পরিস্হিতি২৪ডটকম : সোমবার (১৭ ডিসেম্বর) একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের আহ্বানে এক টেবিলে মতবিনিময় সভায় বসেছিলেন চট্টগ্রামের সব প্রার্থী।
চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের প্রার্থীদের সঙ্গে আলাদা মতবিনিময় সভায় মিলিত হন দুই রিটার্নিং কর্মকর্তা বিভাগীয় কমিশনার মো. আব্দুল মান্নান এবং জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন।
এসময় নানা অভিযোগ করে বিএনপির প্রার্থীরা বলেন, নানা জায়গায় হামলার ঘটনায় ভোটারদের মনে শঙ্কা বিরাজ করছে।
এদিকে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বলেন, চট্টলায় নির্বাচনের পরিবেশ জমে উঠেছে। এখানকার জনগণ ভোট উৎসবে অংশ নিতে মুখিয়ে আছে।
অন্যদিকে, ভোটের মাঠ আরও সুষ্ঠু রাখতে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে নানা পরামর্শ দিয়েছেন কেউ কেউ।
জেলা সার্কিট হাউজে চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুন্ড-কাট্টলী), চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী), চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও), চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি-বাকলিয়া), চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-হালিশহর) এবং চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনের প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা বিভাগীয় কমিশনার।
আর বাকি ১০টি আসনের প্রার্থীদের সঙ্গে নিজ কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে মতবিনিময় করেন জেলা প্রশাসক।
এসময় চট্টগ্রাম-৮ আসনের বিএনপির প্রার্থী আবু সুফিয়ান বলেন, আমার নির্বাচনি এলাকা চান্দগাঁওয়ের পাঁচটি ওয়ার্ডে তাণ্ডব চলছে। প্রতিদিন রাতে পুলিশ যাচ্ছে। বাড়িঘরে হামলা হচ্ছে, নেতাকর্মীদের ভয় দেখাচ্ছে। আমরা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই।
চট্টগ্রাম-১০ আসনের বিএনপি প্রার্থী আবদুল্লাহ আল নোমান নগরীর নয়াবাজারে বিজয় দিবসের র্যালিতে হামলার অভিযোগ করে বলেন, তারা আমাকে গুলি করার জন্য উদ্যত হয়েছিল। পত্রিকায় এসেছে কিনা জানি না, তবে আমার কাছে ছবি আছে। আমি পুলিশের কাছে জীবন বাঁচানোর জন্য আবেদন করেছিলাম। এক ঘণ্টা পর পুলিশ এসে আমাদের উদ্ধার করে।
তিনি আরও অভিযোগ করে বলেন, আমার পোস্টার-ব্যানার কেটে ফেলা হচ্ছে। শুধু আওয়ামী লীগের কর্মীরা করছে সেটা বলছি না, পুলিশও ধানের শীষের পোস্টার-ব্যানার দেখলে কেটে ফেলে দিচ্ছে। নির্বাচন করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। মানুষের মধ্যে শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ছে। পুলিশে একটু অদল-বদল করেন। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠান।
চট্টগ্রাম-১১ আসনের বিএনপির প্রার্থী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা কেন পার্টি হচ্ছেন? আমরা তো আপনাদের সম্মান করি, আপনাদের বিশ্বাস করি। আপনারা কেন রাজনৈতিক দলের পক্ষ নেবেন? দয়া করে গ্রেপ্তার অভিযানটা বন্ধ করুন।
তিনি বলেন, অব্যাহত হামলার মাধ্যমে সারাদেশেই একটা ভয়ের পরিবেশ কায়েম হয়েছে। মানুষের মধ্যে প্রশ্ন, ভোট দেয়া যাবে কি-না? বিএনপির নেতাকর্মীদের হুমকি দেয়া হচ্ছে- এলাকা ছেড়ে চলে যাও। গায়েবি মামলা দেয়া হচ্ছে। ৩০ তারিখের আগেই যেন সব বিচার শেষ করে ফেলা হবে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, বিএনপির প্রার্থীরা ভোটারদের মধ্যে ভয়ভীতি থাকার কথা বলছেন। আমার নির্বাচনি এলাকায় তো আমি ভোটারদের মধ্যে কোন ভয় দেখছি না। এলাকায় সব প্রার্থীর পোস্টার আছে। ২০০৫ সালের নির্বাচনে (সিটি করপোরেশন নির্বাচন) গুলি করে শ্রমিকলীগের ছয়জন নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আমরা তো ভয়ভীতির কথা বলে নির্বাচন থেকে সরে যাইনি।
‘আসলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহতের নামে ওনারা যে তাণ্ডব চালিয়েছিলেন, ৫০০ লোককে পুড়িয়ে হত্যা করেছিলেন, মানুষের মধ্যে ভয় থাকলে সেজন্যই আছে। এছাড়া যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি দল এখন বিএনপির সঙ্গে মিশে গেছে। সেজন্যও মানুষের মধ্যে ভয় আছে।’
নওফেল এই বক্তব্য দেয়ার সময় আমীর খসরু প্রতিবাদ করে বলেন, ‘এসব রাজনৈতিক বক্তব্য। এটা রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়ার জায়গা নয়।’
নওফেল বলেন, ‘আপনারা রাজনৈতিক অভিযোগ আনতে পারলে আমরা কেন বলতে পারব না?’
