পরিস্হিতি২৪ডটকম : বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের, বিশেষ করে ভারতীয় উদ্যোক্তাদের জন্য গতানুগতিক খাতের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষা, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রনিকস, মোটরগাড়ি শিল্প, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতে বিনিয়োগ করার এখনই উপযুক্ত সময় বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) দুপুরে নয়াদিল্লির তাজমহল হোটেলের দরবার হলে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সম্মেলনে ‘কান্ট্রি স্ট্রাটেজি ডায়ালগ অন বাংলাদেশ’ (সিএসডি) শীর্ষক অংশে বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই বাংলাদেশের বিশাল বাজার ও উদার সমাজব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, অনেকেই বাংলাদেশকে ৩ কোটিরও বেশি মধ্য ও উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠীর ‘বাজার’ এবং এক ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ হিসেবে দেখে থাকে। আমার চোখে, আমাদের মূল শক্তি হলো সামাজিক মূল্যবোধ ও জনতার আস্থা। একইসঙ্গে উন্নয়নের জন্য মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও আমাদের নেতৃত্বের প্রতি তাদের আত্মবিশ্বাস। আমার বাবা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষুধা, দারিদ্র ও বঞ্চনামুক্ত এক সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন। তার স্বপ্নই আমাদের ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নয়নশীল ও ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নতি দেশে পরিণত করার পরিকল্পনা হাতে নিতে আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছে।
এর পরপরই বাংলাদেশে বিনিয়োগের নতুন বিভিন্নখাতের ব্যাপারে বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বস্ত্রখাতের বাইরেও বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে উন্নত, জ্ঞানসমৃদ্ধ এক সমাজের দিকে এগিয়ে চলেছে। গত বছর আমরা কোরিয়ায় শিল্পখাতে ব্যবহার উপযোগী ১২টি রোবট রপ্তানি করেছি। বাংলাদেশে নির্মিত ৪টি জাহাজ ভারতে এসেছে। সম্প্রতি এখানকার বহুজাতিক কোম্পানি ‘রিলায়েন্স’ বাংলাদেশে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ রেফ্রিজারেটর কিনেছে। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তিখাতে বাংলাদেশে বর্তমানে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সার কাজ করছে। এসব কিছুই (বাংলাদেশের) এক নীরব রূপান্তরের কথা বলে, যেখানে মানুষ উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিখাতে অভ্যস্ত হতে (সাদরে) বিভিন্ন ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছে। তাই আমি বলছি, বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের, বিশেষ করে ভারতীয় উদ্যোক্তাদের জন্য গতানুগতিক খাতের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষা, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রনিকস, মোটরগাড়ি শিল্প, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতে বিনিয়োগের জন্য এটি উপযুক্ত সময়।
‘বাংলাদেশে দ্রুতগতিতে নগরায়ন হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে শহর ও নগরের বাসিন্দা হবে আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর ৪৮ শতাংশ। তাদের বেশিরভাগই থাকবে তরুণ, কর্মোদ্যমী ও ডিজিটাল প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সম্পদ আহরণে নতুন উপায় ও চিন্তাধারার ব্যাপারে তারা তৎপর থাকবে। বস্তুত এরই মাঝে বাংলাদেশের ১১ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এ বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। ২০২৫ সালের মধ্যে আমাদের মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়াবে মোট জনসংখ্যার ৪১ শতাংশ। দ্রুত নগরায়নের ফলে বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও ৩ কোটিরও বেশি মধ্যবিত্ত আদতে এক বিশাল বাজার।’
