পরিস্হিতি২৪ডটকম : বরাবরের মত আজ (৬ মার্চ) পালিত হচ্ছে ‘ওয়ার্ল্ড ডেন্টিস্ট ডে’ বা বিশ্ব দন্ত্য চিকিৎসক দিবস। মানুষকে সচেতন করতে এই দিনটি সারা বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে বাংলাদেশেও ব্যাপক আয়োজনে পালিত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক ডেন্টাল সংগঠন এফডিআই ২০০৭ সাল থেকে ২০ মার্চ ওয়ার্ল্ড ওরাল হেলথ ডে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশে এ দিবসটি ধারাবাহিকভাবে পালিত হচ্ছে। মূলত এই দিবসটিতে বিশ্বের জনগণকে মুখের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতনতার লক্ষ্যে আহ্বান জানানো হচ্ছে। দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরতে আন্তর্জাতিক ডেন্টাল সংগঠন বিএফডিএস উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। আর ওয়ার্ল্ড ডেন্টিস্ট ডে পালনের মাধ্যমে চিকিৎসকদের একত্রিত করে তাদের মধ্যকার সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধিতে এবং নিজেদের মধ্যে একাডেমিক কার্যপ্রক্রিয়া আদান-প্রদান করছে। সেই সঙ্গে সমগ্র বিশ্বের জনগণকে মুখের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতনতার লক্ষ্যে আহ্বান জানাচ্ছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরতে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ডেন্টাল এসোসিয়েশন একধরনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আসছে। সংগঠনটি বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে মার্চব্যাপী দেশের সাধারণ জনগণের মুখের স্বাস্থ্য রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে কার্যকরী পদক্ষেপ চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের দেশে বৈধ প্রায় ১৩০০০ জন ডেন্টাল চিকিৎসকের পাশাপাশি প্রাথমিক দন্ত চিকিৎসকরা (প্রায় লক্ষাধিক) দন্ত চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও সংগঠনটির সদস্যদের মাঝে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ডেন্টাল এসোসিয়েশন ডেন্টাল প্রফেশনের মানোন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। মুখের রোগ প্রতিরোধে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে ফ্রী ডেন্টাল চেকআপসহ চিকিৎসা ক্যাম্প পরিচালনা করে আসছেন। স্বীকার করি, কোনো রোগের চিকিৎসার চেয়ে তার প্রতিরোধ ব্যবস্থা জানা অধিকতর কার্যকরী ও জরুরি। দাঁত যে কত প্রয়োজনীয় সেটা আমরা সবাই জানি। বিশেষ করে যাদের দাঁত নেই তারা ভাল বুঝবে। এই দাঁতকে যারা সুস্থ রাখে তারা হল সেই মহান ডেন্টিস্ট বা দন্ত চিকিৎসক নামে পরিচিত। তাই আমি একজন প্রাথমিক দন্ত চিকিৎসক হিসাবে মানুষের সেবায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকতে পেরে নিজেকে আনন্দিত বোধ করছি। সাধারণত দাঁত মানুষের অন্যতম সৌন্দর্য্যরে অংশবিশেষ। দাঁতের প্রাথমিক কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দাঁত প্রকৃত চর্বণের মাধ্যমে খাবারকে হজম উপযোগী করে। ফলে দেহ পর্যাপ্ত পুষ্টি পায়। ব্যক্তিত্ব প্রকাশে, স্মৃতিশক্তি ধরে রাখতে, কর্মচঞ্চলতা ও বিষণ্নতা দূর করতে দাঁতের অবদান রয়েছে। তাছাড়াও স্থায়ী দাঁতের পাশাপাশি দুধদাঁতের গুরুত্ব রয়েছে। দুধদাঁতের পরিচর্যার মাধ্যমে তার পড়ে যাওয়ার নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত যত্ন নিতে হবে। