পরিস্হিতি২৪ডটকম : সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমার এই বাংলাদেশ ।অতীব দু:খ যে নানান কারনে তা আজ শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। অভাব ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে জনজীবন দুঃখ ও হাহাকারে ভিবিষিকাময়।আমরা জানি যে, বেঁচে থাকার মূল রসদ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা উপাদানগুলো না পেলে জীবনে ছন্দপতন হয়। আর নিত্যপণ্য দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি তার অন্যতম কারণ। দেশে মাসে মাসেই যদি নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে তাহলে বহু মানুষেরই জীবন অনিরাপদ হয়। স্বাভাবিক জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়ে। দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি মানুষকে অর্ধাহার ও অনাহারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। জনগণ সব সময় প্রত্যাশা করে একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে নয়, প্রতিকূলে।এখনো বাংলাদেশে হাজার হাজার মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে ।অনেকদিন ধরেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে সংবাদমাধ্যম সরব। তারপরও বাজার পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। হঠাৎ করেই কারণে-অকারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ সংকটে পড়েছে।এমনিতে করোনা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পরে পুরো বিশ্বেই অর্থনৈতিক মন্দা অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তার বিশাল প্রভাব পড়েছে আমাদের অর্থনীতির ওপর। তার উপর সারাদেশের বাজারে চাল থেকে শুরু করে অতি প্রয়োজনীয় সব দ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া। নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের জাঁতাকলে মধ্য ও নিম্নবিত্তে নাভিশ্বাস উঠেছে। শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মূল্য নয়, সর্বস্তরে যেমন : বাস, ট্রেন, বিমান ও লঞ্চ ভাড়া, রিকশা ভাড়া, গ্যাস, বিদ্যুৎ পানিসহ সব পরিষেবার দামও কয়েক গুণ বেড়েছে।
অথচ এক বা দুই দশক আগেও এ অবস্থা ছিল না। শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত, যেটি এখন রূপকথা। ব্রিটিশ শাসনামলেও দ্রব্যমূল্য ছিল নিয়ন্ত্রিত অবস্থায়। মন্বন্তর, চরম দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা আর ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দেশের অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটলেও দ্রব্যের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ছিল। ১৯৭১ সালে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্মের পর অর্থনৈতিক বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষ ও মহামারী আমাদের জীবনে অতর্কিত হানা দেয়। ক্রমেই নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশির ভাগ দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে থাকে। আর এরই ধারাবাহিকতার চরম পর্যায় চলছে এখন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ভবিষ্যতে এ অবস্থা আরো নাজুক হবে, যা মানুষের কাম্য নয়।
চাল, ডাল, আটা, তেল, পেঁয়াজ, চিনিসহ সব ধরনের কাঁচামাল বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে ৬৫-৭০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়েছে। করোনা-পরবর্তী সময়ে মানুষের আয় রোজগার স্বাভাবিক হয়নি। এর মধ্যে খুলেছে বাচ্চাদের স্কুল, নানা ক্ষেত্রে ব্যয় বেড়েছে। এ অবস্থায় নিত্যপণ্যের চড়া দাম সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সরকারের নানা পদক্ষেপেও বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মতে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এক মাসে প্রায় ১৯.৬৪% বেড়ে গেছে। এক মাসের ভেতর দ্রব্যমূল্য এতটা বাড়তে আগে কখনও দেখা যায়নি!সরকারের সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুসারে, গত এক মাসের ব্যবধানে বিভিন্ন পণ্যের দাম প্রায় ১৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এর মধ্যে আটা সাদা (খোলা) ১.৪৯ শতাংশ, সয়াবিন তেল (খোলা) ৩.৭৭ শতাংশ, পাম অয়েল (খোলা) .৭৯ শতাংশ, পাম অয়েল (সুপার) .৩৮ শতাংশ, পেঁয়াজ (দেশি) ১১.৫৪ শতাংশ, পেঁয়াজ (আমদানি) ১৩.৬৪ শতাংশ, রসুন (আমদানি) ৮.৭০ শতাংশ, আদা (আমদানি) ৪.৩৫ শতাংশ, লবঙ্গ ২.২৭ শতাংশ, মুরগি (ব্রয়লার) ১.৪৯ শতাংশ, চিনি .৬৩ শতাংশ।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদন অনুসারে, গত এক বছরের ব্যবধানে নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো পণ্যের দাম কমেনি; বরং পণ্যভেদে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়েছে। এর মধ্যে চাল মোটা কেজিতে বেড়েছে ৭.৫৬ শতাংশ, সয়াবিন তেল লিটারে ৩৮ শতাংশ, পাম অয়েল খোলা লিটারে ৭০.৩৮ শতাংশ, পাম অয়েল সুপার লিটারে ৬১ শতাংশ, চিনি কেজিতে ২৬ শতাংশ, আমদানি করা পেঁয়াজ কেজিতে ৩০ শতাংশ ও আমদানি করা রসুন কেজিতে বেড়েছে ৬৪ শতাংশ পর্যন্ত।
