বাংলাদেশ, , বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সচেতনতার বিকল্প নেই ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন

  প্রকাশ : ২০১৯-১০-২২ ১৮:১০:১৩  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : প্রাকৃতিক অধিকার থেকে মানবাধিকার। মানব ইতিহাসের ব্যাপক পরিসরে এর অস্তিত্ব দেখা যায়। মানবাধিকার প্রকৃতপক্ষে একটি বোধের নাম, যে বোধ মানুষকে মানুষ হয়ে উঠতে শিক্ষা দেয় এবং অপরের মনুষ্য পরিচয়কে স্বীকৃতি দিয়ে সম্মান করার দীক্ষায় দীক্ষিত করে। মানব পরিবারের সকল সদস্যের জন্য সার্বজনীন, সহজাত, অহস্তান্তরযোগ্য এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকারই হলো মানবাধিকার।

মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের এক ধরনের অধিকার যেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য। মানুষ এ অধিকার ভোগ করবে এবং চর্চা করবে। তবে এ চর্চা অন্যের ক্ষতিসাধন ও প্রশান্তি বিনষ্টের কারণ হতে পারবে না। মানবাধিকার সব জায়গায় এবং সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। এ অধিকার একই সাথে সহজাত ও আইনগত অধিকার। স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম দায়িত্ব হল এসব অধিকার রণাবেক্ষণ করা। যদিও অধিকার বলতে প্রকৃতপক্ষে কী বোঝানো হয় তা এখন পর্যন্ত একটি দর্শনগত বিতর্কের বিষয়। বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের বিষয়টি এখন আরো প্রকটভাবে অনুভূত হচ্ছে, যখন আমরা দেখছি যে, মানুষের অধিকারসমূহ আঞ্চলিক যুদ্ধ, সংঘাত, হানাহানির কারণে বার বার লঙ্ঘিত হচ্ছে। প্রথমত. একটি পরিবার ও সমাজের কর্তারা তাদের অধিনস্তদের অধিকার রক্ষা করবে। দ্বিতীয়ত. রাষ্ট্র এবং তৃতীয়ত. আর্ন্তজাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ মানবাধিকার রায় ভূমিকা পালন করে থাকে। সকল ধর্মই মানবাধিকারের ব্যাপারে বেশ সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে। মানবাধিকার হচ্ছে কতগুলো সংবিধিবদ্ধ আইন বা নিয়মের সমষ্টি, যা মানবে জাতির সদস্যদের আচার আচরণ ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে বুঝায় এবং যা স্থানীয় ও আর্ন্তজাতিক আইন সমষ্টি দ্বারা সুরক্ষিত যা মৌলিক অধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ বিষয় হিসেবে ধর্তব্য। এতে কোন মানুষ এজন্য সংশ্লিষ্ট অধিকার ভোগ করবে যে, সে জন্মগতভাবে একজন মানুষ। জাতিসংঘের Universal Declaration of Human Rights এর ১ম অনুচ্ছেদে লেখা রয়েছে যে, All human beings are born free and equal in dignity and rights. অর্থাৎ ‘জন্মগতভাবে সকল মানুষ স্বাধীন এবং সমান সম্মান ও মর্যাদা অধিকার।’ বর্তমান বিশ্বে Human Rights শব্দটি বহুল আলোচিত ও বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। মানবাধিকারের বিষয়টি স্বতঃসিদ্ধ ও অলঙ্ঘনীয় হলেও সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই এ নিয়ে চলছে বাগবিতণ্ডা ও দ্বন্দ্বসংঘাত। একদিকে মানবাধিকারের সংজ্ঞা ও সীমারেখা নিয়ে বিতর্কের ঝড় তোলা হচ্ছে, অন্যদিকে মতাধর শাসকরা দেশে দেশে জনগণের স্বীকৃত অধিকারগুলো পর্যন্ত অবলীলায় হরণ ও দমন করে চলছে। আর দুর্বল জাতিগুলোর সাথে সবল জাতিগুলোর আচরণ আজকাল মানবাধিকারকে একটি উপহাসের বস্তুতে পরিণত করেছে। সারা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ চায় সে শিশু হোক, যুবক হোক বা বৃদ্ধ হোক, নারী হোক বা পুরুষ হোক সকলেরই স্বাধীন মত প্রকাশ এবং সঠিক আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে আজ চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে মানবাধিকার। যেদিকেই তাকাই শুধু চোখে পড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দৃশ্য এবং শুধু শুনতে পাই আর্ত মানবতার চিৎকার। এমতাবস্থায় আমরা যারা মানবাধিকার কর্মী বা মানবতাবাদী বলে নিজেদেরকে পরিচয় দিই তাদের সকলেরই উচিত প্রতিনিয়ত চলাফেরায় নিজের চোখ, কান এবং বিবেকের দরজা খোলা রেখে এসব মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে স্বোচ্চার হওয়া। শুধু মানবাধিকারের কাজ করি এই বলে বেড়ালে চলবে না, বরং ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ থেকে আরম্ভ করে রাষ্ট্রকে ছাপিয়ে বিশ্বব্যাপী সর্বত্র মানবাধিকারের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মানুষের যে সচেতন হওয়া প্রয়োজন তা বোঝাতে হবে। প্রথমে নিজেকে শোধরাতে হবে, পরবর্তীতে মানুষ-মানুষ, পরিবার-পরিবার এভাবেই মানুষের মাঝে একে অপরের উপরে প্রাধান্য বিস্তারের যে প্রবণতা তা যেন ভুলে মিলেমিশে কাজ করার প্রবণতা চালু হয় সে বিষয়ে কাজ করতে হবে। সর্বত্রই নিজের কাজের প্রতি আত্মবিশ্বাস রেখে বিভিন্ন বাধাবিপত্তিকে উপেক্ষা করে আমাদেরকে কাজ করে যেতে হবে। সময়ে দেখা যাবে প্রশাসনসহ সবাই প্রাণপণ সহযোগিতা করছে আবার ভিন্ন চিত্র হলো অনেক মতাধরেরা তাদের মতা বলে আমাদের কাজকে বাধা দিতে চেষ্টা করবে। কিন্তু আমাদেরকে পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতা মাথায় রেখে মানবতার সেবায় সামনে আগাতে হবে। আমাদের কোনও কাজ যেন কখনই মানবতার সেবার নামে মানবতাবিরোধী না হয়ে যায়। আমাদের কাজগুলো যেন কখনো এমন না হয় যে, সেখান থেকে নিজেদের পকেট ভারী করার চিন্তা করব। এছাড়াও মানবাধিকার একটি সমাজে কতটা বিরাজ করছে, তার মাপকাঠি সমাজের একজন মানুষ নিজের জীবনটা কতটা নিশ্চিন্তে যাপন করতে পারছেন। তাঁর আর্থসামাজিক অবস্থান, ধর্ম, বর্ণ, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, লৈঙ্গিক পরিচয় কিংবা বয়স তাঁর আত্মপরিচয়কে ছাপিয়ে যাবে না, এই আশ্বাসে তাঁকে আশ্বস্ত থাকতে হবে। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তাঁর জীবনটা তিনি সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে কোনোরকম হেনস্তা বা হয়রানির শিকার না হয়ে মোটামুটি শান্তিতে যাপন করে যেতে পারবেন। কোনো বিশেষ পরিচয়ের কারণে তাঁকে নিগৃহীত বা অপমানিত হতে হবে না। বা কোনো অজুহাতে দখল করে নেওয়া হবে না তাঁর সহায়-সম্পদ, তাঁকে হতে হবে না বাস্তুহারা, নিতে হবে না দেশত্যাগের মতো চরম সিদ্ধান্ত। মানবাধিকার বলে, মানুষ মানুষ হয়ে জন্মেছে বলেই কিছু অধিকার তার সহজাত। এসব অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না, সে কোনো ব্যক্তিই হোক, কি রাষ্ট্র, কি সমাজ।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিষ্ট এবং কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি।



ফেইসবুকে আমরা