পরিস্হিতি২৪ডটকম : চন্দনাইশ একটি প্রাচীন জনপদ। ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রাচীনতম জনবসতি অঞ্চল। ইতিহাস গবেষণায় প্রমাণ মেলে আজ হতে বারো হাজার বছর আগে আজকের ভূমি চন্দনাইশে নব্যপ্রস্তর সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো। তবে সেই সময় এই ভূমির নাম চন্দনাইশ ছিলো? না অন্যকোন নামে ছিলো? তা আজও অজানা। তবে যে বারো হাজার বছর আগে যে আজকের চন্দনাইশ নামক ভূমিতেই নব্য প্রস্তর সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো তা একদম সঠিক বলে বিবেচিত। প্রাচীন মানচিত্রের গবেষণায় তা প্রমাণ পাওয়া যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আমলে প্রস্তুতকৃত The London Series of Modern Map এ চন্দনাইশ অঞ্চলের অবস্থান ল্য করা যায়। উল্লেখিত ঐ ম্যাপে পর্যবেণ করলে দেখা যায়, বিগত ৫ শত বছরে চন্দনাইশ এলাকায় বহু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। অনুরুপ পরিবর্তন হিসেব করে পেছনে অগ্রসর হলে দেখা যায় যে, বিগত এক হাজার বছর পূর্বেও বর্তমান অঞ্চল বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। ম্যাপ ও ভূ-পৃষ্ট ভরাট সংশ্লেষ কিংবা ভূ-নিপেন, বিভাজন, চর-উত্থান, চর পতন ইত্যাদি বিবেচনা করলে বিগত দুই হাজার বছর পূর্বে চন্দনাইশ অঞ্চলের নানা পরিবর্তন হয়েছে। ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে স্থানের নামেরও পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তবে মুল এবং প্রায় অপবিরর্তনীয় ভূ-খন্ডের সদর অঞ্চলটির ভূ-অবস্থানগত পরিবর্তন কখনো চোখে পড়ার মতো ঘটেনি। আজকের চন্দনাইশের প্রাচীন অবস্থান কর্নফুলী নদীর দনি থেকে সাঙ্গু নদীর উত্তর সীমানা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলটি চন্দনাইশ নামে পরিচিত। সৃষ্টি থেকে এত বছর অতিবাহিত হলেও ইতিহাসের কারণে ও গবেষণায় সেটি উঠে এসেছে। আসলে ইতিহাস মানে কি? ইতিহাস শব্দের আভিধানিক অর্থ পুরাবৃত্ত, ইতিবৃত্ত ও প্রাচীন বৃত্তান্ত (past events)। তাছাড়া ইতিহাস শব্দ দ্বারা A true story অথবা A methodical record of public events কে বুঝানো হয়। ‘ইতিহাস’ শব্দটি ইংরেজি ‘History’ শব্দের প্রতিশব্দ। ‘History’ শব্দটি আবার গ্রীক শব্দ ‘Historia’ হতে উদ্ভূত। ‘Historia’ শব্দের An inquiry, designed to elicit truth অর্থাৎ সত্য প্রকাশ করার নিমিত্তে পরিকল্পিত অনুসন্ধান। তাহলে ইতিহাস বলতে আমরা এমন একটা বিষয়কে বুঝে থাকি, যে বিষয়টি ঘটে যাওয়া বিষয়ের উপর পরিকল্পিতভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে আমাদের সামনে সঠিক তথ্যকে উপস্থাপন করে। গ্রীক ঐতিহাসিক হিরোডোটাস সর্বপ্রথম তাঁর গবেষণা কর্মের নামকরণে ‘History’ শব্দটি ব্যবহার করেন এবং আজ পর্যন্ত