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের কারণে আমরা প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক খাবারের পরিবর্তে কৃত্রিম খাবারের দিকে ঝুঁকে পড়ছি, ফলে শরীরে নানাবিধ রোগের পাশাপাশি মুখগহ্বরেও বাড়ছে রোগের প্রাদুর্ভাব। আমাদের উচিত দাঁত বা মুখগহ্বরের যে কোনো অস্বাভাবিকতা অনুভবের শুরুতেই অবহেলা না করে অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ব্যবস্থাপনায় না গিয়ে সরাসরি একজন ডেন্টাল চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া। কেননা বিজ্ঞানীদের মতে দেহের বেশিরভাগ রোগের প্রভাব বা লক্ষণ মুখ গহ্বরে প্রথমে আসে। যেমন ধরুন দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলেই মুখের ভেতরে তার নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। দেহের এই ইমোনিটি সিস্টেম বা প্রতিরোধ ক্ষমতা আমাদের দেহকে বাইরের রোগজীবাণু থেকে রক্ষা করে। তবে এই প্রতিরোধ ক্ষমতা নানা কারণে কমে যেতে পারে, যেমন, দেহের অন্যান্য রোগ, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, শরীরে কৃত্রিমভাবে স্থাপিত অঙ্গসমূহের জন্য নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ অথবা ক্যান্সার রোগীদের জন্য নিয়মিত গ্রহণ করা কেমোথেরাপি ইত্যাদি। তাছাড়া দেহের অন্যান্য রোগের জন্য গ্রহণ করা নিয়মিত ওষুধ যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, হাঁপানি, পেটের বা হার্টের অসুস্থতা ইত্যাদি। এসব রোগের বেশির ভাগই ওঠে মুখের ভেতরে মুখকে শুকিয়ে শুষ্ক করে দেয় ফলে দেখা দেয় ডিহাইড্রেশন বা যাকে বলা হয় ড্রাই মাউথ (উৎু গড়ঁঃয)। মুখের এই শুষ্কতার জন্য দেখা দেয় নানান রোগ। যেমন ডেন্টাল ক্যারিজ বা দন্তক্ষয় সে সঙ্গে জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া বিস্তারও ঘটে। এর ফলে মুখের স্বাদ বা টেস্ট (ঃধংঃব) নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ডেন্টিস্ট বা দন্তরোগ বিশেষজ্ঞ মুখ পরীক্ষা করার সময় এমন অনেক রোগও শনাক্ত করেন। যে সব রোগের উপস্থিতি রোগী নিজেরাও বুঝতে পারে না। তাই এসব লক্ষণ দেখা দেওয়া মাত্র মেডিকেল বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করেন। আর অযত্ন অবহেলায় দাঁতের সুস্থতা নষ্ট হয়। সাথে বাড়ে রোগব্যাধির প্রকোপ। যেমন আমরা প্রতিদিন শর্করা জাতীয় যে খাবারসমূহ খাই সেসব খাবারের কণা মুখের ভেতরে লালার উপস্থিতিতে জীবাণুরা ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম হয়। এর ফলে মাড়িতে প্রদাহ হয়, পুঁজ জমা হয়, দাঁত ক্ষয় হয়। একসময়ে দাঁত পড়ে যেতে পারে। আমাদের বদ্ধমূল ধারণা, সাধারণ বয়স হলে দাঁত পড়বে। কিন্তু তা ঠিক নয়। সে জন্যে দাঁতের প্রতি অবহেলা না করে নিয়মিত দাঁতের যত্ন নিতে হবে। প্রদাহ, মাড়ি ফোলা, রক্ত পড়ার মতো কোনো সাধারণ অসুখ দেখা দিলে তাকে অবহেলা না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। কেননা এই সামান্য অবহেলা পরবর্তীতে অসংখ্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি প্রাণসংহারের মতো অঘটন ঘটাতে পারে। বাড়াতে পারে নানান জটিল ও কঠিন রোগ। কারণ দেহের