পরিস্হিতি২৪ডটকম : মানবাধিকার কথাটি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের নিকট অতি সুপরিচিত ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি শব্দ। অতএব মানবাধিকারের সংজ্ঞায় বলা যায়, মানুষের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকার নিয়ামকের ওপর যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে মানবাধিকার। একটি শব্দ ‘মানব’ অপরটি ‘অধিকার’। প্রথমটির অর্থ হচ্ছে-মানুষ আর দ্বিতীয়টির অর্থ হচ্ছে যারা মানুষ তাদের অধিকার। অর্থাৎ মানবাধিকার কথাটির পরিপূর্ণ অর্থ দাঁড়ায় মানুষের অধিকার।
এ অধিকার মানুষের জন্মগত মৌলিক অধিকার। তাই এ অধিকার সংরক্ষণ ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কাজ করা সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের দেশের অনেক জ্ঞানী-গুণী, পণ্ডিত ও বৈদগ্ধ্য ব্যক্তিবর্গ বলে থাকেন; অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসা হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু এগুলোই শুধু মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণ করবার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। আমি মনে করি, এগুলোর পাশাপাশি মানুষের সুষ্ঠু জীবনধারণের প্রয়োজনে আরও অনেক অধিকার রয়েছে। যেগুলো মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে পরিগণিত। যেমন: বাকস্বাধীনতার অধিকার, নির্ভয়ে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার, জীবনধারণের অধিকার, সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিবার পরিচালনার অধিকার, রাষ্ট্রে শান্তিতে বসবাস করার অধিকার, চুরি- ডাকাতি ও সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচার অধিকার, জুলুম-অত্যাচার ও নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার অধিকার, মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা থেকে বাঁচার অধিকার, নিজের জমি-জমা, গাছ-পালা ও বাগান-বাড়ি সন্ত্রাসীদের লুট-পাট থেকে রক্ষার অধিকার, অন্যায়ভাবে কারো হামলা থেকে বাঁচার অধিকার, স্বাধীনভাবে চাকরি-বাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার, শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে বাঁচার অধিকার, আইনশৃংঙ্খলা বাহিনীর অনৈতিক হামলা থেকে নিজেকে আত্মরক্ষার অধিকার, সন্তানদের নৈতিক শিক্ষায় গড়ে তোলার পরিবেশ পাবার অধিকার, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অধিকার, দেশ, জাতি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে কল্যাণরূপে গড়ে তোলার অধিকার, মানব সেবার অধিকার, সর্বোপরি জননিরাপত্তার অধিকারও মানুষের মৌলিক মানবাধিকার। মোটকথা মানুষের মৌলিক জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকার নিয়ামকের ওপর যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে মানবাধিকার। আমাদের দেশের পবিত্র সংবিধানেও গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা সন্নিবেশিত আছে। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে ‘প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে, এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে’। আমাদের দেশের সরকারও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় অত্যন্ত যত্নশীল বলে আমি মনে করি। মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশে মানবাধিকারের গুরুত্ব অপরিহার্য। মৌলিক চাহিদা পূরণসহ নিরাপত্তামূলক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা বিধান করা সরকার ও মানবাধিকার সংরণ সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। এছাড়া মানবতার পরিপূর্ণ বিকাশের মাধ্যমেই মানবাধিকার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের দেশে অতীত নেতৃত্ব দানে যারা স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন, তারাও আমরণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বাঙালি জাতির পিতা হিসেবে খ্যাত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। পরিতাপের বিষয় বিশ্বব্যাপী আজ যে অশান্তি বিরাজ করছে, তা প্রত্যেক মানুষকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। অতীতে যখন প্রযুক্তির এত উন্নয়ন হয়নি, তখন যে সহিংসতা হতো, তা তাৎণিক সবাইকে ছুঁতে পারত না। এমনকি কখনো কখনো তা প্রতিহত এবং পরাজিতও করা যেত। এখন এর বিস্তৃতি বেড়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে অদৃশ্যভাবে এসে আঘাত করছে। কেননা সারা বিশ্বেই মানবতা ও মানবাধিকার আজ হুমকির মুখে। সবখানেই অধিকার লঙ্ঘনের মহোৎসব, এক অরাজক পরিস্থিতি। শুধু মতার লোভে বিশ্বজুড়ে ধ্বংসলীলায় মেতেছে বিশ্বের রাজনীতিকরা। একদিকে মানবতার বুলি আওড়াচ্ছে, অন্যদিকে মানুষ হত্যার তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার হরণ করছে ‘মানবতার রক্ষকরা’ই। দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে ‘বিশ্বমানবতার বিবেক’ জাতিসংঘের মতো সংস্থাগুলো। সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা আজ ‘একপ্রস্ত কাগজ ছাড়া আর কিছুই নয়’। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণা হয় ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর, প্যারিসে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিভীষিকার পরিপ্রেেিত এর জন্ম। অবশ্য এখানে উল্লেখ করা যায়, বিশ্বের ভয়াবহ যুদ্ধের বেশির ভাগের নেতৃত্ব দেয় ইউরোপ। যেমন : ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তার, ফরাসি ও জার্মান সাম্রাজ্য বিস্তারে হতাহতের সংখ্যা এবং ধ্বংস এখন ইতিহাস। স্যামুয়েল হান্টিংটন তার ‘কাশ অব সিভিলাইজেশন’ বইতে এর চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। এখানে তার একটি মন্তব্য উল্লেখ করা যায়, ‘পশ্চিম (শক্তি) বিশ্ব জয় করেছে তার মূল্যবোধ বা ধারণা দিয়ে নয় বা ধর্মীয় মূল্যবোধ দিয়ে নয়। তাদের সংঘটিত সহিংসতা দিয়ে তারা তাদের মতা ও প্রভাব বিস্তার করেছে।’ এ ঘোষণাটি মানব ইতিহাসের অন্যতম দলিল। এটাকে বিশ্বের মানুষের স্বাধীনতা, সুবিচার ও শান্তির ভিত্তিভূমি বলে উল্লেখ করা হয়। বিশ্বের ১৬৫টি দেশ এই ঘোষণায় স্বার করে এর সাথে সম্পৃক্ততা জানায়। এই ঘোষণার মুখবন্ধ সমগ্র বিষয়কে ধারণ করে আছে। যেমন প্রথম বাক্যটিই ‘যেহেতু প্রতীয়মান যে স্বাধীনতা, সুবিচার এবং শান্তি মানুষের জন্মগত অধিকার’ আরো ছয়টি আর্টিকেলে প্রতিটি সমস্যা ও বিষয়কে প্রকাশ করা হয়। ৩০টি আর্টিকেলে সমৃদ্ধ এই ঘোষণা স্বারকারী ১৬৫ দেশের জন্য অবশ্য কর্তব্য। কোন সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্র দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার মেনে নিতে পারে না, নির্যাতনকে প্রশ্রয় দিতে পারে না। মূলত আমাদের দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত সমাজের অসহায়, দরিদ্র, নির্যাতিত-নিপিড়ীত মানুষদেরকে তাদের মানবিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সচেতন করে গড়ে তোলা এবং প্রয়োজনীয় আইনগত সহায়তা প্রদান করা। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো এক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। প্যাডসর্বস্ব এ সংস্থাগুলো মানবতা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় কাঙ্খিত ভূমিকা পালন করতে পারছে না। বরং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। তাই এ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সচেতনতা এবং মৌলিক মানবীয় গুণাবলী অর্জন করা। যা মানুষের বুদ্ধিদীপ্ত বিবেককে উজ্জীবিত করবে, বিশ্লেষণ মতাকে জাগ্রত করবে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সবগুলো দেশে মানবাধিকার আন্দোলন দিন দিন জোরদার হচ্ছে। তাছাড়া মানব সভ্যতাকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলার জন্য অন্যতম দিকনির্দেশক হচ্ছে-জাতিসংঘ কর্তৃক সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র। এ ঘোষণা অনুযায়ী বিশ্বের ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র প্রায় সকল দেশ এখন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ভূমিকা পালন করছে। আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণও চায় এদেশে সঠিকভাবে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজ নিজ অধিকার ফিরে পাক। কারণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে সংবিধান ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। গণতন্ত্র তার আসল রূপ ফিরে পাবে। প্রশাসন নির্বিঘ্নে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে তার বিচারিক কার্যাবলী সম্পন্ন করতে পারবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও মতাবলী নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, মরমী গবেষক ও গ্রন্থপ্রণেতা।