পরিস্হিতি২৪ডটকম : রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদ তার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হয়রানির পাশাপাশি তাদের উপর নিপীড়ন চালাতেন বলে তার সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও) আরিফুর রহমান সোহাগ অভিযোগ করেছেন।
চট্টগ্রামের হালিশহরের এই বাসিন্দা বলছেন, সাহেদের হয়রানি-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে এক পর্যায়ে তিনি চাকরি ছাড়তে চাইলে সাহেদ প্রভাব খাটিয়ে তাকে থানায় নিয়ে আটকে রাখেন। পরে কৌশলে তিনি কর্মস্থল ছেড়ে দিলে তার পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে চুরির মিথ্যা অভিযোগে মামলা করেন সাহেদ।
আরিফুর রহমান সোহাগ ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের অগাস্ট পর্যন্ত রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদের পিআরওর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, চাকরি ছাড়ায় তাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। তার বাবা-মা ও তিন বোনকেও আসামি করা হয়। পরে পরিবারের সদস্যরা জামিন পেলেও মামলার শুনানিতে হাজিরা দিতে নিয়মিত চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় দৌড়াতে হচ্ছে তাকে।
বাবা-মাকে অযথা মামলার আসামি করে হয়রানি, অকথ্য ভাষায় গালাগালি ও বিভিন্ন সময়ে সাহেদের হুমকির সেসব যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা এখনও ভুলতে পারছেন না সোহাগ।-বিডিনিউজ
হালিশহর বি ব্লকের বাসিন্দা সোহাগ ২০১৪ সালে রিজেন্ট গ্রুপের পত্রিকা দৈনিক নতুন কাগজে রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। পরে তাকে চেয়ারম্যানের অর্থাৎ সাহেদের পিআরও হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সোহাগ বলেন, “নতুন কাগজ পত্রিকা প্রকাশিত হত না, অনলাইন ভার্সন চালু ছিল। সেসময় আমাকে সাহেদ তার ব্যক্তিগত পিআরও হতে বলে। পাশাপাশি পত্রিকার কাজও করাতো আমাকে দিয়ে।”
পিআরও হিসেবে ব্যক্তিগত কর্মসূচি রক্ষা, টক শোর বক্তব্য নির্ধারণ, হাসপাতালের বিভিন্ন বিষয় দেখাশোনা, ফেইসবুকের জন্য টক শোর ভিডিও তৈরি করে দেওয়ার সঙ্গে সাহেদের ঘরের সবধরণের কাজও সোহাগ করতেন বলে জানান। তিনি বলেন, সাহেদ তার সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বাজে আচরণ করতেন; তাদের অবিশ্বাস করতেন সবসময়। কর্মচারীরা তার অত্যাচারে তটস্থ থাকতেন। পছন্দমতো কাজ না হলে উত্তরার অফিসে নিজ কক্ষে কর্মচারীদের ডেকে নিয়ে শারীরিকভাবে নির্যাতন করতেন।
এসব দেখে ২০১৭ সালের অগাস্ট মাসে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন সোহাগ। কিন্তু চাকরি ছাড়ার কথা শুনেই উত্তেজিত হয়ে হুমকি দেন সাহেদ। সোহাগ বলেন, “কয়েকদিন পরে আমাকে পুলিশ দিয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় নিয়ে গিয়ে আট ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়। পরের দিন আবারও চেয়ারম্যানকে স্যরি বলে কাজে যোগ দিই।” এর কয়েকদিন পর সাহেদের অজ্ঞাতে ভিসা করে তিনি মালয়েশিয়া চলে যান। চার দিন মালয়েশিয়া ও ২২ দিন ব্রুনাই থেকে তিনি দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে চাকরি ছাড়েননি। সোহাগ বলেন, “ওই সময়ে দৈনিক নতুন কাগজ পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে ‘রিজেন্ট গ্রুপের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই’ মর্মে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
“কিছুদিন পর ২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর উত্তরা পশ্চিম থানায় আমার বিরুদ্ধে রিজেন্ট গ্রুপের ২০ লাখ টাকা চুরির মামলা করেন সাহেদ। এতে আমার বাবা, মা, তিন বোনকেও আসামি করা হয়।’’ তিনি বলেন, “আমি রিজেন্ট গ্রুপে চাকরি করেছি। কিন্তু আমার বাবা-মা-বোন থাকেন চট্টগ্রামের হালিশহরে। হয়রানির জন্য মিথ্যা অভিযাগে মামলাটি করা হয়।”
অভিযোগ গঠন পর্যায়ের শুনানির পর্যায়ে থাকা মামলাটির অভিযোগপত্র থেকে সোহাগের বাবা-মা ও বোনদের বাদ দেওয়া হয়। সোহাগ বলেন, “বছরখানেক আমার বৃদ্ধ বাবা-মা ও বোনদের নিয়ে অমানুষিক কষ্ট করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আদালতে গিয়ে হাজিরা দিতে হয়েছে। কি যে কষ্ট হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না!”
করোনাভাইরাস পরীক্ষা না করেই ভুয়া সনদ দেওয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে গত ৬ জুলাই রাজধানীর উত্তরা ও মিরপুরে সাহেদের মালিকানাধীন রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালায় র্যাব।
অভিযানে ভুয়া করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট, করোনা চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়সহ নানা অনিয়ম উঠে আসে। পরদিন রিজেন্ট হাসপাতাল সিলগালা করে দেওয়া হয়।
এরপর ৭ জুলাই উত্তরা পশ্চিম থানায় প্রতারণার অভিযোগে সাহেদকে এক নম্বর আসামি করে ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে র্যাব। ওই মামলায় আটজনকে আটক করা হয়েছে। সাহেদসহ ৯ জন পলাতক। সাহেদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তার ব্যাংক হিসাবও জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুদকও তার সম্পদের অনুসন্ধানে নেমেছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহসম্পাদক পরিচয়ে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আসা সাহেদের নানা অপকর্মের খবর এখন প্রকাশ পাচ্ছে। তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে এক ব্যক্তি সোমবার প্রায় কোটি টাকার প্রতারণার মামলা করেন। একই প্রতারণা করে এক ব্যবসায়ীর সাড়ে ৩ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় সাহেদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছে ঢাকার আদালত।
সাহেদের প্রতারণার বিবরণ তুলে ধরে তার সাবেক পিআরও সোহাগ বলেন, সাহেদ নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় দিয়ে ক্ষমতার দাপট দেখাতেন এবং বিভিন্ন থানায় ফোন করে হুমকি দিতেন। “এতদিন পর্যন্ত তার ক্ষমতার দাপটের কারণে ভয়ে কোথাও কোনো অভিযোগ করতে পারিনি। সাহেদ কর্মচারীদের মারধর করতেন। অকথ্য ভাষায় গালাগলি করতেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছূটি দিতেন না। অমান্য করলে মারধরসহ বিভিন্ন রকমের শাস্তি পেতে হত। ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারত না।”
এখন পরিবারের সঙ্গে হালিশহরের বাড়িতেই থাকেন সোহাগ। হালিশহরের এ ব্লকে একটি মার্কেটে দুটি ফার্নিচারের দোকান দেখাশোনা করেন তিনি। সাহেদের অত্যাচারের কথা স্মরণ করে সোহাগ বলেন, “তার সাথে কাজ করার প্রায় তিন বছর সময়ের কথা মনে পড়লে এখনো আতঙ্কে ভুগি। মিথ্যা মামলার শুনানিতে হাজিরা দেওয়া ছাড়া এখন আগের চেয়ে অনেক ভাল আছি।”
সুত্র : দৈনিক আজাদী