রিটার্নিং কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান প্রসঙ্গ পাল্টানোর অনুরোধ করলে নওফেল বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে অপপ্রচার হচ্ছে। বিশেষ করে নারীদের বলা হচ্ছে, ইভিএম নাকি খুব কঠিন। এটাতে ভোট দিলে নাকি একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রার্থীই শুধু জিতবেন। এই অপপ্রচার বন্ধে নির্বাচন কমিশনকে পদক্ষেপ নিতে হবে।’ একই আসনে বিএনপির প্রার্থী কারাবন্দি ডা. শাহাদাত হোসেনের প্রতিনিধি এস এম বদরুল আনোয়ার প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ইভিএম’র পাশাপাশি ব্যালট পেপারও রাখার প্রস্তাব করেন।
বিএনপির প্রার্থীদের অভিযোগের প্রসঙ্গ টেনে বোয়ালখালী-চান্দগাঁও আসনের নৌকা মার্কার প্রার্থী মঈনউদ্দিন খান বাদল বলেন, ‘মতের ভিন্নতা নিয়েই তো আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে এসেছি। তারা বলবে নির্বাচনের পরিবেশ নেই। আমরা বলব, আছে। তারা বলবে মানুষের মধ্যে ভয় আছে। আমরা বলব, নেই। প্রার্থীর সঙ্গে প্রার্থীর এই মতভিন্নতা না থাকলে আমরা পরস্পরের বিরুদ্ধে নির্বাচন করছি কেন?’
তিনি বলেন, ‘আমরা যারা প্রার্থী, আমাদের প্রতিদিন একজনের সঙ্গে আরেকজনের দেখা হবে। আমরা বাঙালি। এই বাঙালিদের দেশ একটাই। সুতরাং একটা নির্বাচনের কারণে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে না।’
তবে বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে একজন চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনের এনামুল হক এনাম বলেছেন, ‘তিনি এলাকায় কোন বাধা পাচ্ছেন না। নির্বিঘ্নে প্রচার চালাতে পারছেন।’
হাটহাজারী আসনে মিনার প্রতীকের প্রার্থী মাঈনুদ্দিন রুহী বলেন, ‘সারাদিন ভোট দেয়ার পর রাতে যাতে ফলাফল পাল্টে না যায়, সেটার ব্যবস্থা করতে হবে।’ চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনে সিপিবির প্রার্থী মো. সেহাবউদ্দিন অভিযোগ করেন, ‘শনিবার (১৬ ডিসেম্বর) প্রচার চালানোর সময় ১০০-১৫০ জন যুবক মোটরসাইকেলে শোডাউন করে তাদের কাছাকাছি এসে উসকানিমূলক বিভিন্ন স্লোগান দেন। এসময় ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় তিনি প্রচার না চালিয়ে ফেরত আসতে বাধ্য হন। নির্বাচন কমিশনের কাছে নিরাপত্তা দাবি করেছেন সেহাবউদ্দিন।’
মতবিনিময় সভায় আঞ্চলিক ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, রেঞ্জ, জেলা ও নগর পুলিশের ঊর্র্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বক্তব্য রাখেন।
দুই রিটার্নিং কর্মকর্তা প্রার্থীদের অভিযোগ শোনেন এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিকারের আশ্বাস দেন। তারা প্রার্থীদের আচরণবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন।