মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামবাসীর গর্ব ও গণমানুষের নেতা
…. লায়ন ডাঃ বরুণ কুমার আচার্য বলাই
পরিস্হিতি২৪ডটকম : একটি জীবন একটি ইতিহাস। সেই ইতিহাসের স্তম্ভ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। কারও কাছে তিনি ছিলেন রাজনৈতিক গুরু, কারওবা সহযোদ্ধা, কেউ আবার তাকে মানতেন অভিভাবক হিসেবে। তিনি কারও কারও কাছে এখনও ‘মেয়র সাব’। বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সাবেক নগর পিতা ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এ প্রবীণ রাজনৈতিক নেতার জীবন ছিল নানা প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতায় ভরপুর। সব বাধাকে জয় করে যিনি হয়েছিলেন জন মানুষের নন্দিত নেতা। পেয়েছেন চট্টল বীরের খেতাব। ১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামের বক্স আলী চৌধুরী বাড়িতে তার জন্ম। বাবা হোসেন আহমদ চৌধুরী আর মা বেদুরা বেগম। আট ভাইবোনের মাঝে মহিউদ্দিন ছিলেন মেজ। তার বাবা চাকরি করতেন আসাম বেঙ্গল রেলওয়েতে। বাবার চাকরির সুবাদে মহিউদ্দিন পড়াশুনা করেছেন মাইজদি জেলা স্কুল, নগরীর কাজেম আলি ইংলিশ হাই, আর প্রবর্তক সংঘে। স্কুল জীবনেই তিনি জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। মাধ্যমিকের শেষে বাবার আদেশে ভর্তি হন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে। পরে সেখান থেকে ভর্তি হন চট্টগ্রামের অন্যতম বিদ্যাপিঠ চট্টগ্রাম কলেজে। সেখানে বেশিদিন ছিলেন না। এরপর ভর্তি হন কমার্স কলেজ। সেখানেও শেষ করতে পারেননি। শেষে ভর্তি হন সিটি কলেজ। সিটি কলেজেই তার বিপ্লবী রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। জড়িয়ে পড়েন ছাত্র আন্দোলনে। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই মহিউদ্দিন চৌধুরী জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর সান্নিধ্যে আসেন।
পাকিস্তান আমলে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত থাকায়, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দেশ শত্রু মুক্ত করার আন্দোলন করায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দলের অস্তিত্ব ধরে রাখায় বারবার শাসক গোষ্ঠীর রোষানলে পড়েছিলেন আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তারপরও রাজনীতি ছাড়েননি। আঘাত পেয়েও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। এভাবেই দলমতের ঊর্ধ্বে গিয়ে চট্টগ্রামের জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছিলেন। পেয়েছিলেন ‘চট্টলবীর’ উপাধি। তাইতো দল, মত নির্বিশেষে সবাই প্রয়াত এই নেতার প্রশংসাই করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিতে গিয়ে পাক বাহিনির কাছে গ্রেফতার হন অসংখ্যবার। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে আইএস আইয়ের চট্টগ্রাম নেভাল একাডেমি সদর দপ্তরের কাছে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন দীর্ঘ চার মাস। শহীদ হয়ে গেছেন ভেবে ছেলের নামে বাবা ফাতেহা পড়িয়েছিলেন। এরই মাঝে একদিন মানসিক রোগীর অভিনয় করে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে পালিয়ে যান মহিউদ্দিন। পাড়ি জমান ভারতে। সেখানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে সক্রিয়ভাবে সম্মুখসমরে অংশ নেন। ছিলেন ভারত-বাংলা যৌথবাহিনীর মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনে। বঙ্গবন্ধুর খুবই কাছের আর আদরের ছাত্রনেতা ছিলেন মহিউদ্দীন। কিন্তু তৎকালীন সময়ে প্রবল মতাশালী হয়েও মতার মোহ স্পর্শ করেনি তাকে। কিছুদিন না যেতেই ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে শহীদ হন বঙ্গবন্ধু। অল্পের জন্য মহিউদ্দিন ধরা পরা থেকে বেঁচে যান, মৃত্যু বরণ করেন সাথী মৌলভি সৈয়দ। পালিয়ে গিয়ে ভারতে প্রতিবিপ্লবীদের সাথে যোগ দেন। লক্ষ্য সামরিক জান্তা, খুনি মোশতাককে সামরিক ভাবেই পরাস্ত করা। কিছুদিন পরেই দলের নির্দেশে পন্থা পরিবর্তন করে আবার সক্রিয় হন প্রকাশ্য রাজনীতিতে। দেশে এসেই নির্যাতন ও একের পর এক কারাভোগের শিকার হন এ নেতা। মাঝে আওয়ামী লীগের ভেতরেই ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর হয়ে উঠলো। বঙ্গবন্ধু কন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভুমিকাকে নগণ্য করতে তাকে ঠেকাতে শত্রুরা উঠেপরে বসলো। অদম্য সাহসী মহিউদ্দীন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে দলবল নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যার জন্য ঝাপিয়ে পরলেন। সব বাধা অতিক্রম করে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দলের কাণ্ডারির দায়িত্ব নিতে সহয়তা করলেন। স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলে চট্টগ্রামে স্বয়ং জান্তা প্রধানকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে চক্ষুশূল হন সরকারের। ফলে আবারও রাজনৈতিক বন্দি হন। ততদিনে চট্টগ্রামের আপামর জনতার নয়নমনি হয়ে উঠেন মহিউদ্দীন চৌধুরী। একানব্বইয়ের ঘুর্ণিঝড়ে দুসহ জনতার পাশে দাঁড়িয়ে, অসহযোগ আন্দোলনে খালেদার সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, গরিব-দুঃখি-শ্রমিকের অধিকারের কথা বলে মহিরুহে পরিনত হন আজকের মহিউদ্দীন। ওয়ান ইলেভেনের শাসনামলে জেলে যান। ষাটোর্ধ বয়সে কারান্তরীণ ছিলেন দীর্ঘ দুই বছর। এরমধ্যেই মারা যায় আদরের মেয়ে ফওজিয়া সুলতানা টুম্পা। টুম্পার মৃত্যু অবধারিত জেনেও দেখতে দেয়নি অনির্বাচিত সরকার। শতচেষ্টা আর মানসিক নির্যাতন করেও টলাতে পারে নি সরকার মহিউদ্দীনকে একটুও। তিনি ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালের মেয়র নির্বাচনে তিনি মতাসীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একজন মন্ত্রীকে পরাজিত করে তৃতীয় বারের মতো চট্টগ্রামের মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন। পাশাপাশি প্রতিপরে তুলনায় ভোটের ব্যবধানও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। ‘তিনি অবহেলিত চট্টগ্রামের কাণ্ডারি ছিলেন। তার হাত ধরেই চট্টগ্রামের মানুষের প্রত্যাশা অনেকাংশে পূরণ হয়েছে। তিনি জীবন বাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য প্রাণপণ লড়াই করে ইতিহাসে কিংবদন্তি হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন। সাবেক এ মেয়র স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রাজপথে ছিলেন এবং চট্টগ্রাম বন্দর রা আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সামনের কাতারে। তিনি প্রজন্ম পরম্পরায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রতিবছর বিজয় মেলা আয়োজন করে ইতিহাসে বিরল অবদান রেখে গেছেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী কখনও ভোট দখলের রাজনীতি করেননি। তিনি কখনও জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেননি। রাজনৈতিক নেতাদের যোগসাজোশে যে অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন চলছে তিনি তার বিরুদ্ধে ছিলেন।’, ‘মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামে রাজনৈতিক সম্প্রীতি বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। জনস্বার্থ বিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি আমৃত্যু প্রতিবাদ করে গেছেন। জনস্বার্থ বিরোধী নিজ দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার ছিলেন।’ মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের গর্ব ছিলেন, অহংকার ছিলেন, তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের নেতা, গণমানুষের নেতা, বিভিন্ন সময়ে অনেক বিভেদের মধ্যেও দলের নেতা কর্মীদের কাছে মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। এছাড়াও সব দলের নেতা কর্মীদের কাছে তিনি একজন গ্রহণযোগ্য ব্যাক্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন সকলের নেতা। যেকোন কঠিন সময়ে তিনি চট্টগ্রামবাসীর পক্ষে দাঁড়াতেন। হৃদরোগ ও কিডনি জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে ৭৩ বছর বয়সে চট্টগ্রামের এই প্রাণপ্রিয় নেতা মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর চলে যাওয়ায় যে শূন্যতা হয়েছে তা কখনও পূরণ হবার নয়। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, মরমী গবেষক ও গ্রন্থপ্রণেতা।