পরিস্হিতি২৪ডটকম : দেশপ্রেমিক বিপ্লবী মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী মুসলমান গণজাগরণের অন্যতম প্রতীক ছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তী নায়ক, প্রখ্যাত দার্শনিক, মুসলিম সাংবাদিকতার পথিকৃৎ, রাজনীতিক, সমাজসংস্কারক, শিক্ষাবিদ এবং অসাম্প্রদায়িক লেখক হিসেবে বাঙালি গণজাগরণের জন্য যিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যে বিশ্বাসী এবং উদার মানসিকতার অধিকারী ছিলেন বলেই তাঁর কাছে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই ছিল সমান। অসাম্প্রদায়িক মনোবলই তাকে মহৎ করেছিলেন। তাঁর তীক্ষ্ণ লেখনী ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। রাজশাহীর জমিদার ইউসুফ আলীর সাহায্য ও সহযোগিতায় ১৯০৪ সালে তিনি সাপ্তাহিক সুলতান পত্রিকা নিজ সম্পাদনায় প্রকাশনা শুরু করেন। ১৯০৬ সালে তিনি কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে তিনি বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। আইন অমান্য আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি বহুবার কারানির্যাতনের শিকার হন। অবিভক্ত ভারতে জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের বাংলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী ছিলেন ইসলামাবাদী। ত্রিশের দশকে তিনি বঙ্গীয় কৃষক-প্রজা দলে যোগদান করেন এবং ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে চট্টগ্রামের দক্ষীণ নির্বাচনী এলাকা থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সাথে যুক্ত থেকে বিশেষ সময়ে তিনি অতুলনীয় অবদান রেখেছেন। তিনি ইসলামী মিশন, চট্টগ্রাম কদম মোবারক এতিমখানা, আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাংলা, খাদেমুল ইসলাম সমিতি, চট্টগ্রামে জাতীয় আরবি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯১১ সালে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতায় অসামান্য অবদান রাখেন। তাঁর জন্ম চট্টগ্রাম জেলার বর্তমান চন্দনাইশ উপজেলার বরমা আড়ালিয়াচর গ্রামে। ১৯৫০ সালের ২৪ অক্টোবর এই মহান মনীষী মৃত্যুবরণ করেন। ইতিহাসের বিভিন্ন কারণে কালজয়ী মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ৬৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন। বর্তমান প্রজন্ম মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর আদর্শ চর্চার মাধ্যমে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার লক্ষ্যে ১৯৩০ সালের তাঁর একটি অভিভাষণ এর অংশবিশেষ এই প্রবন্ধে আলোচিত হলো। ১৯৩০ সালের কথা। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর প্যারেড ময়দানে ঐতিহাসিক অভিভাষণ প্রসঙ্গে একটি পর্যালোচনা। প্রাচীন চট্টগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনায় আজকের আধুনিক চট্টগ্রামের অবস্থান সম্পর্কে আমাদের এ প্রজন্মের অনেকের অজানা রয়েছে। প্রাচীন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস, ইতিহাসের বইপত্রে লিখা থাকলেও মানব অসচেতনতার কারণে ইতিহাসের অনেক প্রাচীন স্থান, স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে। ইতিহাসের