অনেক রোগই মুখের ভেতরে প্রাথমিক সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। যাদের দীর্ঘস্থায়ী রোগ বা সারাজীবনের রোগ আছে যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ তাদের অবশ্যই নিয়মিতভাবে মুখ ও দন্তরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। কারণ মুখের অনেক সমস্যাই দেহের অন্য রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বা সুস্থ রাখতে অসুবিধার সৃষ্টি করে। অতএব মাড়ির ও দাঁতের সুস্থতা নিয়ন্ত্রণ করা এক্ষেত্রে অবশ্যই প্রয়োজন। শরীরের সঙ্গে মনের সম্পর্ক সম্বন্ধ নিয়ে আমরা হয়ত অনেককিছুই জানি। কিন্তু মুখের সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক নিয়ে কতটুকু জানি। অনেকের কাছে ডেন্টাল ক্লিনিকে আসা মানেই হচ্ছে দাঁত ও মাড়ি পরিষ্কার করা (ঝপধষরহম), দাঁত তুলে ফেলা (ঊীঃৎধপঃরড়হ) অথবা দাঁতের ফিলিং করা। তবে ডেন্টাল ক্লিনিকে বা হাসপাতালে যাওয়া শুধু মাত্র দাঁতের জন্যই নয়। এটা সম্পূর্ণ দেহের জন্য। কারণ যা কিছু মুখে ঘটুক না কেন তার প্রভাব দেহের উপরও পড়ে। অনুরূপভাবে দেহের যে কোনো অঙ্গ রোগাক্রান্ত হলে তার প্রভাবও মুখের উপর আসে। বিভিন্ন গবেষণা ও তথ্য থেকে পাওয়া বাস্তবতা হলো মুখের স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে বা রোগাক্রান্ত থাকলে দেহে বিভিন্ন রোগ দেখা দিতে পারে। যেমন হৃদরোগ, আলজিমারস রোগ, শ্বাসকষ্টজনিত রোগ, ডায়াবেটিস, পেটের হজম ও শিশুদের আচরণ বা বেড়ে উঠতে অসুবিধা ইত্যাদি। এছাড়াও দাঁতের অসুখ হলে মানসিক বিপর্যয়ও ঘটতে পারে। যেমন মানসিক অসুস্থতার প্রধান অনুভূতির মধ্যে অন্যতম, দীর্ঘদিন দুঃখবোধ, বিষণ্নতা, দুঃখ-কষ্ট-বিরক্তি, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, ঘুমের পরিবর্তন, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। আর এর ফলে মানসিক চাপ পড়ে। এই সমস্যাগুলো থেকে রক্ষায় দাঁতের অবশ্যই যত্ন নিতে হবে। কেননা শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার সঙ্গে দাঁতের যোগসূত্রও রয়েছে। চিকিৎসাসেবা সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে বিকশিত হচ্ছে। আমরা আশাবাদী, যতই মানুষ সভ্য হবে, মানুষ যত শিক্ষিত হবে মুখ ও দাঁত নিয়ে তাদের সচেতনতা বাড়বে। বাংলাদেশের মানুষ দিন দিন যতই উন্নতির দিকে যাচ্ছে ততই সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সচেতনতার সাথে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা রক্ষায় দাঁতের যত্ন নিতে হবে। এ বিষয়টিকে মোটেই অবহেলা করা উচিত হবে না। এবারের ওয়ার্ল্ড ডেন্টিস্ট দিবসে প্রত্যাশা রাখব, সুস্থ সুন্দর জীবন গড়তে দাঁতের যত্ন নিতে আমরা কার্পণ্য করব না। করব না কোনো ধরনের অবহেলা। ওয়ার্ল্ড ডেন্টিস্ট দিবসে সকলের প্রতি শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি। দিবসটি উদ্যাপনের সফলতা কামনা করছি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও পরিবেশ উন্নয়নকর্মী, সাবেক সভাপতি : বৃহত্তর চট্টগ্রাম ডেন্টাল এসোসিয়েশন।
All right reserved poristhiti24.com 2018-2022.
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদনকৃত ও পরিস্থিতি২৪ডটকম লিমিটেড (রেজি. নং-১২৮৯৩১) দ্বারা পরিচালিত ।