পরিস্হিতি২৪ডটকম /(সৈয়দ শিবলী ছাদেক কফিল): প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম শিক্ষাবিদ, ভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ, লেখক। সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অঙ্গণে একজন বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি কখনো নিজের চিন্তা করেননি। দেশ ও জাতির মহত্তর কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করেছেন। মেধা, দুরদৃষ্টি-গভীর প্রজ্ঞা, সাহস-দেশপ্রেম, ত্যাগ-সার্বজনীনতা ও যোগ্যতা যাকে করেছে বরণীয়-স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব । সদালাপি ও মৃদুভাষী প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম রাজনীতির আদর্শ। যিনি নিজের জন্য নয়; দেশের জন্য ও দশের জন্য জন্য কাজ করেছেন। জাতি গঠনে তাঁর ভূমিকা বা অবদান ছিল যথেষ্ট।
চট্টগ্রাম জেলার চন্দাইশের (তৎকালীন পটিয়ার) বিপ্লবতীর্থ বরমা ইউনিয়নের সেবন্দি গ্রামে ১৯২০ সালের ২৮ জুন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই মহান ব্যক্তি ১৯৯১ সালের ১১ মার্চ নাফেরার দেশে পাড়ি জমান। তাঁর পিতার নাম ছিল মতিউর রহমান।
ব্যারিস্টার যাত্রামোহন সেনগুপ্ত প্রতিষ্ঠিত “বরমা বরমা ত্রাহিমেনকা উচ্চ বিদ্যালয়” থেকে তিনি ১৯৩৯ সালে তিনটি বিষয়ে লেটার সহ প্রথম বিভাগে কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা পরীায উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৪১ সালে “চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ” থেকে আইএসসি-তে মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন৷ পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পদার্থ বিদ্যায় অনার্সসহ ডিগ্রী লাভ করেন ১৯৪৪ সালে এবং এমএসসি ডিগ্রী লাভ করেন ১৯৪৫ সালে। তিনি বিখ্যাত গণিতবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অধীনে মাস্টাসের থিসিস করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের লেকচারার পদে যোগ দেন। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন।
১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের উদ্যোগে ঢাকায প্রতিষ্ঠিত হয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশ। তিনি ছিলেন এর সাধারণ সম্পাদক। এই সংগঠনের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম তিনি বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের দাবি উত্থাপন করেন। এই লক্ষ্য ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা: বাংলা না উর্দু’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। এই মূল পুস্তিকায় আবুল কাশেম প্রণীত একটি সংক্ষিপ্ত প্রস্তাবনাও ছিল, এবং তাতে ছিল বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম এবং পূর্ববাংলার অফিস আদালতের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবি। তাঁরই উদ্যোগে তমদ্দুন মজলিশ ১৯৪৭ সালের ১ অক্টোবর সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনে নেতৃত্ব দেয়। নূরুল হক ভূইয়াকে সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক এবং প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমকে কোষাধ্যক্ষ করা হয। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদই ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে এবং ১৯৪৮ সালের প্রথমদিকে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করে। ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্বে প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম ছিলেন আন্দোলনের মধ্যমণি। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবির সপে ব্যাপক সমর্থন আদায়ে লক্ষ্য তিনি অসামান্য অবদান রাখেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির সপক্ষে যুব সমাজ এবং বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্রদের সমর্থন লাভে তাঁর সাফল্য ছিল অভাবনীয়। ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত প্রথম প্রতিবাদ সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘট সংঘটনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। এই ধর্মঘটের ফলে তদানীন্তন প্রাদেশিক সরকার বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ অ্যাকশন কমিটির সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম ছিলেন বাংলা সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর সম্পাদনায় পত্রিকাটি ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর ঢাকা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। তমদ্দুন মজলিশের মুখপত্র হিসেবে এই পত্রিকাটি ভাষা আন্দোলনের আদর্শ ও লক্ষ্য প্রচারে সক্রিয় ছিল।