চাল-ডালের পাশাপাশি আটা, চিনি, তরকারি, মাছ, মাংসের দাম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিম্নস্তরে চলে যাচ্ছে। বর্তমানে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। শুধু দরিদ্র নয়, মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চ মধ্যবিত্ত মানুষের প্রতিদিনকার জীবনযাত্রা অনেক কঠিন হয়ে গেছে। অসাধু এবং অতি লোভী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট জিনিসপত্র মজুদ রেখে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে তুলছে। যার ফলে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্র্রব্যাদির কৃত্রিম সংকট তৈরি হচ্ছে, ধরে রাখা যাচ্ছে না ঊর্ধ্বমূল্যের লাগামহীন ঘোড়া।নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারের এ দুর্বিষহ অবস্থা দু-একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ানোর যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে তা থেকে দেশের সব পর্যায়ের ভোক্তা-ক্রেতা শ্রেণির যেন পরিত্রাণ নেই।বাজার মনিটরিং টিম থেকে দাম নিয়ন্ত্রণের সরকারি বিভিন্ন সংস্থা থাকলেও মাঠের বাস্তবতা ভিন্ন। খেয়াল রাখতে হবে, ব্যবসায়ী যেন সিন্ডিকেট করতে না পারে। বাজারে সব পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিতের পাশাপাশি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অধিক মূল্যে পণ্য বিক্রেতা এবং নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনাসহ নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।দেশের কালোবাজারি, চোরাচালানি যারা দৈত্যের মতো জনগণের ওপর চেপে বসে আছে, তাদের কর্মকাণ্ড রোধ করতে হবে সবার আগে।
পণ্যমূল্য যাতে ভোক্তাদের সাধ্যের মধ্যে থাকে তার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে। মনিটরিং বাড়াতে হবে। পণ্য যেন ভোক্তাসাধারণের কাছে সহজলভ্য হয়, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। এজন্য সরকারকে সতর্কভাবে গোটা পরিস্থিতি মনিটরিং করতে হবে এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে একাধিক বৈঠক করে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। কঠোর হুঁশিয়ারিও দেয়া হয়, নেয়া হয় নানা উদ্যোগও। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা খুবই শক্তিমান, তারা সব সময়ই থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সরকার বারবার বলার পরও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। এজন্য সরকারের আরো নজরদারি বাড়াতে হবে। সরকার যদি ব্যবসায়ীদের কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাহলে সাধারণ মানুষ নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করতে পারবে। সাধারণ মানুষের ওপর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ক্রমবর্ধমান চাপ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোধ করা প্রয়োজন। এজন্য দেশের মজুতদারি, পণ্যের কৃত্রিম সংকট ও চোরাচালানি-কালোবাজারি রোধ করতে হবে সবার আগে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হতে হবে আরো কঠোর ও দায়িত্বশীল।
গ্রামীণ পর্যায়ে কৃষকদের ঋণদানসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে যাতে তারা সহজে পণ্য বাজারজাত করতে পারে এবং ন্যায্য মূল্যে উৎপাদিত পণ্য বিক্রয় করতে পারে। বাজারের নিয়ন্ত্রণ সরকার নিতে না পারলে কোনোভাবেই পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা সম্ভব হবে না। কাজেই সরকারকে মূল ভূমিকা নিতে হবে।
সরকারকে অতিলোভী মুনাফাভোগী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স গ্রহণ করতে হবে। এই লোভী শ্রেণি দমনের ক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে। এ ছাড়া শক্ত হাতে নিয়মিত বাজার মনিটরের ব্যবস্থা করতে হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুততর সময়ের মধ্যে জেল বা জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে। হঠাৎ করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে জনজীবনে অস্থিরতা তৈরি হয়। তাই সরকারকে সুষ্ঠু বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রেখে জনজীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে।বিক্রেতারা যাতে ইচ্ছামতো দ্রব্যমূল্য বাড়াতে না পারে সে জন্য সরকার এরই মধ্যে দোকানে পণ্যের নির্ধারিত মূল্য তালিকা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছে। বিষয়টি মনিটরিং করার জন্য ‘টিসিবিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তির ব্যবস্থা করেছে সরকার। সরকারি ও বেসরকারিভাবে এ ব্যাপারে আরো শক্তিশালী ভূমিকা পালন করলে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল থাকবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। শুধু সরকার নয় সাধারণ মানুষকেও দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধের জন্য সামাজিকভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। অসৎ ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে।বেচেঁ থাকার তাগিদে সাধারণ মানুষ এরকম একটি বাজার ব্যবস্থা প্রত্যাশা করে।ব্যাবসায়ী ,সাধারণ জনগন আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী, ভোক্তা অধিদপ্তর সহ সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব বলে মনে করি ।তবেই প্রতিষ্টিত হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা আর স্বার্থক হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মানে মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, প্রতিষ্টাতা সাধারণ সম্পাদক – বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি (বাপউস)।