বিষয়টি এ নামেই পরিচিত হয়ে আসছে। আমরা যারা ইতিহাসকর্মী হিসেবে কাজ করছি তাঁদের একটি ছোট প্রয়াস ছিলো “ঐতিহাসিক চন্দনাইশের ইতিহাস বিষয়ক সেমিনার ২০২০”। সেটি অনুষ্ঠিত হয়েছেল গত ৪ জানুয়ারি ২০২০, শনিবার সকাল ১০টায়, চট্টগ্রাম নগরীর চেরাগী পাহাড়স্থ সুপ্রভাত স্টুডিও হলে অনুষ্ঠিত সেমিনারে উল্লেখিত প্রবন্ধটি পঠিত হয়। সেমিনারে বিজ্ঞ আলোচকবৃন্দ, ইতিহাস গবেষক, লেখক, শিক্ষাবিদ বিষয়টির উপর আলোচনা করেন এবং গবেষণা প্রবন্ধে উপর একমত পোষন করেন। ইতিহাস গবেষণায় জানা যায়, ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড পর্বতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের কিছু মূল্যবান প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হওয়ার পর ইতিহাস পণ্ডিতবর্গের পূর্বাভিমত সম্পূর্ণ ভুল প্রতীয়মান হয়। এর পর নিজেরা নিজেদের অভিমত সংশোধনের গবেষণায় নেমে পড়েন। সীতাকুন্ড পর্বতের প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলো পণ্ডিতবর্গের গবেষণাকে নতুন ধারায় অলংকৃত করে চন্দনাইশ ও চট্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুন মাত্রা সংযোজন হয়। যার ফলে মহোঞ্জদারো-হরপ্পার মতো চন্দনাইশ একটি সুপ্রাচীন ভূ-খণ্ড হিসেবে প্রাচীন এলাকাসমূহ সম-মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হওয়ার গৌরব অর্জন করে। গ্রিক ভাষায় লিখিত এবং ১৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত টলেমির ভূগোলে Pentapolis নামে একটি এলাকার বিবরণ পাওয়া যায়। বর্ণিত Pentapolis (১৫০ক্ক – ১৮০ক্ক) এলাকাটির অবস্থান আরাকান ও বর্তমান চট্টগ্রামের মধ্যস্থ অঞ্চল তথা বর্তমান চন্দনাইশ-দোহাজারী অঞ্চল বলে জানা যায়। টলেমির ওই ভূগোলে বিধৃত Yokosanna ( ১৫৩ – ১৪০.৩০০) নামক নদীটি বর্তমান শঙ্খনদী বা কারো কারো মতে কর্ণফুলী নদী বলে অনুমিত হয়। সে হিসেবেও আলোচ্য এই এলাকা (চন্দনাইশ)-এর বয়স অতি প্রাচীন বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। আমাদের জন্মভূমি চন্দনাইশ সে থেকে মানববসতিতে আজ পর্যন্ত এসে চন্দনাইশ উপজেলা হয়ে আছে। সময়ের সাথে সাথে এই জনপদে শাসন, রাজনীতি-সমাজনীতি পরিবর্তন হয়ে আজকের বাংলাদেশের চন্দনাইশ। কখনো মগ, কখনো হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান দ্বারা শাসিত হয়েছিলো। আরাকান, বৃটিশ, মোগল, সুলতান, পাকিস্তানও শাসন করেছে এ অঞ্চলকে। এই ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও চন্দনাইশের বিভিন্ন এলাকায় প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ, প্রাচীন মন্দির, ইটের প্রকৃতি ইত্যাদি প্রমাণ করে যে, অতি প্রাচীনকাল হতে চন্দনাইশ এলাকায় বৌদ্ধ সভ্যতা ও কৃষ্টি গড়ে উঠেছিল, তার প্রমাণ চন্দনাশের বরমায় লওলীবাগ গ্রাম (চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বৌদ্ধ ভিক্ষু, ভান্তে ও শ্রমনকে লওলী নামে চিহ্নিত)। রাম এবং সীতা রামুর রামকোটে যাবার প্রাক্কালে জুলধিতে অবস্থান করেছিলেন বলে কিংবদন্তি আছে। জুলধি কর্ণফুলী উপজেলার একটি ইউনিয়নের নাম। ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজ ঐতিহাসিক জ্যো আ দ্যা বেরোস অঙ্কিত বাংলার ম্যাপ এবং তুর্কি নাবিক সিদি আলী চিলভীর বর্ণনানুসারে দেখা যায়, “এক সময় বর্তমান চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ প্রান্তের শেষ এলাকা হতে শুরু করে রামু ও কক্সবাজার সদরসহ পুরো এলাকাটি অখণ্ড রাজ্য ছিল এবং চন্দনাইশ ছিল এ রাজ্যের আঞ্চলিক কেন্দ্র। অতি প্রাচীনকালে বর্তমান দোহাজারী এলাকা রাজ্যের প্রধান ব্যবসায়িক প্রাণকেন্দ্র ছিল।” ঐতিহাসিক ড. হাসানদানিসহ অনেক গবেষকদের নিশ্চিত সিদ্ধান্ত ছিল যে, চট্টগ্রামের আবিষ্কৃত নিদর্শনসমূহ কমপে ৮-১০ হাজার বছর আগেকার মানুষের ব্যবহৃত হাতিযার। বর্ণিত আবিষ্কারসমূহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গবেষকেরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, আট হাজার হতে দশ হাজার বছর পূর্বে দক্ষিণ আরবের অনুরূপ গোলমস্তক বিশিষ্ট জনগোষ্ঠী চন্দনাইশ অঞ্চলে বসবাস করত। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুমান ঠিক হলে অতি প্রাচীনকালে চন্দনাইশ এলাকায় শিকারি মানুষের আগমন ঘটার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যাদের পরবর্তী গোষ্ঠী নব্যপ্রস্তর যুগের গোলমাথা বিশিষ্ট মানুষ। অর্থাৎ আজ হতে অনুমান ১২ হাজার বছর আগে চন্দনাইশ এলাকায় নব্যপ্রস্তর সভ্যতা গড়ে উঠেছে, যা নব্যপ্রস্তর যুগের ইতিহাসের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ। উল্লেখ্য বিশ্ব মানুষের ইতিহাসে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নব্যপ্রস্তর যুগের সময় হচ্ছে আজ হতে ১২-১৩ হাজার বছর পূর্বে। নব্যপ্রস্তর যুগ হতে উচ্চ প্রাচীন প্রস্তর যুগের সময়কাল ৪০ হাজার বছর। সে হিসেবে চন্দনাইশ এলাকায় কমপক্ষে ৩০/৪০ হাজার বছর পূর্বে উচ্চ-প্রাচীন প্রস্তর যুগের ‘হোমোসেপিয়াস ফসিলিস’ বা ‘ক্রোমনীয়’ মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল। পার্গিটা রচিত ভারতীয় দেশসমূহের মানচিত্রে বাংলাদেশের ভৌগোলিক ইতিহাসের একটি মোটামুটি স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। তাঁর মানচিত্রে সাগর নোপের অবস্থান ছাড়াও কিরাত, সেরোট, শ্রীত্রে প্রভৃতি স্থানের নাম চিহ্নিত করা হয়েছে। ডক্টর এস কে চ্যাটার্জী আরাকানের চট্টগ্রাম অঞ্চলকে প্রাচীন কিরাত রাজ্য বলে অভিহিত করেছেন। মহাভারতে বর্ণিত ‘কিরাত রাজ্য’ এবং গ্রিক ভৌগোলিকদের বিবরণে বর্ণিত ‘কিরাদীয় রাজ্য’ নামে পরিচিহ্নিত রাজ্যটিকে গবেষক ম্যাকক্রিন্ডল ও পার্টিজার চট্টগ্রাম বলে উল্লেখ করেছেন। উক্ত চট্টগ্রামের সীমানা বর্তমান টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত। তা সত্য হলে বর্তমান কর্ণফুলী তথা প্রাচীন চন্দনাইশ এলাকাও নিঃসন্দেহে কিরাত রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে অনুমান করা যায়। প্রবাদ আছে যে, মহাভারত যুগে এই অঞ্চল বলির পুত্র সুহ্মর বিখ্যাত রাজ্য ‘সুহ্ম দেশে’র অন্তর্ভুক্ত ছিল। উল্লেখ্য, সুহ্ম রাজ্যের আঞ্চলিক রাজধানী ছিল চন্দনাইশের কাঞ্চননগর বা দোহাজারী। রাজা সুহ্ম তাঁর রাজ্যালয়ের প্রধান কেন্দ্র এবং উপকেন্দ্রসমূহে ব্যবহৃত সমস্ত আসবাবপত্র বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকার বন হতে সংগৃহীত সেগুন ও চন্দন বৃক্ষ দ্বারা প্রস্তুত করাতেন। মহাভারতের স্লোকের বর্ণনায় আদিনাথের পথে যেতে চন্দাদেবকে অতিক্রম করে মহেশখালীতে গমন করিতে হইতো। চন্দাদেবের নামানুসারে চন্দনাইশ বলে মনে করেন অনেক গবেষক। অন্যদিকে সুগন্ধযুক্ত চন্দন কাঠ থেকে চন্দনাইশ বলেও মনে করেন অনেকে। আবার অন্যদিকে গৌতমবৌদ্ধের ধন্যবতীর রাজা চান্দসুরিয়ার নামেই চন্দনাইশ বলে মনে করা হয়। মানব বসতি ও পরবর্তী সময়ে মানব বসবাসের মানুষ ধর্মের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠে। হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমান-খ্রিস্টান-পাহাড়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস এখনও চন্দনাইশে রয়েছে। আমি আজ হতে ১৫/২০ বছর আগেও চন্দনাইশের কেশুয়া স্কুলের পাশে দুইজন পাহাড়ী আদিবাসী নর-নারীকে বসবাসরত দেখেছি। দোহাজারী, কাঞ্চননগর ও ধোপাছড়িতে আদিবাসীদের বসবাস রয়েছে। কালের বিবর্তে অনেক কিছু হারিয়েগেছে। বিশেষ করে প্রাচীন প্রত্ন সম্পদ, প্রত্ন স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে। অসচেতনতার কারণে ইতিহাসের মূল্যবান সম্পদ ধ্বংস হয়েগেছে। প্রাচীন সনাতনী ধর্ম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বসবাস থাকলেও বর্তমানে চন্দনাইশ এলাকায় মুসলমানের সংখ্যা অনেক বেশি। হিন্দুধর্মীয় তীর্থ শুকাম্বার দিঘী, মন্দির, বারুণী স্নান, বৌদ্ধ ধর্মীয় স্মৃতির মন্দির ও এক সময়ের লওলীবাগ। প্রাচীন এই জনপদে কখন থেকে মুসলমান আগমন ঘটে তা স্পষ্ট বলা কঠিন। তবে গবেষণায় জানা যায় পাহাড়ী জনপদ কাঞ্চননগরে হযরত মোস-তান আলী (রহ.) ও হযরত তাজ এ আলী (রহ.), চাঁনখালীতে হযরত মহসেন শাহ আরবী ফকির (রহ.), দোহাজারী জনপদে হযরত সৈয়দ জালাল আল দ্বীন বোখারী (রহ.) পবিত্র ইসলাম ধর্মের বার্তা নিয়ে এ অঞ্চলে আগমন করেন। তবে চট্টগ্রামে মুসলমান আগমন ঘটে স্বয়ং রাসূল (সা.) এর জামানায় হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.) মাধ্যমে। তিনি সাগর পথে ১৪ জন সাহাবায়ে রাসূলের দল নিয়ে চট্টগ্রামে আসেন। পরে তাঁরা ভারতের মনিপুর হয়ে চীন গমন করেন। আরেকটি মতে বলা হয়, রাজা সুহ্মা তাঁর রাজ্য পরিচালনার সময়ে এই অঞ্চলের পাহাড়ে চন্দন কাঠ জন্মাতো। চন্দন কাঠ অতিমূল্য বান। এই কাঠের সুগন্ধে মানুষ বিমোহিত হত। এই কাঠের তৈরী আসবাব পত্র ছিলো সমগ্র পৃথিবী জুড়ে পরিচিত। চন্দন কাঠ দিয়ে আসবাব পত্র ও জাহাজ তৈরী হতো। এই চন্দন কাঠের কারণে পরবর্তীতে চন্দনাইশ নাম করণ হয় বলে অনেকের ধারণা। দোহাজারী থেকে এই কাঠ সমুদ্রবর্তী একটি দ্বীপে নিয়েযেত। ওখানেই আসবাব পত্র নৌকা ও অন্যান্য কাঠের সমগ্রী তৈরী হতো। সেই দ্বীপের নামকরণ হয় চন্দন দ্বীপ নামে। দোহাজারী পূর্বদিকে বান্দারবান সংলগ্ন গহীন জঙ্গলে চন্দন পাহাড় নামে একটি পাহাড় ও মৌজাও রয়েছে। অন্যদিকে খুলনার কাছাকাছি এলাকায় চন্দন দ্বীপ নামে একটি দ্বীপের নামও ইতিহাসে পাওয়া যায়। অন্যদিকে চট্টগ্রাম ও চন্দনাইশ সৃষ্টির ইতিহাস কিন্তু আলাদা প্রক্রিয়ার ভিন্ন ভৌগলিক পরিব্যাপ্তি রয়েছে। পটিয়া-চন্দনাইশ এলাকার মাটি সঞ্চয়নের ইতিহাস আরাকান, বার্মা, পেগু, নেপাল, পার্বত্য বান্দরবান প্রভৃতির সাথে যুক্ত। কারণ চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূ-ভাগটি মূলত হিমালয় উদ্ভুত, বাংলাদেশের বাকি অংশের সৃষ্টি-গঠনের সঙ্গে এর কোনো প্রকৃতি এবং সৃষ্টি প্রক্রিয়াগত মিল নেই। বরেন্দ্র এলাকার বয়সের চেয়েও চন্দনাইশ-চট্টগ্রাম এলাকার বয়স অনেক বেশি বলে ঐতিহাসিকদের ধারণা। সীতাকুন্ড, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও পটিয়া কক্সবাজার, চন্দনাইশ এলাকা এবং প্রাচীন বলে স্বীকৃত উচু পর্বতসমূহের কয়েকটির মাটি পরীা করে বর্ণিত অঞ্চলের মাটির ধরণ, প্রকৃতি এবং সমন্বিত বৈশিষ্ট্য একই রকম দেখা গিয়েছে। বিশেষ করে সীতাকুন্ড এবং চন্দনাইশ অঞ্চলের মাটিতে বিদ্যমান রাসায়নিক উপাদানসূহের মাত্রাও প্রায় অভিন্ন। এ থেকে সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, চট্টগ্রাম একটি সুপ্রাচীন ভূখন্ড যা উৎপত্তিগত বিবেচনায় নিশ্চিতভাবে কমপে সীতাকুন্ড এলাকার সামসময়িক, যার বয়স পমপে ৪০/৫০ হাজার বছর। যেহেতু সীতাকুন্ড এলাকার তৎকালীন অবস্থান তুলনায় সমুদ্রতট হতে চন্দনাইশের দূরত্ব অধিক ছিল সেহেতু ঐতিহাসিক সুরেশ চন্দ্র দত্তের গবেষণা মতে পটিয়ার বয়স সীতাকুন্ড হতে অধিক হওয়ার কথা। গবেষণা এবং প্রতœতাত্তিক আবিষ্কারসমূহ এটাই ইঙ্গিত দেয়, আজ হতে ৫০ হাজার বছর পূর্বেও চন্দনাইশ অঞ্চলের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। হয়তো নাম তখন চন্দনাইশ ছিল না কিংবা কোনো নামই ছিল না, কিন্তু বর্তমান চন্দনাইশ নামক উপজেলা এলাকাটির স্থানিক স্থিতি অবশ্যই ছিল। চন্দনাইশ সুপ্রাচীন একটি ঐতিহাসিক ইতিহাস বা জনপদের নাম। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ একটি আধুনিক উপজেলা। পাহাড় ও সমতল নদ-নদী পরিবেষ্টিত এই উপজেলার অবস্থান মনোরম। বিখ্যাত শঙ্খ নদী, বরুমতি, চাঁদখালী নদী আজও এই উপজেলার শ্রী বৃদ্ধি করে রেখেছে। চন্দনাইশ উপজেলায় দুটি পৌরসভা ও আটটি ইউনিয়ন রয়েছে। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ও ুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাসও আছে। চন্দনাইশ প্রাচীনকাল থেকে চামুদরিয়া, যতরমুখ বন্দর, দোহাজারী ও মুন্সেফহাট বিখ্যাত বাণিজ্যিক স্থান। সময়ের পরিবর্তে সবকিছু বিলীন হলেও আজও দোহাজারী বাণিজ্যিক শহর ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চামুদরিয়া ও সমুদ্রবন্দরের অস্তিত্ব বিলীন। কেবল চামুদরিয়া এখন একটি গ্রামের নাম। চন্দনাইশের আয়তন ২০১.৯৯ বর্গকিলোমিটর, জনসংখ্যা ২ লক্ষ ৩৩ হাজার ১১৭ জন, পুরুষ ১ লক্ষ ১৭ হাজার ৪২৮ জন, মহিলা ১ লক্ষ ১৫ হাজার ৫৯৯ জন। মুসলিম ২ লক্ষ ৭২ জন, হিন্দু ২৭ হাজার ১৬২ জন, বৌদ্ধ ৫ হাজার ৬৬ জন, খ্রিস্টান ৫৬৪ জন। অন্যজাতি ১৭৩ জন। চন্দনাইশ ভূতপূর্ব পটিয়ার সাথে প্রশাসনিকভাবে সংযুক্ত ছিল থানা হিসেবে। ১৯৭৬ সালে চন্দনাইশ থানা সৃষ্টি করেন কর্নেল (অবঃ) অলি আহমেদ বীরবিক্রমের প্রচেষ্টায়। ১৯৮৩ সালে চন্দনাইশ থানাকে উপজেলা রূপান্তর করা হয়। চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া আংশিক এলাকা নিয়ে জাতীয় সংসদীয় আসন, বর্তমান সংসদ সদস্য আলহাজ্ব নজরুল ইসলাম চৌধুরী। প্রাক্তন সংসদ সদস্য কর্নেল (অবঃ) অলি আহমদ বীরবিক্রম। উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল জাব্বার চৌধুরী। চন্দনাইশ সদর পৌরসভার চেয়ারম্যান মাহাবুবুল আলম খোকা। নবগঠিত দোহাজারী পৌরসভার প্রশাসক চন্দনাইশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আ.ন.ম বদরুদ্দোজা। চন্দনাইশে দুটি সরকারি ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল রয়েছে। একটি সরকারি কলেজ। একটি বেসরকারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সৃষ্টি থেকে এই পর্যন্ত চন্দনাইশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য গৌরবময়। বিশেষ করে বাণিজ্যিক ইতিহাস প্রাচীন সময় থেকে সমগ্র বিশ্বের সাথে যোগাযোগ ছিল। বৃটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে চন্দনাইশের কৃতী বীরসন্তানদের ভূমিকা অপরিসীম। ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরুর দিকে চন্দনাইশের কৃতিপুরুষ হাবিলদার রজব আলীর সিপাহী বিদ্রোহ, বৃটিশ আন্দোলনে যাত্রামোহন সেনগুপ্ত, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, নেলী সেনগুপ্ত, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মাওলানা আবদুল হামিদ ফখরে বাংলা, বিপ্লবী মহেষচন্দ্র বড়ুয়া, কবিয়াল করিম বখসু, ভাষা আন্দোলনের স্থপতি অধ্য আবুল কাসেম, অধ্যাপক সোলায়মান আলম এর অবদান স্মরণীয়। জেমসেনদের পৈত্রিক নিবাস বরমাতে মহাত্মা গান্ধির আগমনে ধন্য। বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, সাবকে রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ফখরুদ্দীন আহমেদসহ বিশ্ববরেণ্য অনেক ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ এই চন্দনাইশে আগমনে ধন্য করেছিলেন। আরাকান, মগ শাসন আমলে চামুদরিয়া একটি সমুদ্রবন্দর ছিল। পরে যতরমুখ বন্দর, প্রাচীন দোহাজারী শহর, মুন্সেফবাজার নদী বন্দরের অস্থিত্ব বিলীন হয়ে গেলেও দোহাজারীর প্রাচীন অবস্থান এখনো বিদ্যমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ স্মৃতি দোহাজারী রাশিয়ান ফিল্ড ও দেওয়ান হাটের পার্শ্ববর্তী বৃটিশ সময়ের বিমানবন্দরের চিহ্ন এখনো মুছে যায়নি। হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমান-মগ শাসন আমলের অনেক স্মৃতির চিহ্ন এখনো চন্দনাইশের বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যমান রয়েছে। আজকে আমাদের এই সেমিনারের মাধ্যমে বর্তমান নবপ্রজন্মের চন্দনাইশের ছাত্র-ছাত্রী ও তরুণদের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে কিছু বলা কিংবা গৌরবের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। এই প্রজন্মের হাতে চন্দনাইশের সোনালী ইতিহাস তুলে দিলাম। সংরণের দায়িত্ব তাঁদের। আসুন আমরা সকলে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি চন্দনাইশকে ভালবেসে তার প্রকৃত ইতিহাস বিশ্বদরবারে তুলে ধরি। বর্তমান প্রজন্ম যেন এই চর্চা থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেয়।
তথ্য সময়ক গ্রন্থ: ড.মোহাম্মদ আমিন-ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মৃন্ময় স্মারক; চন্দনাইশের ইতিহাস-সোহেল মো. ফখরুদ-দীন; বাংলার ইতিহাস ১ খণ্ড, রাখাল দাশ বন্দ্যোপাধ্যায়; নৃতত্ত্ব, প্রাক ইতিহাস, এবনে গোলাম সামাদ; রামুর পুরোনো ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ইসলামাবাদ: আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ; চট্টগ্রামের ইতিকথা-ড. আহমদ শরীফ; মানুষের ইতিহাস প্রাচীন যুগ আবদুল হালিম ও নুর নাহার বেগম; চন্দনাইশের ইতিহাসÑসোহেল মো. ফখরুদ-দীন ১ম খণ্ড ও ২য় খণ্ড; ইতিহাস পত্রিকা কিরাত বাংলা, চন্দনাইশের ইতিহাস প্রবন্ধ দৈনিক পূর্বকোণ, মুঘোল যোদ্ধা আধুখাঁর দোহাজারী প্রবন্ধ দৈনিক ইনকিলাব। উপমহাদেশের আইন ও শাসনের ইতিহাস-আবদুস সালাম মামুন, চন্দনাইশ মনীষী-বদিউল আলম।
লেখক : সোহেল মো. ফখরুদ-দীন, গ্রন্থপ্রণেতা ও ইতিহাসবেত্তা।
সভাপতি, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র।