পরিস্হিতি২৪ডটকম/অতিথি লেখক-ড. আশিস কুমার বৈদ্য : সৌভাগ্যক্রমে সোহেল মো. ফখরুদ-দীন মহোদয়ের একটি সংক্ষিপ্ত অথচ সারগর্ভ প্রবন্ধ পড়ার সুযোগ পেলাম, তাও প্রখ্যাত গবেষক, ইতিহাসবিদ, বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, সুলেখক ও হৃদয়বান প্রিয়জান সোহেল মো. ফখরুদ-দীন মহোদয়ের বদান্যতায়। এটি পড়ার সুযোগ না পেলে ইতিহাসের সোনালী অধ্যায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমার কাছে অজানা থেকে যেতো। বাংলা মায়ের সুসন্তানরূপে, বিশেষ করে চট্টগ্রামের কোল আলো করে আপন কর্ম-কৃতিত্বে ক্রমপ্রসারমাণতায় সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের গৌরবময় ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার যে মহতি প্রয়াস তাঁর তথ্যবহুল, বস্তুনিষ্ঠ, ইতিহাসচেতনাশ্রয়ী নৈপুণ্যে তিনি তুলে ধরেছেন তাতে আমার ‘বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন’ হলো।
ইতিহাসচর্চার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলেও এতে সাহিত্যের প্রসাদগুণ যুক্ত করার তেমন সুযোগ নেই। তবুও সম ইতিহাসবেত্তার সুনিপুণ লেখনিতে ইতিহাস নিরস বিষয় হয়ে থাকে না। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, ইতিহাস গবেষণা ও ত্রেসমীা সাপেতায় অন্যখাতে প্রবাহমান। এ কথা সত্যি যে, ইতিহাসচেতনা, প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণা অতীতের অবগুণ্ঠন মোচনে সহায়ক এবং আবশ্যিক বিষয়। উত্তরসূরি হিসেবে পূর্বসূরিদের কর্মকীর্তির নিরিখে আমরা বর্তমান ও ভবিষ্যতের পথরেখা নির্মাণ করি। এছাড়া মানব সভ্যতার অগ্রগতি অসম্ভব। এই অমোঘ সত্যটি উপলব্ধি করেই সোহেল মো. ফখরুদ-দীন মহোদয়গণ ইতিহাসচর্চায় সংগঠন গড়েছেন। এদেশে এ ধরনের সংগঠনের সংখ্যা খুব কম। ইতিহাস একটি বহতা নদীর মতো নিত্য চলমান। ঐতিহাসিকগণ ঐকান্তিক নিষ্ঠায় ভৌগোলিক, নৃতাত্ত্বিক, প্রতœতাত্ত্বিক, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-স্থাপত্য-ভাস্কর্য-শিল্পকলাদি নানা বিষয় সমন্বিত বিবরণ তৈরি করেন, বিশ্লেষণ করে, অগ্রগমনের ধারাকে অনুসরণের পথ নির্দেশনা প্রস্তুত করেন। ইতিহাস বিস্মৃতি মানেই আত্মবিস্মৃতি। আর আত্মবিস্মৃতি জাতির অস্তিত্ব থাকে প্রশ্নকন্টকিত। তাই বিজ্ঞানসম্মত গবেষণার মাধ্যমে ইতিহাসানুরাগীদের নিরন্তর গবেষণার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। এেেত্র গ্রহণ-বর্জনের বিষয়টাও আছে। কারণ অনেক সময় নতুন আবিষ্কার পুরনো ধারণাকে বদলে দেয়। নতুন তথ্য উঠে আসে। ইতিহাসের গবেষণামাত্রই সেই দুটি বিষয়ের প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি নিবন্ধ রাখতে হয়। সে দুটি বিষয় হলো: এক. ভৌগোলিক অবস্থান; দুই. কালানুক্রমিক তত্ত্ব (ঈযৎড়হড়ষড়মু)। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে কেবল রাজা-মহারাজাদের উত্থান-পতনের কথাই থাকে না, বেশি করে থাকে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনার কথা, অগ্রগমনের ধারা। খুব কঠিন কাজ করতে হয় ইতিহাসবিদগণের। কারণ, বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে আলোকময় পথে এগিয়ে দেবার দায়ভার তাঁরা স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন। সোহেল মো. ফখরুদ-দীন তাঁদেরই একজন। তিনি প্রাচীন চট্টগ্রাম ও কিরাত বাংলা সম্পর্কে তথ্যনিষ্ঠ আলোচনায় লিখেছেন যে, “পার্গিতার মানচিত্রে কিরাত রাজ্যের অবস্থান দেখানো হয়েছে। দেখানে হয়েছে সিরোট, আরাকান, শ্রীত্রেকেও। প্রাবন্ধিক সোহেল সাহেব লিখেছেন, হিমালয় পর্বত থেকে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত পর্বতমালাজুড়েই কিরাত রাজ্য গড়ে উঠেছিল সুদূর অতীতকালে। ঐ রাজ্যে বসবাসকারীগণ কিরাত সমাজভুক্ত মানুষ। এরা অনার্য। মঙ্গোলীয়, অস্ট্রো-মঙ্গোলীয়ান জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এরা। পার্বত্য চট্টগ্রামের কিরাত জনসমাজ উত্তর পূর্ব ভারতের পাহাড়ি ঢল তথা পার্বত্য অঞ্চলের উপত্যকা থেকে এসে বসতি গড়েন।” ড. এস কে চ্যাটার্জীর গবেষণা পত্রে আছে, চট্টগ্রাম-আরাকান অঞ্চলেই প্রাচীন কিরাতভূমি। তারপরেও কথা থেকে যায়। কিরাত রাজ্যের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নেই। আরাকানী রাজার অনুকূলে সে অঞ্চলের একটি ইতিবৃত্ত রচিত হয়েছিল, কিন্তু চট্টগ্রামের ইতিহাস অনুপস্থিত। ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে প্রশ্ন জাগে কিরাতভূমির ভাষা, সংস্কৃতির স্বরূপ কেমন ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর না মিললে বৃহৎ বাংলার ইতিহাস পরিপূর্ণতা পাবে নাÑএ কথা জেনেই সোহেল মো. ফখরুদ-দীন মহোদয় চট্টগ্রামের ইতিহাসকে বিশদভাবে জানতে অনুসন্ধানী গবেষকের কাজে ব্রতী হয়েছেন। চট্টগ্রাম, মহাস্থানগড়, আরাকান, বরাক উপত্যকা সব মিলিয়ে একটি সুবিস্তৃত কিরাতভূমি ছিল, যার প্রভাব বঙ্গভূমিকেও পরিপুষ্ট করেছে। কিরাতের ইতিবৃত্তকে সম্যকরূপে জানা মানেই শেকড়ের সন্ধানে ব্রতী হওয়ার সার্থকতা।
এই মহান ব্রতের অঙ্গ রূপেই “কিরাত বাংলা”র আত্মপ্রকাশ। প্রাবন্ধিকের প্রদত্ত বিবরণে পাচ্ছি, স্বাধীনতা সংগ্রামী, প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব, শতায়ুপ্রাপ্ত বর্ষীয়ান যুগপুরুষ বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরীর জন্মশতবর্ষের পূর্তি লগ্নে তাঁর হাত দিয়ে “কিরাত বাংলা” নামক ইতিহাসবিষয়ক মুখপত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। ২০০৯ সালে নামেই উপলব্ধ হয় যে, কিরাত নামক উপজাতি বা জনজাতি সমাজের সঙ্গে বাঙালি জাতির মেলবন্ধন ঘটেছিল বহুকাল আগে। কিরাতভূমি ক্রমে বঙ্গভূমির সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিল সৌভ্রাতৃত্বের, মৈত্রীবোধের ব্যাকুল আশ্বাসে। অবশ্য প্রত্যেকেই আপন বৈশিষ্ট্য, স্বাতন্ত্র্য, স্বাধীকার, ভাষা ও সংস্কৃতিকে বজায় রেখেছে লালন-পালন-অনুশীলনে। স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম পরস্পর বিরোধী নয়, পরিপূরক। মানবতাবোধই এই দুয়ের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটায়।
বীরভূমি চট্টগ্রাম সিপাহী বিদ্রোহের (১৮৫৭ খ্রি.) সময় থেকেই ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে ১৯৪৭ সন পর্যন্ত। তারপরও লড়াই করতে হয়েছে পাকিস্তানি আধা ঔপনিবেশবাদী স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঐতিহাসিক ঘটনা চট্টগ্রামকে বিশ্ববাসীর কাছে সমধিক পরিচিতি দিয়েছে। সোহেল মো. ফখরুদ-দীন মহাশয় বিপ্লবী মহানায়ক সূর্যসেনকে নিয়েও গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রচনা করে আরো একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। আগামী বইমেলায় (আগরতলা) আমরা একটি পড়ার সুযোগ পাবো। তাঁর লিখিত প্রবন্ধটির ভাষা প্রাঞ্জল, মনোগ্রাহী, ঐতিহাসিক উপাদানে