এই অমূল্য সম্পদ যদি ধরে রাখা যেতো, তাহলে এই চট্টগ্রাম প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে গর্ব করে সভ্য দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই প্রাচীন চট্টগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। আজকের যে চট্টগ্রাম কিংবা চিটাগাং সেই নামের ইতিহাসও সমৃদ্ধির। প্রাচীন সময়ের চট্টগ্রাম থেকে আজকে পর্যন্ত এই প্রিয় চট্টগ্রামের নাম পরিবর্তন হয়েছে ৩৭বার। শাসন করেছেন অনেকেই। কিরাত বাঙলা থেকে বাংলাদেশ। হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের সোনালী দিন/বছরগুলো এ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা সম্ভব হলে প্রজন্ম ইতিহাস সচেতন জাতি হিসেবে যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারবে। প্রাচীন চট্টগ্রামের নামগুলো হলো: (১) আদর্শদেশ; (২) সুহ্মদেশ; (৩) কীং বা কালেন; (৪) রম্যভূমি; (৫) চিতাগাঁও, চিৎগাঁও; (৬) চট্টল; (৭) চৈত্যগ্রাম; (৮) সপ্তগ্রাম; (৯) চট্টলা; (১০) চট্টগ্রাম; (১১) চক্রশালা; (১২) চন্দ্রনাথ; (১৩) চরতল; (১৪) চিতাগঞ্জ; (১৫) চাটীগাঁ; (১৬) শ্রীচট্টল; (১৭) সাতগাঁও; (১৮) সীতাগঙ্গা; (১৯) সতের কাউন; (২০) পুষ্পপুর; (২১) রামেশ; (২২) কর্ণবুল; (২৩) সহরেসবুজ; (২৪) পার্ব্বতী; (২৫) খোর্দ্দ-আবাদ; (২৬)Porto grando (বৃহৎ বন্দর); (২৭) ফতেয়াবাদ; (২৮) আনক; (২৯) রোশাং; (৩০) ইসলামাবাদ; (৩১) মগরাজ্য; (৩২)Chittagon; (৩৩) কিরাত; (৩৪) যতরকুল; (৩৫) চক্রশা; (৩৬) কেলিশহর; (৩৭) পেন্টাপোলিস। চট্টগ্রাম মুসলমান যুব সম্মিলনীর অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি মাওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ২১শে এপ্রিল ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম কাজেমনগর (প্যারেড ময়দান)-এ অনুষ্ঠিত যুব সম্মেলনে লিখিত অভিভাষণ দিয়েছিলেন। সময়ের প্রয়োজনে সে অভিভাষণ আজ ঐতিহাসিক দলিলরূপে চিহ্নিত। ভাষণটিতে ইসলামাবাদী চট্টগ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিা, জনসংখ্যা, শিক্ষার হার, সমাজ ও দেশের রাজনীতি, মনীষীদের জীবন, চট্টগ্রামের ভৌগোলিক ইতিহাসের বিবরণ, ব্যবসা-বাণিজ্য, চট্টগ্রাম বন্দর, যুবসমাজ, মাতৃভাষার মঙ্গল, উর্দু সাহিত্য, বাংলা সাহিত্য, ফার্সি সাহিত্য, বাংলা সাহিত্যের পূর্বকথা, বাংলা সাহিত্যের উৎপত্তি, মুসলমান আগমন ও বাংলা সাহিত্য, মুসলিম সাহিত্যিক, প্রাথমিক শিক্ষা বিবরণী, নারী শিক্ষার বিবরণী, সমাজসংস্কার, সেবার রকমভেদ, হজ, জনসেবা, তৌহিদের সেবানীতি ইত্যাদি বিষয়ের উপর সারগর্ভ বক্তব্য রেখেছিলেন। প্যারেড ময়দানের ওই সম্মেলনে বাংলাদেশ-ভারত-বার্মা সহ বিভিন্ন দেশ থেকে দুই শতাধিক আলেম ওলামা, কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক, শ্রমজীবী মানুষের নেতা, কৃষকনেতা ও মুসলিম মিল্লাতের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। তাঁর অভিভাষণের একটি অংশের চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাসের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। সময়ের প্রয়োজনে এই প্রবন্ধে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর অভিভাষণের অংশবিশেষ তুলে ধরছি। তাঁর অভিভাষনের বানানরীতি ও ভাষাগত ব্যবহার যথাযথ রাখা হয়েছে। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর ওই অভিভাষণটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত “মৌলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী রচনাবলী-১ম খণ্ড”-এ প্রকাশিত হয়। যার সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, বাংলা একাডেমি, ১৯৯৩। “মুসলমান বিজয়ের পূর্বে ইতিহাস ঘোর তিমিরাবৃত। তখন প্রকৃতপে কোনো স্থায়ী শাসনশৃঙ্খলা এখানে ছিল না বললেই হয়। ত্রিপুরার হিন্দু নরপতি ও আরাকানের মগ রাজার মধ্যে এই দেশের অধিকার লইয়া সর্বদাই প্রবল দ্বন্দ্ব চলত। এজন্য উভয়ের মধ্যে অনেকবার শক্তি পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে। অবশেষে খ্রিষ্টীয় ৯ম শতাব্দীতে এই দেশ সম্পূর্ণভাবে আরকান রাজ্যের অধিকারভুক্ত হইয়া পড়ে। নাছিরাবাদ গ্রামে প্রাপ্ত একটি তাম্রলিপি হতে জানা যায়, এই দেশ ১২৪৩ খ্রি. পুনরায় ত্রিপুরা রাজ্যের হস্তগত হয়। ১৩৪০ খ্রি. সোনাগাঁয়ের স্বাধীন মুসলমান রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা ফখরউদ্দিন মোবারক শাহ সর্বপ্রথমে মেঘনা নদী পার হয়ে উত্তরে শ্রীহট্ট হতে আরম্ভ করে ত্রিপুরা ও নোয়াখালীর মধ্যে দিয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করেন। শেহাবুদ্দিন তালিশের বর্ণনা হতে জানা যায়, এই প্রদেশ সম্পূর্ণভাবে জয় করে ফখরউদ্দিন মোবারক শাহ চাঁদপুর হতে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এক প্রশস্ত রাজবর্ত্ম নির্মাণ করেন এবং এখানকার প্রায় মসজিদই তাঁর সময়ে নির্মিত হয়। এভাবে মুসলমান অধিকার থাকার পর ১৪০৭ খিৃ. ইহা আবার মগ রাজার শাসনাধীন হয়ে পড়ে। তখনও কিন্তু রাজমুদ্রার পশ্চাদ্ভাগে ফারসি অরে মুসলমান নরপতির নাম অঙ্কিত হত। আরকান পতি অল্প দিন শাসন করবার পর ইহা পুনরায় মুসলমানগণের হস্তগত হয়। রাজমালার বর্ণনাক্রমে দেখা যায়, ১৫১২ খিৃ. হোছেন শাহের সৈন্যদলকে পরাভূত করে ত্রিপুরারাজ চট্টগ্রাম জয় করেন। কিন্তু প্রকৃতপে তাঁর শাসনভার গ্রহণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। কারণ জনডিমেলভিয়ার নামক ভ্রমণকারী ১৫১৭ খ্রি. এদেশ পরিভ্রমণে এসে তখন একে আরকান রাজ্যের রাজ্যান্তর্গত দেখতে পান। ত্রিপুরাপতি কর্তৃক বিজিত হলেও উহা যে তাঁর দ্বারা শাসিত হত না, এই উক্তি হতে তাই সপ্রমাণ হয়। ১৫১৮ হতে ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে হোছেন শাহের পুত্র সুলতান নছরত শাহ পুনরায় এদেশ জয় করেন। ‘আহাদিস-উল-খাওয়ানিন (তারিখে হামেদী)’ মতে তখন হতেই চট্টগ্রাম প্রকৃত দারুল ইসলাম বলিয়া পরিগণিত হয়। এরপরে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে আরকানপতি মুসলমানের হস্ত হতে আবার চট্টগ্রাম কেড়ে নেন এবং ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত স্বীয় শাসনাধীন রাখেন। কিন্তু সম্রাট আকবরের রাজত্বে মগ কর্তৃক এই চট্টগ্রাম বিজয় অস্বীকৃত হয়। আকবরের অর্থ সচিব রাজা তোড়লমল্ল এই দেশকে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত করে, একে একটি বিশিষ্ট