়ো হয়ে যান, আপনার রোগ বেশি হয়, সঙ্গী কিংবা কোনো ঘনিষ্ঠজনের মৃত্যুশোক সইতে হয়, চলাফেরার মতা আগের মতো থাকে না, চাকরি থেকেও অবসর নিতে হয়, এভাবে পুরনো বন্ধুত্ব জিইয়ে রাখা কিংবা নতুন বন্ধু তৈরি করাও কঠিন হয়ে যায়।” “এই সময়টা জীবনে অনেক বড় ধরনের পরিবর্তন আসে, এই পরিবর্তনের ফলে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মানুষ।” কিন্তু এই সামাজিক একাকীত্বের ফলে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি: সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতা শারীরিক এবং মানসিক – দুভাবেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন: হতাশা, উদ্বিগ্নতা এবং অল্পতেই আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি, সহজে ঘুম না আসা কিংবা অতিরিক্ত ঘুমানো, হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া কিংবা বেড়ে যাওয়া, মাদকাসক্তি, অল্পতেই কান্তি কিংবা অনুপ্রেরণার অভাব। সামাজিক একাকীত্বের নেতিবাচক প্রভাবগুলো নিয়ে প্রতিনিয়ত চলছে বিস্তর গবেষণা। অবাক করার মত বিষয় হলো একাকীত্বের ফলাফল হতে পারে আরও খারাপ কিছু। বিশ্বব্যাপী ১০০টি গবেষণার প্রতিবেদন যাচাই করে দেখা গেছে একাকীত্বের প্রভাব কতটা নেতিবাচক হতে পারে। ধর্মীয় বিধান মতে নামায রোযা হজ যাকাত দ্বীনের পালনীয় বিধান একথা কারো অজানা নয়। সকলেই জানে কিন্তু মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে সমাজজীবনে শিষ্টাচার তথা সামাজিকতা রা করে চলাও যে দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ পালনীয়- একথা কয়জনে জানে? ইসলাম সামাজিকতা শিখায়। কুরআন হাদীসের মন্ত্রে সামাজিকতা শিখতে হয়। ইসলামে তা শিখায়। শুধু শিখায় বললে ভুল হবে সমাজের নিয়মনীতি কালচার সমাজ সংস্কৃতি ও শুদ্ধতা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করে। এর বাইরে যে তথা সমাজশিষ্টাচার ও সামাজিকতা ছাড়া পরিপূর্ণ মুমিন হওয়া আদৌ সম্ভব নয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন একজন সামাজিক ব্যক্তি। আজকের সমাজ বিজ্ঞানীরা অনেক সামাজিকতার বহুনিয়মনীতি কালচার গ্রহণ করেছে তাঁর পবিত্র জীবনী থেকে। একথা অনেকে স্বীকার করে আবার অনেকে অস্বীকার করে। কু’রআন সম্পর্কে একটি প্রচলিত ধারণা হল এটি একটি উচ্চ মর্গের ধর্মীয়, নৈতিক, মহাগ্রন্থ, যাতে মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় বড়, জটিল ব্যপারগুলোই শুধুমাত্র বলা আছে। দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগে এমন ব্যপারগুলো নিয়ে কু’রআনে যা বলা হয়েছে অর্থাৎ নৈতিকতা, ব্যবহার, সামাজিকতা, পারিবারিক ও আত্মীয় সম্পর্ক নিয়ে প্রয়োজনীয় উপদেশ সমূহ যেমন আমরা কিভাবে কথা বলব, কিভাবে বেড়াতে যাবো, কি ধরণের কাপড় পড়ব, বড়দের সাথে কিভাবে আচরন করব, পারিবার ও আত্মীয় স্বজনদের সাথে কেমন সম্পর্ক গড়ে তুলব। এই উপদেশ সমূহ আমাদের এই জীবনকে একটি সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও শান্তিময় সমাজ উপহার দিতে পারে। কিন্তু ইসলামি শিক্ষা বিবর্জিত সমাজ ব্যবস্থায় সামাজিক শিষ্টাচারের গুরুত্ব মানুষের মন থেকে উঠে যাচ্ছে। স্লোগানে আর মিছিলে থাকলেও বাস্তবে সভ্য সামাজিকতার উপস্থিতি একেবারে শূন্যের কোঠায়। অবহেলা অযত্নের কারণে দিন দিন আদব লেহাজ আমাদের থেকে বিদায় নিচ্ছে। আধুনিক শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম বাপতুল্য মুরুব্বিকে তুই তোকারা করছে। সমাজের নিম্ন শ্রেণির হওয়ার সামান্য মানবিক দাবী থেকেও অসংখ্য মানব সন্তান বঞ্চিত হচ্ছে। আজ আর মুসলিম বাঙ্গালী সমাজে বয়োবৃদ্ধদেরকে সম্মানের সালাম দেওয়া হয় না। মুরব্বিকে দেখে বিনয়ের ভাব ফুটে ওঠে না। এই সমাজের মানুষ গুলোও কেমন যেন রসকসহীন রোবটের মতো হয়ে যাচ্ছে। শিষ্টাচার অর্জন করার জন্য ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব অপরীসীম। এর ফলে সুন্দর সমাজ, সমৃদ্ধ দেশ ও শান্তিময় বিশ্ব গড়ে উঠবে। কেননা জীবনের প্রতিটি ধাপেই ধর্মীয় অনুশীলনে বিকল্প নাই। এই ধর্মীয় অনুশীলনের ফলে একে অপরের প্রতি বাড়বে মমত্ববোধ, দূর হবে হিংস্রতা ও হিংসা বিদ্বেষ এবং গড়ে উঠবে সামাজিক মূল্যবোধ।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিষ্ট এবং কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি।