পরিস্হিতি২৪ডটকম : জন্মভূমির ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিবেশের প্রতি থাকে মানুষের এক ধরণের আবেগময় অনুরাগ। জন্মভূমির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে গড়ে ওঠে তাদের শেকড়ের বন্ধন। স্বদেশের প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি এহেন অনুরাগ ও বন্ধনের নামই মূলত ‘দেশপ্রেম’। এই মা, মাতৃভূমি আর মাতৃভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসার আবেগপূর্ণ প্রকাশ ঘটে স্বদেশপ্রেমের মধ্যে। সে সীমাহীন আবেগের পরিচয় আমরা পাই রবীন্দ্রনাথের ‘স্বদেশ বন্দনায়’। যেমনটি তিনি বলেছিলেন, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে,/সার্থক জনম মাগো, তোমায় ভালোবেসে।’ এ ছাড়াও প্যালেস্টাইনের এক কবি বলেছেন, “স্বদেশের মাটি স্পর্শ করার সময় ছাড়া আমার শির আর কখনও নত হয় না।” কবির এ উচ্চারণে ফুটে উঠেছে স্বদেশের জন্য ভালোবাসা, গভীর অনুভূতি। মূলত দেশপ্রেম এক সহজাত অনুভব। প্রতিটি মানুষের অন্তরে এ অনুভব উজ্জ্বল আলোর মতো জেগে থাকে। দেশের প্রতি যার ভালোবাসা নেই, তার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। দেশের মাটি মায়ের মতো। সে জন্যই দেশকে বলা হয় দেশমাতা। আমরা দেশমাতার কোলে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠি। দেশের আলো-জল, মাটির স্পর্শে আমাদের তনু-মন পুষ্ট হয়ে ওঠে। আমাদের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস স্বদেশের কাছে ঋণী। মূলত দেশ কিংবা স্বদেশ বলতে আমরা সেই দেশকে বুঝি, যে দেশে আমরা জন্মেছি, যার বুকে কিংবা আলো-বাতাসে আমরা লালিত-পালিত ও বর্ধিত হয়েছি এবং বেঁচে আছি, যে মাটির ফল-ফসল, খাদ্য-পানি আমাদের দেহের পুষ্টি যোগাচ্ছে। কাজেই এ দেশ বা মাতৃভূমির জন্যে মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা সহজাত ও স্বভাবজাত। স্বদেশপ্রেম জন্মভূমির জন্যে মানুষের এক ধরণের অনুরাগপূর্ণ ভাবাবেগ। এক কথায় স্বদেশপ্রেম বলতে বোঝায় নিজের জন্মভূমিকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে ভালোবাসা। জন্মসূত্রে মাতৃভূমির সঙ্গে গড়ে ওঠে মানুষের নাড়ির যোগ। স্বদেশের জন্য ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মনেই জন্ম নেয় গভীর প্রীতি ও ভালোবাসা। যে ভালোবাসা অন্তর থেকে উৎসারিত। বড় হয়ে মানুষ অন্য কোথাও চলে যেতে বাধ্য হলেও জন্মভূমির মায়া কখনও ভুলতে পারে না। জন্মভূমির প্রতি, শৈশবের লীলাভূমির প্রতি মানুষের এ সীমাহীন আকর্ষণ ও অকৃত্রিম ভালোবাসাকেই বলে স্বদেশপ্রেম। স্বদেশের মাটি, আলো বাতাস, আবহাওয়া, আকাশ, ঋতু বৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষের মনকে সদা উৎফুল্ল করে ও আচ্ছন্ন রাখে। জন্মভূমির শ্যামলমাটি, সবুজ বনানী ও অন্ন জলের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ অপরিসীম ও চিরন্তন। আসলেই দেশপ্রেম থাকা চাই বৈদেশিক আগ্রাসনকে প্রতিহত করার জন্যে। কোনো উপনিবেশিক শক্তি যেন গিলে খেতে না পারে দেশের মানুষের অধিকার। তা রক্ষা করতে দেশপ্রেমে ব্রত হওয়া জরুরী। কেননা ইতিহাস বার বার এটাই প্রমাণ করেছে যে, দেশপ্রেমিক জাতি শত্রুর কাছে কখনও পরাজিত হয় না। সে জাতির অন্তরে জ্বলতে থাকে দেশপ্রেমের আগুন অনির্বাণ শিখার ন্যায়। আবার শুধু সংগ্রামী রূপ ধারণ করেই আবির্ভূত হয় না দেশপ্রেম। তার জন্য সৎ পথে থেকে সাধনা করা প্রয়োজন। সত্যিকার দেশপ্রেম হচ্ছে দেশকে গড়ে তোলার সাধনা করা। দেশের সচেতন নাগরিকদের কারও অজানা নয় যে, ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন।’ তাই তো অর্জিত এই স্বাধীনতা যেন কোনো কারণে খর্বিত না হয় সে বিষয়ে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে। দেশকে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলাটাই দেশবাসীর লক্ষ্য হওয়া উচিত। রাজনৈতিক স্বাধীনতার সাথে সাথে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার স্বপ্নকে সফল করে তোলাও দেশপ্রেমিকের পবিত্র দায়িত্ব। তাই অর্থনৈতিক দৈন্যদশা থেকে মুক্তির জন্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে হবে। সম্ভব হলে উদ্যোক্তা হয়ে বেকারত্ব দূরীকরণে এগিয়ে আসতে হবে ও যেন অর্থনীতির চাকা সচল হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। আর তাতে যুবসমাজকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ ছাড়াও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ও স্বদেশকে ভালোবেসে যুগে যুগে অনেক বীর যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। আমাদের মুক্তিও তেমনি দেশপ্রেমের এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত। বঙ্গবন্ধুর ডাকে জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে এক প্রাণ হয়ে দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মূলত দেশপ্রেম এমন একটি গুণ যা একজন মানুষকে তার স্বার্থ, স্বাচ্ছন্দ্য, আনন্দ এমনকি দেশের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য তার জীবন উৎসর্গ করতে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করে। স্বদেশপ্রেমের অনন্ত স্পৃহা মানুষকে দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ, উদ্যমী ও উজ্জীবিত করে তোলে। তা ছাড়া স্বদেশ মানুষকে স্বার্থপরতা, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীগত সংকীর্ণতা ও রাজনৈতিক মতাদর্শ ভেদাভেদের উর্ধ্বে তুলে এক স্বপ্নীল ও সমৃদ্ধ দেশ গঠনে সক্ষম করে তোলে। একজন দেশ প্রেমিকের প্রথম এবং প্রধান কর্তব্যই হলো তার দেশের সকল উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আত্মনিয়োগ করা। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য যেমন প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিক অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় সজাগ থাকতে হবে তেমনি দেশের শিক্ষা, শিল্প, কৃষি, বাণিজ্য ইত্যাদি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কাজ করা ও ত্যাগ স্বীকার করা সত্যিকার দেশপ্রেমিকের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। এককথায় স্বদেশপ্রেম দেশের মানুষের সেবার মধ্যে নিহিত। তাই স্বদেশপ্রেম প্রশ্নাতীতভাবে একটি মহৎ গুণ। অন্যদিকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও দেশপ্রেম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘স্বদেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ’। পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মেও একইভাবে স্বদেশপ্রেমকে মহিমান্বিত করা হয়েছে। স্বদেশপ্রেমের মহান আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আত্মোৎসর্গকারী ব্যক্তি অমর হয়ে থাকেন। অগণিত স্বাধীনতাকামী দেশপ্রেমিকের আত্মদানের ফলে বাংলাদেশ আজ স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র। জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী, লেলিন, মাও সে তুং, ইয়াসির আরাফাত, নেলসন ম্যান্ডেলা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ নেতা দেশকে ভালোবেসে দীর্ঘকাল কারাবরণ করেছেন। পৃথিবীতে তাঁদের ত্যাগ এবং এই ত্যাগের ফলে যে কল্যাণ বসে এসেছে, তাতে তাঁরা তাঁদের জীবনের মহান দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তাঁরা অত্যাচার-নিপীড়ন সহ্য করেছেন এবং দেশ ও জাতির মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দান করেছেন। কোনো ভয় প্রলোভন তাঁদেরকে কাবু করতে পারেনি। শত বিপর্যয়ের মুখেও তাঁরা দেশমাতৃকার মুক্তির ব্রত থেকে পিছু হটেনি। তাই তো বিশ্বের ইতিহাসে এসব মহান দেশপ্রেমিকের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এ ছাড়াও বিশ্বের ইতিহাসে দেশপ্রেমের ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত বর্তমান। যুগে যুগে অসংখ্য দেশপ্রেমিক স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন। ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মহাত্মা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নেতাজী সুভাষ বসু, তিতুমীর মাস্টারদা সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম প্রমুখের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে। বাঙালি জাতি স্বাধীনতা সংগ্রামসহ বিভিন্ন সংগ্রামের মাধ্যমে স্বদেশপ্রেমের যে পরিচয় দিয়েছে তা বিশ্ববাসীর স্মৃতিপটে চিরকাল উজ্জ্বল আলোক বর্তিকার ন্যায় ভাস্বর হয়ে থাকবে। নিখাদ দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে এদেশের জনগণ মায়ের মতো দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করেছে। ’৫২, ’৫৪, ’৬৬, ’৬৯ সালে রক্ত দিয়ে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ এ মাটিকে শত্রুমুক্ত করেছেন শুধু স্বদেশপ্রেমের উজ্জীবিত হয়েছিল বলে। দেশ সৃষ্টির এরূপ দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসা মানুষকে ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত করে পারস্পরিক সদাচরণ করতে শেখায়। দেশের মানুষের বিভিন্ন দলমত, সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, পরস্পরের প্রতি বিরোধ, সংঘর্ষ-সহিংসতা ও প্রতিহিংসার পরিবর্তে একে অন্যের সহযোগিতা, সহানুভূতি ও পৃষ্ঠপোষকতার ভাবধারা গড়ে তোলার জন্য পরমতসহিষ্ণুতার শিষ্টাচার গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন। দেশাত্মবোধ ও স্বদেশের প্রতি মমতা অনেক অন্যায় ও অপরাধপ্রবণতা থেকে মানুষকে বিরত রাখতে পারে। তাই দেশের প্রকৃত উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধন করতে হলে অবশ্যই দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। স্বদেশের প্রতি অনুগত থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসা সবার ঈমানি দায়িত্ব ও পবিত্র কর্তব্য। সর্বোপরি দেশের জনগণের যার যার ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা, নৈতিক বিধি-নিষেধের যথার্থ অনুশীলন দেশবাসীকে প্রকৃত ইমানদার মানুষে পরিণত করতে পারে এবং সমাজজীবনে বয়ে আনতে পারে সন্ত্রাসমুক্ত শান্তি-সুখের সুশীতল সমীরণ। আর এ রাষ্ট্রের আজ একবিংশ শতাব্দীর নতুন চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সকল জড়তা ও পশ্চাৎপদতাকে পেছনে ফেলে শৌর্য-বীর্য সমৃদ্ধিতে বিশ্ব সভায় মাথা উঁচু করে দাড়ানোর। এ জন্য দেশ গঠনের কাজে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলকে স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ও সমবেত করে ঐক্যবদ্ধ জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। তাহলেই বিস্ময়াবিষ্ট পৃথিবী মোহাবিষ্ট হয়ে বলবে, সাবাস বাংলাদেশ! আর বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে স্বদেশপ্রেমের এই মহান আদর্শে উজ্জীবিত হতে হবে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দেশপ্রেম যেন লালিত হয় সে চেষ্টা করতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক : বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি (বাপউস)।