সরকাররূপে নির্দেশ করেন এবং এর বার্ষিক ২৮৫৬০৭ টাকা কর ধার্য করেন। ১৫১৭ খ্রি. পর্তুগিজেরা সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের স্থান লাভের চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা বিফল হয়ে যায়। তাদের দ্বিতীয়বারের চেষ্টারও কোনো ফল হয় নাই। অনেকবারের চেষ্টার পর তারা অবশেষে এদেশে বাণিজ্য এবং উপনিবেশ স্থাপনের অধিকার লাভ করে। এই অধিকার লাভের পর তারা দস্যুবৃত্তি অবলম্বন করে অত্যাচার ও উপদ্রব করতে আরম্ভ করে। তার ফলে চট্টগ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী স্থানসমূহ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে উঠে। তাদের বিষদন্ত ভঙ্গ করবার মানসে সন্দ্বীপের শাসনকর্তা ফতে খাঁ অগ্রসর হয়ে পরাজিত ও নিহত হলেন। এরপর পতুর্গিজরা সিবেস্টিয়াম গঞ্জালিসকে সন্দ্বীপের শাসনকর্তার পদে প্রতিষ্ঠিত করে তা শাসন করতে থাকে। এর কিছুকাল পরে আরকান পতি, পর্তুগিজ ও মোগলদের মধ্যে মেঘনার তীরে এক ভীষণ সংঘর্ষ উপস্থিত হয়। তাতে পর্তুগিজরা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়। গঞ্জালিস কোনোরূপে প্রাণ নিয়ে সন্দ্বীপে পলায়ন করেন। পরবর্তী বৎসর আরকানরাজ সন্দ্বীপ আক্রমণ করে গঞ্জালিসকে পরাজিত এবং সন্দ্বীপ অধিকার করে নেন। এই সময় হতে মগেরা সন্দ্বীপ ও পার্শ্ববতী দ্বীপসমূহকে আপনাদের দুর্গরূপে ব্যবহার করতে লাগল। তখন হতে নির্গত হয়ে তারা পার্শ্ববর্তী জনপদসমূহ লুণ্ঠন করত এবং হতভাগ্য অধিবাসীগণকে ধৃত করে দাসরূপে বিক্রয় করত। আরাকানের রাজ মতা তখন গৌরবের উচ্চতম শিখরে আরোহন করছিল। মগ সৈন্যেরা সর্বদাই নিু বাংলার সমতল ক্ষেত্র লুণ্ঠন করে তাদের বর্বর প্রকৃতির তৃপ্তি সাধন করত। এ সকল কারণে বাধ্য হয়ে অবশেষে বাংলার রাজধানী রাজমহল হতে ঢাকায় স্থানান্তরিত করতে হয়। মগ ও পর্তুগিজদের ভয়ে পদ্মা ও মেঘনার বক্ষ সুবিশাল নৌবহর দ্বারা সুরতি রাখা হতো। কিন্তু প্রথমে তাতেও কোনো ফলোদয় হয় নাই। রাজ প্রতিনিধি কাছেম খাঁ এবং আজিম খাঁ সীমান্ত প্রদেশ শাসনে অকৃতকার্য হয়ে বিশেষ অপযশ ভাজন হন। অবশেষে ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম খাঁ মাসহাদী কঠোর হস্তে মগ ও পর্তুগিজদের অত্যাচার দমন করেন। তারই চেষ্টায় ওদের প্রভাব সম্পূর্ণ খর্ব হয়। প্রসিদ্ধ আরকান রাজ প্রতিনিধি মুকুটরায় (যাঁর অধস্তন বংশীয়েরা এখন কধুরখীল নামক গ্রামে বাস করছেন।) মোগলের অধীনতা স্বীকার করে বাংলার নবাবের হস্তে এর শাসনভার অর্পণ করেন। এই সময় হতে চট্টগ্রামে মুসলমান শাসনের দিন গণনা হলেও প্রকৃতপক্ষে নবাব শায়েস্তা খাঁর আমলে ১৬৬৬ খ্রি. তা মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। মগদের অত্যাচার ক্রমে এতই বৃদ্ধি প্রাপ্ত হচ্ছিল যে, অবশেষে এর মাত্রাধিক্যের ফলে ১৬৬১ খ্রি. আরকানের রাজা সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র হতভাগ্য সুলতান শাহ সুজাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। এই হতভাগ্য রাজেন্দ্র তনয়ের বঙ্গদেশ হতে বিতাড়িত হওয়ার কথা আপনারা জানেন। কথিত আছে, শাহসুজা মক্কাগামী কোনো জাহাজের দর্শন লাভাশায় এখানে পালিয়ে আসেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তখন