বাংলাদেশ, , শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

মহান একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জনগণের গৌরবোজ্জল একটি দিন : ডা. বরুণ কুমার আচার্য

  প্রকাশ : ২০২০-০২-২০ ১৮:৪৯:১১  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জনগণের গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। এটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবেও সুপরিচিত। এই ঐতিহ্যময় ও গৌরবের ভাষা আন্দোলন এর মূল্যবোধ এবং স্বাধীনতার উপর তার প্রকৃষ্ট প্রভাব অনস্বীকার্য। কেবল তাই-ই নয় ভাষার জন্য আন্দোলন করে এরূপ জীবন উৎসর্গ বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। এটি আমাদের কাছে ঐতিহ্যময় শহীদ দিবস। বিগত এক দশক ধরে এই দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবেও সুপরিচিত সারা বিশ্বে। জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করায় বাঙালি জাতির জন্য এই দিনটি বাড়তি এক গর্ব বয়ে এনেছে সুনিশ্চিতভাবেই।
‘অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে সেদিন বর্ণমালা
সেই থেকে শুরু দিন বদলের পালা…’
কবির ভাষায় দিনবদলের পালা শুরু হয়েছিল যেদিন, সেদিন বাংলা মায়ের বীর সন্তানদের শোণিত ধারায় সিক্ত হয়েছিল এ মাটি। রক্তের আখরে লেখা বাঙালি জাতির ইতিহাসে বেদনার পাশাপাশি চিরগৌরবদীপ্ত ও অহঙ্কারে মহিমান্বিত দিন একুশে ফেব্রুয়ারি। শোক, বেদনা, আর আত্মত্যাগের অহঙ্কারে ভাস্বর সেই মহান শহীদ দিবসে ভোরের আকাশ বাতাস বিষণ্ন করে অযুত কণ্ঠে বেজে উঠবে, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি…।’ ১৯৫২ সালে ভাষাকে কেন্দ্র করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম হয়েছিলো। একুশের চেতনা সে দিক থেকে একটি মূল্যবোধ। জীবনাদর্শ যা আমাদেরকে প্রতিবাদী করে তোলে এবং সর্বপ্রকার নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে স্বকীয় সত্তা প্রতিষ্ঠিত ও বিকশিত করে। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই বাষট্টি, ছেষট্টি ও ঊনসত্তরের আন্দোলন হয়েছে, এর ফলে আমরা একাত্তরে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছি। তাই আমাদের সাহিত্য অঙ্গনে একুশের চেতনার সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। প্রতি বছর একুশ উপলে প্রকাশিত হয় অসংখ্য কবিতা। আয়োজন করা হয় জাতীয় কবিতা উৎসব।