ভরা, গবেষণাধর্মী। আমি সবটা নিয়ে আলোচনা করলাম না, উৎসাহী পাঠকগণ সংগ্রহপূর্বক পড়ে নেবেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রামের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। সিপাহী বিদ্রোহ, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম (যেটি শুরু হয়েছিল সিপাহী বিদ্রোহ থেকেই), পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ-সামগ্রিকভাবে কিরাতবাসীদের অবদানের কথা স্বর্ণারে লেখা থাকবে।
চট্টগ্রামের সঙ্গে ত্রিপুরার সম্পর্ক সুদীর্ঘ কালের। ত্রিপুরাধীপতিগণের পূর্বপুরুষ মহারাজ ত্রিপুরও কিরাত অঞ্চলের উত্তরাংশে রাজত্ব করেছেন। একথা ত্রিপুরার প্রাচীনতম ইতিবৃত্ত ‘রাজমালা’র ত্রিপুরখণ্ডে উল্লেখিত হয়েছে। বরাক অঞ্চল থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত প্রলম্বিত একটি সুদীর্ঘ পর্বত আছে। এই পার্বত্য অঞ্চলজুড়েই জনজাতি সম্প্রদায়ের বাসভূমি গড়ে উঠেছিল। তাদের পাশাপাশি বাঙালিরাও বসবাস করতেন নানা স্থানে। ভুবন পাহাড়, সূর্যপাহাড়, উনকোটি পাহাড়, কালাবারি, দেবতামুড়াপাহাড় সর্বত্রই প্রাচীনকালের নানা স্থাপত্য ভাস্কর্য শিল্পের নিদর্শন মিলেছে। এসবের অধিকাংশই কিরাতগোষ্ঠীর অবদান। তাদের এই কাজের অংশীদার বাঙালি জনসমাজও। ত্রিপুরার উত্তরাংশে বরাক উপত্যকায় কিরাত রাজ্যের অস্তিত্বের কথা পাই রাজমালায়। এখানে উল্লেখিত হয়েছে:
“কিরাত নগরে রাজা বিবিধ গঠন।
রাজ্যের সীমা কহি শুনহ রাজন ॥
উত্তরে তৈরঙ্গনদী দেিণ রসাঙ্গ।
পূর্বতে মেখলি সীমা পশ্চিমে কাচবঙ্গ ॥”
মনে হয় একসময় চট্টগ্রামের কিরাতভূমির সঙ্গে বরাক উপত্যকার কিরাতভূমির নিবিড় সম্পর্ক ছিল। আলোচনা না বাড়িয়ে লিখি যে এ বিষয়ে গবেষণা চলুক। ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরাধীপতি ধন্যমাণিক্য চট্টগ্রাম থেকে কষ্টিপাথরের নির্মিত একটি মূর্তি নিয়ে এসে ত্রিপুরার তদানিন্তন রাজধানী রাঙামাটি তথা উদয়পুরে প্রতিষ্ঠানের দেবীর নামকরণ করেন ‘ত্রিপুরেশ্বরী’। নিজের প্রচারিত মুদ্রায় নিজেদের ‘ত্রিপুরেন্দ্র’ নামে অভিহিত করেন। ঐতিহাসিকগণের মতে ঐতিহাসিকভাবে এই প্রথম ‘ত্রিপুরা’ নামটি পাওয়া গেল। ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির ত্রিপুরার সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থভূমি, পীঠস্থান। ত্রিপুরাধীপতি গোবিন্দমাণিক্য রাজ্যহারা হয়ে আরাকান-চট্টগ্রাম অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরে রাজ্য ফিরে পান। সবদিক মিলিয়ে বলা যায়, তীর্থময়ী, বীরগাথায় পরিপূর্ণ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে পীঠভূমি অপরূপা চট্টগ্রামকে নিয়ে আমরাও গর্বিত।
এই গৌরবগাথামণ্ডিত, ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রামের ইতিহাস রচনায় যাঁরা ব্রতী হয়েছেন তাঁরা আমার নমস্য ব্যক্তি। পরিশেষে আমি ‘কিরাত বাংলা’র ৯ম বর্ষপূর্তিতে ও লেখক মিলন মেলা- ২০১৮ বহুল প্রচার, প্রসার, লোকপ্রিয়তার ধারা অব্যাহত থাকুক সর্বান্তকরণে এই কামনা করি। আলোচ্য প্রবন্ধে সোহেল মো. ফখরুদ-দীন আমরা কিরাতভূমি সম্পর্কে বহু অজানা তথ্যের উপর আলোকপাত করে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। তাঁর কাছ থেকে আরো অনেক কিছু জানার অপোয় রইলাম। সর্বোপরি তাঁর এই প্রবন্ধটির নিবিড় পাঠে সমৃদ্ধ হতে নবীন প্রজন্মের প্রতি আশ্বাস রাখলাম।
লেখক: আগরতলা, ত্রিপুরা, ভারত