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, অন্য অনেক দেশের মতোই আমাদেরও বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কিন্তু আমরা জানি কীভাবে তাকে সুযোগে পরিণত করতে হয়। এ বছর আমাদের অর্থনীতি ৮.১ শতাংশ উচ্চ প্রবৃদ্ধির রেকর্ড করেছে। আমরা দুই সংখ্যার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কাছাকাছি। ২০০৯ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি পেয়েছে ১৮৮ শতাংশ। বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার মার্কিন ডলার (প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার টাকা)।
‘আমাদের কৃষিখাত আর কেবলমাত্র নিজেদের প্রয়োজনই মেটায় না। স্বয়ংসম্পূর্ণতার বাইরে আমরা চাল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে চতুর্থ, শাকসবজি উৎপাদনে পঞ্চম ও অভ্যন্তরীণ মাছ উৎপাদন খাতে চতুর্থ। বিভিন্ন প্রধান শস্য ও ফলমূলের জিনগত উন্নয়নেও (জেনম ডিকোডিং) আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ২০০৯ সাল থেকে আমরা তৃণমূলের শতভাগ মানুষের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা নিশ্চিত করেছি। আমরা সাধারণ মানুষের উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে মনোযোগী। আর এসবের ফলেই এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। নগদ অর্থ লেনদেন কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। গত বছর আমাদের ই-কমার্স (অনলাইন লেনদেন) লেনদেন ছিল ২৬০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা)।’
বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশ বর্তমানে সবচেয়ে উদার বিনিয়োগ ব্যবস্থার সুযোগসুবিধা দিচ্ছে। এর মধ্যে আছে- বিদেশি বিনিয়োগের আইনি সুরক্ষা, উদার আর্থিক প্রণোদনা (ইনসেন্টিভ), যন্ত্রপাতি আমদানিতে বিশেষ ছাড়, অবাধ প্রস্থান নীতি, ব্যবসা উঠিয়ে নিতে চাইলে লভ্যাংশসহ সম্পূর্ণ মূলধন উত্তোলন নীতি ইত্যাদি। ওয়ান স্টপ সেবাসহ দেশজুড়ে আমরা ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছি। ইতোমধ্যেই ১২টি অঞ্চল চালু হয়েছে। এরমধ্যে দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য সংরক্ষিত। এছাড়া প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য বেশকিছু হাই-টেক পার্কও নির্মাণ করা হয়েছে।
এর পরপরই বাইরের বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে নেত্রী বলেন, পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারত, পশ্চিমে চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে অবস্থিত বাংলাদেশ বৈশ্বিক ও ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দারুণ এক অর্থনৈতিক অঞ্চল। আমরা এ অঞ্চলের জন্য অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করতে পারি। নিজের ১৬ কোটি ২০ লাখ মানুষের বাইরেও বাংলাদেশ ৩০০ কোটি মানুষের বিশাল এক বিশ্ব বাজারের সংযোগকারী হিসেবে কাজ করতে পারে।
‘গত বছর এইচএসবিসি (আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান) জানায়, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। এর চাবিকাঠি হলো দুটি। এর একটি হলো, ধর্মীয় সম্প্রীতি, উদার মূল্যবোধ ও অসাম্প্রদায়িকতাভিত্তিক মুক্ত সমাজ। আরেকটি হলো, আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর দুই তৃতীয়াংশই যুবসমাজ, যাদের বেশিরভাগেরই বয়স ২৫-এর নিচে। তারা যেমন দক্ষতা অর্জনে তৎপর, তেমনি প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে প্রতিযোগিতাপূর্ণ কর্মক্ষেত্রের জন্যও প্রস্তুত।’
বক্তব্যের শেষে আগামীতে আরও উন্নত বাংলাদেশের আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আত্মবিশ্বাসী জনগোষ্ঠী, দক্ষ নেতৃত্ব ও শাসন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে উন্নয়নের পথে চলতে চলতে আমরা ক্রমাগত শিখছি। বাংলাদেশ আপনাদের এক মানবিক রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, যার রয়েছে তৎপর ও দায়িত্বশীল নেতৃত্ব। এর সঙ্গে আছে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক ভিত্তি। বাস্তববাদী ও উন্মুক্ত অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল জাতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমন্ত্রণে চার দিনের সরকারি সফরে বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লি পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সফরে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক ও কয়েকটি চুক্তি সম্পাদনের কথা রয়েছে।
সুত্র:বাংলা নিউজ২৪ডটকম