বন্দরে কোনো জাহাজ উপস্থিত ছিল না বলে গত্যন্তর অভাবে অবশেষে আপন অদৃষ্টের উপর নির্ভর করে আপন অনুচরদিগেেক বিদায় প্রদান করত স্বীয় পরিজন সমভিব্যবহারে আরকান অভিমুখে যাত্রা করেন। নাফ নদী পার হয়ে আরকান সীমান্তে উপনীত হলে এই হতভাগ্য রাজেন্দ্র সুত বর্বর মগরাজের হস্তে সপরিবারে প্রাণ হারান। এই দুর্ঘটনার তিন বৎসর পরেই চট্টগ্রাম মোগলদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সম্ভবত মগ এবং মোগল রাজ্যের সীমান্ত নির্দেশের এবং শাহসুজার হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ গ্রহণের সুবিধার্থই নবাব শায়েস্তা খাঁ জলদস্যু বিনাশকল্পে ঢাকা হতে হোছেন বেগ নামক সেনাপতির অধিনায়কতায় জলপথে তিন সহস্র সৈন্য এবং স্বীয় পুত্র বুজর্গ উমেদ খাঁর অধীনতায় স্থল পথে দশ সহস্র সৈন্য মগদের শাসনার্থে চট্টগ্রামে প্রেরণ করেন। এই বিশাল নৌবহর প্রথমে যুগদিয়া নামক স্থানে এসে উপনীত হয়। পরে তথা হতে তা আলমগীর নগর হয়ে অবশেষে দস্যুর আবাসভূমি সন্দ্বীপে উপস্থিত হয় এবং অসতর্ক দ্বীপবাসীদিগকে সহজেই পরাজিত করতে সমর্থ হয়। পরে দুর্গাধিকার করে হোছেন বেগ চট্টগ্রামে আরকান রাজের পক্ষে নিযুক্ত পর্তুগিজদিগকে নানা প্রলোভনে স্বপভুক্ত করবার চেষ্টা করেন। এই সংবাদ শ্রবণে আরকানপতি তাদেরকে তরবারি মুখে হত্যা করতে কৃতসঙ্কল্প হয়ে চট্টগ্রাম অভিমুখে যাত্রা করলে পর্তুগিজেরা প্রাণভয়ে সন্দ্বীপে পলায়ন করে এবং হোছেন বেগের আশ্রয় গ্রহণ করে। তিনি তাদের মধ্য হতে সম ব্যক্তিদেরকে আরকানরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নিযুক্ত করেন এবং অবশিষ্ট লোকদেরকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। ঢাকায় ফিরিঙ্গবাজারে আজও তাদের বংশধরেরা বাস করতেছে। এদিকে উমেদ খাঁর সৈন্যদল ফেনী নদীর তীরে উপনীত হলে আরকান সৈন্যেরা তাদেরকে বাধা প্রদান করে। কিন্তু পরাজিত হয়ে চট্টগ্রামে পলায়ন করতে বাধ্য হয়। পরে হোছেন বেগমও সসৈন্যে এসে উমেদ খাঁর সঙ্গে কুমারীয়ার নিকট সম্মিলিত হন। আরকান সৈন্যেরা মোগলদের আক্রমণে এবং অবিরাম কামান বর্ষণে বিপর্যস্ত হয়ে সম্যকরূপে পরাজিত হয়। তারপর এই সম্মিলিত সৈন্য গ্রাম অভিমুখে যাত্রা করে তার অধিকার কার্যে ব্যাপৃত হয়। তার ফলে এবার চট্টগ্রাম চিরদিনের জন্যই মুসলমানের হস্তগত হয় এবং মগ ও পর্তুগিজদের প্রভাব এই দেশ হতে সমূলে বিনষ্ট হয়। উমেদ খাঁ ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে একে বঙ্গরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে এর ‘ইসলামাবাদ’ নামকরণ করেন। এটাই চট্টগ্রামে ইসলামের অর্ধচন্দ্রলাঞ্ছিত বিজয় নিশান উত্থিত ও মুসলমান শাসন প্রবর্তিত হবার সংপ্তি ইতিহাস। অতপর চট্টগ্রাম মোগল প্রতিনিধিগণের দ্বারাই শাসিত হয়। শুনিবার জন্য আপনাদের আগ্রহ হতে পারে বিবেচনা করে এস্থলে তাঁদের নামগুলো উল্লেখ করলাম: (১) নওয়াব বুজুর্গ উমেদ খান; (২) নওয়াব আস্কর খান; (৩) নওয়াব রসিদ খান; (৪) নওয়াব বুজুর্গ উমেদ খান (২য় বার); (৫) নওয়াব ফরহাদ খান; (৬) নওয়াব জাফর খান; (৭) নওয়াব মুজাফফর খান; (৮) নওয়াব ফেদাই খান; (৯) নওয়াব নুরউল্লা খান; (১০) নওয়াব এয়াকুব খান; (১১) নওয়াব রহমতউল্লা খান; (১২) নওয়াব আকিদত খান; (১৩) নওয়াব রহমতউল্লা খান (২য়বার); (১৪) নওয়াব বশারত খান; (১৫) নওয়াব সরবোলন্দ খান; (১৬) নওয়াব মুর্শিদ কুলী খান; (১৭) নওয়াব আলীবেগ খান; (১৮) নওয়াব মির্জা বাকের; (১৯) নবাব ফিদবি হোসেন খান; (২০) নবাব হোসেন মহম্মদ খান; (২১) দেওয়ান মণিরাম; (২২) নবাব জোলকদর খান; (২৩) নবাব মীর মোহাম্মদ রেজাখান; (২৪) নবাব সেরাজ উদ্দিন মোহাম্মদ খান; (২৫) নবাব মীর আফজল; (২৬) নবাব হাসন কুলী খান; (২৭) নবাব সদাকত খান; (২৮) নায়েব মহীসিংহ; (২৯) নবাব আকা মোহাম্মদ নেজাম; (৩০) নবাব মীর মোহাম্মদ রেজা খান (২য় বার)। এই সকল নবাবের নানা কীর্তি চট্টগ্রামের বরে উপর শোভা পাচ্ছে। এই সভাগৃহের কিছুদূরে যে প্রস্তরনির্মিত সুবৃহৎ জুমা মসজিদ উন্নত মস্তকে ইসলামের মাহাত্ম্য ঘোষণা করছে, তা নবাব বুজুর্গ উমেদ খাঁর প্রতিষ্ঠিত ওয়ালী বেগ খাঁ মসজিদ শহরের উত্তর দিকে ‘আস্করতালাও’ নামক প্রকাণ্ড দিঘী ও আস্করাবাদ গ্রাম নবাব আস্কর খাঁর নাম কীর্তন করছে। শহরের বরে উপর ঘাটফরাদবেগ ও রহমতগঞ্জ নামক পল্লীদ্বয় নবাব ফরহাদ খান ও রহমতউল্লাহ খাঁর নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত। জোলাপাড়া গ্রামের মসজিদ ও তার নিকটবর্তী দিঘী নবাব আকিদত খাঁর ও দেওয়ান মোহাম্মদ খাঁর কীর্তি। নওয়াব মুর্শিদ কুলী খাঁ প্রথমে চট্টগ্রামের ফৌজদার ও থানাদার ছিলেন ও পরে চট্টগ্রামের নওয়াবও বাংলার সুবাদার হন। নওয়াব রহমতউল্লা খাঁর দ্বিতীয়বার শাসনকাল হতে নওয়াবের সহকারী একজন নায়েবও নিযুক্ত ছিলেন। নওয়াব মুর্শিদ কুলী খাঁ চট্টগ্রামের শেষ নওয়াব। তাঁর পরবর্তীকালে আর নওয়াব ছিলেন না। কেবল নায়েবই দেশ শাসন করতেন। মুর্শিদ কুলী খাঁর নায়েব নওয়াব এয়াছিন খাঁর অমর কীর্তি কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ। ওটা জুমা মসজিদের অদূরে অবস্থিত। আপনারা এই পবিত্র কদম মোবারক দেখে পুণ্যার্জন করে যাবেন। যে সুদৃশ্য ও সুবৃহৎ হর্মে এয়াছিন খাঁ চিরন্দ্রিায় শায়িত, তাহা এখন ভেঙে গেছে। সেই নয়নরঞ্জন স্থান এখন শ্মশানবৎ প্রতীয়মান হবে। চকবাজার ও কাতালগঞ্জের সম্মিলন স্থলে নির্মিত প্রকাণ্ড মসজিদ ও ওটার সম্মুখস্থ দিঘী নওয়াব অলী বেগ খাঁর কীর্তি। তাঁর বংশ আজও এ শহরে অজ্ঞাতভাবে বিদ্যমান আছে। আজ তাঁরা হীনদশায় জীবনযাপন করছেন। নওয়াব অলী বেগ খাঁর কবর জীর্ণাবস্থা ও লতাগুল্মাবৃত হয়ে আজও এনায়েতবাজারে আপন অস্তিত্ব রা করছে। মির্জা বাকের ১৭৫৩ খ্রি. স্বীয় নামে বাকেরগঞ্জ জেলার নামকরণ করেন। চট্টগ্রামের শাসনকর্তা হয়েও তিনি সাধারণত ঢাকায় অবস্থান করতেন ও ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে তথায় নিহত হন। আমাদের ‘বাকরখানী রুটি’ এরই নাম বহন করছে। অলীবেগ খাঁর দেওয়ান মণিরামের নামে ‘মণিরামবাগ’ নামক গ্রাম স্থাপিত। পরে ইনি নায়েব হয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁকে ‘থানাদার’ বলা হতো। জোলকদর খাল আজও জোলকদর খাঁর নাম ঘোষণা করছে। ১৭৫৪-৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দেওয়ান নানসিংহ চট্টগ্রাম শাসন করেন। এখানকার দেওয়ান বাজার তাঁরই স্থাপিত। তিনি হাজারীদের প্রভাব বিচূর্ণ করে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। দ্বাদশ জন হাজারীর মধ্যে দশজনকে বন্দিকৃত করে তিনি মুর্শিদাবাদে প্রেরণ করেন। অবশিষ্ট দুই হাজারীর বংশধরগণ অদ্যাপি ‘দোহাজারী’ গ্রামে বাস করছেন। চট্টগ্রামে যত লাখেরাজ সম্পত্তি আছে, তৎসমস্তই দেওয়ান মানসিংহের প্রদত্ত। তিনি ফটিকছড়ির অন্তর্গত কাঞ্চননগরে স্বীয় বসতি স্থাপন করেন। তাঁর পরে আকা মোহাম্মদ নেজাম নায়েব হন। নেজামপুর পরগণা এর পরে সুপ্রসিদ্ধ। মোহাম্মদ রেজা খাঁ ঢাকা হতে চট্টগ্রাম শাসন করেন। তিনি বাদশাহী আমলের শেষ নায়েব। এভাবে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোগলদের অর্ধচন্দ্রলাঞ্ছিত পতাকাতলে অবস্থিত থেকে চট্টগ্রাম অবশেষে নির্বিরোধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হস্তগত হয়। আপনারা জানেন, সেই বৎসরই মীর জাফর খাঁ সিংহাসন-চ্যুত এবং তদীয় জামাতা মীর কাশেম আলী খাঁ বাংলার নওয়াব নিযুক্ত হন। এই পদ প্রাপ্তির পুরস্কার স্বরূপ নওয়াব মীর কাশেম কোম্পানিকে বর্ধমান, মেদিনীপুর এবং চট্টগ্রাম প্রদান করেন। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই অক্টোবর তারিখে মীর কাশেমের প্রদত্ত সনদে উল্লিখিত আছে যে, ‘নওয়াব সরকারের সাহায্যার্থে ৫০০ সমাজবৎসল চেয়ারম্যান মৌলভী নুর আহমদ এমএ, বিএল এর প্রাপ্য। খোদাতাআলা এই স্বদেশ বৎসর সমাজহিতৈষী ব্যক্তিকে দীর্ঘজীবী করিয়া দেশের ও দশের মঙ্গল বিধান করুন।” উপরোক্ত বক্তব্য প্রদানকারী মনীষী মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান চন্দনাইশের বরমা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আমিও চন্দনাইশ উপজেলার সাতবাড়িয়ায় জন্ম নেওয়া সন্তান। ১৯৯৩ সাল থেকে ইসলামাবাদী গবেষণার সাথে জড়িত। ঐতিহাসিক এই ব্যক্তিত্বের উপর আমার দুটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। একটি ২০১২ সালে ‘মনীষী মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী’, অন্যটি ইসলামাবাদীর ৬৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলে ২০১৭ সালে ‘মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী পাইওনিয়ার অব মুসলিম রেনেসাঁ’। আলোচিত এই বইগুলোর মাধ্যমে ইসলামাবাদী ও তাঁর জীবনকর্ম বর্তমান প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষে এটিকে পবিত্র দায়িত্ব মনে করেছি। আজকের বাঙালি মুসলমান সমাজ হয়তো ভুলে গেছে একসময়ের ভারতীয় উপমহাদেশে বিখ্যাত এই মনীষী ছিলেন বাঙালি মুসলমান সন্তান দ্বারা সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা দৈনিক হাবলুল মতিন এর বাংলা সংস্করণের প্রথম সম্পাদক ছিলেন মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী। সে কারণে বলা হয় বাঙালি মুসলমানের সংবাদপত্রের প্রথম সম্পাদক মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী। সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক ইতিহাসেও তিনি স্মরণীয় মানুষ। তাঁর ৬৯তম মৃত্যুবার্ষিকী গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।
লেখক : সোহেল মো. ফখরুদ-দীন, সভাপতি, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র (সিএইচআরসি)
বহু গ্রন্থ প্রণেতা, চট্টগ্রাম।