প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম এবং তমদ্দুন মজলিশের কতিপয় নেতৃস্থানীয় সদস্য অচিরেই উপলব্ধি করেন যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালে যে রাষ্ট্রীয় আদর্শের কথা বলা হয়েছিল, পাকিস্তান তখন আর সে আদর্শে পরিচালিত হচ্ছে না। এর ফলে তমদ্দুন মজলিশের অধিকাংশ সদস্য মুসলিম লীগ থেকে সরে যান। আবুল কাশেম তখন একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন। ফলে ১৯৫২ সালে আবুল হাশেমকে সভাপতি করে গঠিত হয় খিলাফতে রববানী পার্টি। আবুল কাশেম যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া-বোয়ালখালী নির্বাচনী এলাকা থেকে পূর্ববাংলা আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি আইন পরিষদে শিক্ষার সকল স্তরে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালু করার প্রস্তাব পেশ করেন। ভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ আবুল কাশেম কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষায় বাংলা মাধ্যম প্রবর্তনের অপরিহার্যতা উপলব্ধি করেন এবং এতদুদ্দেশ্যে তিনি ঢাকায় ১৯৬২ সালে বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এ কলেজ প্রতিষ্ঠার ফলে বাংলা মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা লাভের দ্বার উন্মুক্ত হয়। তিনি দীর্ঘ উনিশ বছর (১৯৬২-১৯৮১) বাংলা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। এর অধিকাংশ সময়ই তিনি কলেজ থেকে কোনো পারিশ্রমিক বা বেতন গ্রহণ করেন নি। একজন বহুমুখী লেখক, প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম পদার্থবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের অপরাপর শাখায় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পাঠ্যবইসহ প্রায় এক শত গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর সুপরিচিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা (১৯৪৭), একমাত্র পথ (১৯৪৯), ঘোষণা (১৯৫২), বিবর্তনবাদ (১৯৫২), ইসলাম কি দিয়েছে এবং কি দিতে পারে (১৯৫২), মুক্তি কোন পথে (১৯৫২), শ্রেণি সংগ্রাম (১৯৫৩), একুশ দফার রূপায়ন (১৯৫৫), দুটি প্রশ্ন (১৯৫৫), শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি (১৯৫৫), সংগঠন (১৯৬৪), আধুনিক চিন্তাধারা (১৯৬৪), ইসলামী রাষ্ট্রনীতি, কুরআনের অর্থনীতি, বিজ্ঞান বস্ত্তবাদ ও আল্ললাহর অস্তিত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব ও আল্লাহর অস্তিত্ব, বিজ্ঞান সমাজ ও ধর্ম, Islam Science and Modern Theory, Universal Ideology in the light of Modern Thought| তিনি উদ্ভাবন করেন বাংলা বানান এবং বাংলা লিখনরীতি সংস্কারের লক্ষ্য তিনি একটি নতুন পদ্ধতি।
প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম বাংলা একাডেমী, আর্ট কলেজ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, সিটি কলেজসহ পঞ্চাশটিরও অধিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। জাতির সেবায় তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম জাতীয় ও সামাজিক পুরস্কার লাভ করেন। এদের মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান রাইটার্স গীল্ড পুরস্কার (১৯৬৪), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮২), একুশে পদক (১৯৮৭), ইসলামিক ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড (১৯৮৮), চট্টগ্রাম সমিতি পদক (১৯৮৮), ১৯৮৯ সালে তাঁকে ঢাকায় জাতীয় সম্বর্ধনা দেয়া হয়। এই সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও ভারতের খ্যাতনামা পন্ডিত ও সাহিত্যিকগণ অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমকে জাতীয় সম্বর্ধনা স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। বাংলা কলেজ ছাত্র মজলিশ পুরস্কার, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৩, মরণোত্তর) প্রদান করা হয়।
লেখক : সাংবাদিক ও ছড়াকার