একুশের প্রথম প্রহরে শহিদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ জাতীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কেননা উন্নত সংস্কৃতিই একটি জাতির পরিপূর্ণ পরিচয়। কোনো জাতিসত্তাকে সত্য স্বরূপে আবিষ্কার করতে হলে গ্রহণ করতে হবে সে জাতির সংস্কৃতি। মূলত আমাদের সংস্কৃতি অন্বেষায় একুশের চেতনা আমাদেরকে নিজ বাসভূমে প্রত্যাবর্তনের পথ দেখিয়েছে। একুশ আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এ বোধ কখনো বিসর্জিত হবে না। মাতা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি এ তিনটি পরম শ্রদ্ধার বিষয়। মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে পৃথিবীর কোন জাতি উন্নতি করতে পারেনি। মাতৃভাষাকে অবলম্বন করেই জাতির সংস্কৃতির বিকাশ সাধিত হয়। বর্তমান বিশ্বে যে সকল দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি লাভ করেছে তার মূলে রয়েছে মাতৃভাষা প্রীতি, দেশাত্মবোধ ও শ্রম সাধনা। এছাড়াও যে জাতির জাতীয়তা বোধ প্রখর সে জাতি তত উন্নতির শিখরে। নিজ নিজ ভাষার প্রতি ভালোবাসা থাকা প্রত্যেক নাগরিকদের নৈতিক দায়িত্ব। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, প্রাণের ভাষা, হৃদয়ের ভাষা, নিজেকে তুলে ধরার ভাষা। এ ভাষা আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। পৃথিবীর বুকে বাংলা ভাষাই একমাত্র ভাষা। যে ভাষা প্রতিষ্ঠায় রয়েছে সুনির্দিষ্ট ইতিহাস। সে ভাষার সাথে মিশে আছে বাঙালির তাজা রক্ত। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ ভাষার মর্যাদা আজ আন্তর্জাতিক হিসেবে স্বীকৃত। এর জন্য স্বীকার করতে হয়েছে অনেক ত্যাগ তিতিা। মাতৃভাষা হলো প্রত্যেক মানুষের জন্মগত অধিকার। অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃতি পেয়েছে বলে বাঙালি জাতি এখন বিশ্ব সভায় গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত। ইউনেস্কোর দেয়া এ বিরল সম্মান বাঙালির যেমন শ্রেষ্ঠ অর্জন তেমনি আমাদের মহান ভাষা শহিদদের আত্মদানের সুমহান স্বীকৃতি। পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগের বেশি লোকের মুখের ভাষা ছিলো বাংলা। বাংলা ভাষার বন্ধনে আবদ্ধ বাঙালি উর্দুই হবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা এ বক্তব্যের প্রতিবাদস্বরূপ বিােভে ফেটে পড়ে। আর তখনই এ ভাষার প্রতি বাঙালির ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এর পরিণতি ঘটে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে। ঐ দিন মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য ও ২১শে ফেব্রুয়ারিকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের দাবিতে আপামর জনসাধারণ সর্বাত্মক আন্দোলনের ডাক দেন। বঙ্গীয় সমাজে বাংলা ভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালি মুসলমানের আত্ম-অম্বেষায় যে ভাষাচেতনার উন্মেষ ঘটে, তারই সূত্র ধরে বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভাষা-বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চে এ নিয়ে সীমিত পর্যায়ে আন্দোলন হয় এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে তার চরম প্রকাশ ঘটে। ঐদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষার জন্য শহিদ হয়েছিলেন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউলসহ অনেক যুবক। তাঁদের এই মহান আত্মত্যাগের ফসলে আমাদের জাতিসত্তা নির্মাণে এবং আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠায় তাদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। ভাষার জন্য অকাতরে প্রাণ দিয়েছিলেন বলেই পূর্ব বাংলার বাঙালিরা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলো এবং সেটা ছিলো গৌরবের বিজয়। ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত আমরা তাদের ত্যাগের স্মৃতিকে জাতীয় শহিদ দিবস হিসেবে পালন করে এসেছি। আমাদের মুখের ভাষা বাংলা ভাষা এখন দেশ কালের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ব আসনে অধিষ্ঠিত। ১৯৫৩ সাল থেকে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি একটি মহান জাতীয় দিবস হিসেবে বাংলাদেশে এবং দেশের বাইরে ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অন্যত্র যেখানে বাঙালি রয়েছে সেখানে উৎযাপিত হয়ে আসছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিস বৈঠকে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক শাখা ইউনেস্কো, একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসরূপে ঘোষণা করে। জাতিসংঘের ১৮৮ সদস্য দেশ প্রতিবছর এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ সিদ্ধান্ত বাংলা ভাষার মর্যাদাকে অনেক বাড়িয়ে দেয়। শহিদ রফিক এবং শহিদ সালাম মাতৃভাষার জন্য বুকের রক্ত দিয়েছিলেন। সে পদাঙ্খ অনুসরণ করে। কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে জাতিসংঘ। – এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে উত্থাপন করে বাংলাদেশ। মে মাসে ১১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘের তথ্যবিষয়ক কমিটিতে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। এটা একটা অনন্য দৃষ্টান্ত এবং সমগ্র জাতি এতে কৃতজ্ঞ। মাতৃভাষা আমাদের জন্মগত অধিকার। আমাদের এ অধিকারকে কৌশলে হরণ করতে চেয়েছিলো পাকিস্তানি স্বৈরশাসক। এর ইতিহাস ঘটনাবহুল। মাতৃভাষা প্রেমে বীর বাঙালি উদ্দীপ্ত ছিলো। রাজপথ রঞ্জিত করেও তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি বলে বাধ্য হয় বাঙালির দাবিকে মেনে নিতে এবং বাংলাকে বাঙালির মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। সকলের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় ভাষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সফল হয়। বাংলা ভাষা ফিরে পায় তার হারানো ঐতিহ্য। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হওয়ায় বাংলা ভাষার মর্যাদা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি পৃথিবীর সব ভাষার গুরুত্ব বেড়ে গেছে। সারা পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হওয়ার সুবাদে মাতৃভাষা হারিয়ে যাওয়া থেকে রা পেয়েছে। মায়ের ভাষার মর্যাদা রায় পৃথিবীর সব জাতি, সব গোষ্ঠী এখন সচেতন। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আর বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, একুশে ফেব্রুয়ারি এখন বিশ্বজনীন। বাঙালির বাংলা কিংবা বাংলাদেশির বাংলা এখন টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া সীমানায় আবদ্ধ নয়। এটি আজ বিস্তৃত হয়েছে দেশ থেকে মহাদেশে। উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরুতে। বাংলা আজ বিশ্বময় আদৃত সমাদৃত। এ অর্জন বাংলাদেশের মানচিত্রকে উজ্জ্বল করেছে বিশ্ব মানচিত্রে। অমর একুশ আজ শুধু বেদনার দিন নয়- সাহসে, প্রেরণায়, প্রত্যয়ে, উদ্দীপনায়, সকল প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যাবার দিন। আঁধার সরিয়ে আলোয় উদ্ভাসিত হবার দিন। অশুভ, অন্ধকার প্রতিহত করার প্রত্যয়ে জাতি উদ্দীপিত হবে আজকের এই পবিত্র ক্ষণে। শোক, শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও অর্জনের এক অপূর্ব সম্মিলনে জাতি পালন করবে এই দিনটি। সকলের সব পথ আজ মিশে যাবে শহীদ মিনারে। তাই মহান শহীদ দিবস শুধু আমাদের অর্জনেরই দিন নয়, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হারানোর বেদনারও দিন। তাই শুধু আনন্দে মেতে থাকলেই আমাদের চলবে না, তাদের সেই ত্যাগ থেকে শিক্ষা নিয়ে ও শক্তি অর্জন করে বর্তমানের অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হবে। ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক শক্তি জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে লড়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, মরমী গবেষক ও গ্রন্থপ্রণেতা।



ফেইসবুকে আমরা