পরিস্হিতি২৪ডটকম : বাঙ্গালীর দীর্ঘ স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পথ ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের চার দশকে রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম যে অসামান্য ভূমিকা রেখে গেছেন তিনি হলে কামাল লোহানী। মূলত তিনি কামাল লোহানী হিসেবে পরিচিত হলেও, তার পুরো নাম কিন্তু আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার খান সনতলা গ্রামে তাঁর জন্ম। বাবা আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী। মা রোকেয়া খান লোহানী। মাকে হারান মাত্র সাত বছর বয়সে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে কলকাতার শিশু বিদ্যাপীঠে তাঁর শিাজীবন শুরু হয়। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে চলে আসেন পাবনায়। পাবনা জিলা স্কুল থেকে ভাষা আন্দোলনের বছরে মাধ্যমিক পরীায় উত্তীর্ণ হলেন। এ সময় তিনি যুক্ত হন রাজনীতিতে। যোগ দেন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে। পাবনায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলন যোগ দেন। এরই মধ্যে পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পরই প্রাতিষ্ঠানিক শিার ইতি টানেন তিনি। যুক্ত হন রাজনীতি, সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতিচর্চায়। ১৯৫৩ সালে পাবনার তৎকালীন জিন্নাহ্ পার্কে (বর্তমান স্টেডিয়াম) মুসলিম লীগ কাউন্সিলে নুরুল আমিনের আগমনের প্রতিবাদ করায় প্রথম গ্রেপ্তার হন তিনি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের পে কাজ করায় আবারও গ্রেফতার হন তিনি। ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে পারিবারিক মতবিরোধ হওয়ায় ঢাকা চলে আসেন কামাল লোহানী। চাচাতো ভাই ফজলে লোহানীর সহযোগিতায় ওই বছরই দৈনিক মিল্লাত পত্রিকা দিয়ে কর্মজীবন শুরু হয় তাঁর। একই বছর তিনি ন্যাপে যোগ দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি হওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান তিনি। ১৯৫৮ সালে কামাল লোহানী যুক্ত হন নৃত্যশিল্পের সঙ্গে। নৃত্যগুরু জি এ মান্নান ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ প্রযোজনা করলে কামাল লোহানী তাতে অংশ নেন। পরে, পাকিস্তান সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশে যান তিনি। ১৯৬২ সালে স্বল্পকাল কারাবাসের পর কামাল লোহানী ‘ছায়ানট’ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হন। সাড়ে চার বছর এই দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন ‘ক্রান্তি’ নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন। ১৯৬৭ সালের ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর উদ্বোধন হয় ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে। আয়োজন করেন গণসঙ্গীতের অনুষ্ঠান ‘ধানের গুচ্ছে রক্ত জমেছে’। নাটক ‘আলোর পথযাত্রী’ পরিচালনা ও এতে অভিনয় করেন কামাল লোহানী। নৃত্যনাট্য ‘জ্বলছে আগুন ক্ষেতে ও খামারে’ বিবেকের ভূমিকায় নেচেছিলেন তিনি। ১৯৬০ সালে চাচাতো বোন সৈয়দা দীপ্তি রানীকে বিয়ে করেন কামাল লোহানী৷ ২০০৭ সালের ২৪ নভেম্বরে তার দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের অনুপ্রেরণাদাত্রী স্ত্রী দীপ্তি লোহানীর প্রয়াণে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন কামাল লোহানী। এ দম্পতির এক ছেলে ও দুই মেয়ে সাগর লোহানী, বন্যা লোহানী ও ঊর্মি লোহানী। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনে সরকারি নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তাঁর ছিল দৃঢ় ভূমিকা। শতবর্ষ পালনের আয়োজনে ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যে তিনি বজ্রসেনের ভূমিকায় অংশ নিয়ে প্রশংসিত হন৷ ১৯৬২ সালে স্বল্পকাল কারাবাসের পর কামাল লোহানী ‘ছায়ানট’র সাধারণ সম্পাদক হন৷ সাড়ে চার বছর এই দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন ‘ক্রান্তি’ নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি দায়িত্ব নেন ঢাকা বেতারের৷ দায়িত্ব নেয়ার পর বিধ্বস্ত বেতারকে পুনর্গঠনে মনযোগী হন৷ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন কামাল লোহানী। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর কলকাতা সফর উপলক্ষে দমদম বিমানবন্দরেও ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হলেও প্রশাসনে পরিবর্তন আসেনি বলে বেতারের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে ১৯৭৩ সালে সাংবাদিকতায় ফিরে এসে যোগ দেন ‘দৈনিক জনপদ’-এ৷ ১৯৭৪ সালে ‘বঙ্গবার্তা’, এরপর ‘দৈনিক বাংলার বাণী’ পত্রিকায় কাজ করেন। কিন্তু সরকার ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সংবাদপত্র এ্যানালমেন্ট অধ্যাদেশ জারি করে মাত্র চারটি পত্রিকা ছাড়া সব পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। নির্মল সেন ও কামাল লোহানী বাকশালে যোগদানে অস্বীকৃতি জানান। ফলে চাকরিহীন অবস্থায় ১৯৭৭ সালে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক বার্তা’র নির্বাহী সম্পাদক হন। ১৯৭৮ সালে তাঁকে সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধ হলে ‘দৈনিক বার্তা’ ছেড়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে (পিআইবি) যোগ দেন। প্রকাশনা পরিচালক ও ‘ডেপথনিউজ বাংলাদেশ’-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার কয়েক মাস পরেই তিনি সেখানকার সহযোগী সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৯১ সালে তিনি প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৬ মাসের মাথায় বিএনপি সরকারের সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় তিনি পিআইবিতে ফিরে আসেন। ২০০৮ সালে দুই বছরের জন্য আবার শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন৷ বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি ছিলেন চার বছর৷ তিনি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন৷ এর বাইরেও তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সদস্য। তিনি লেখালেখির সাথেও যুক্ত ছিলেন। কামাল লোহানীর লেখা বইগুলো মধ্যে রয়েছে ‘আমরা হারবো না’, ‘সত্যি কথা বলতে কী’, ‘যেন ভুলে না যাই’, ‘মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার’, ‘রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতার’, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার’, ‘এ দেশ আমার গর্ব’, ‘আমাদের সংস্কৃতি ও সংগ্রাম’, ‘লড়াইয়ের গান’, ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নৃত্যশিল্পের বিস্তার’, ‘দ্রোহে প্রেমে কবিতার মত’ এবং কবিতার বই ‘শব্দের বিদ্রোহ’৷ কামাল লোহানী ২০১৫ সালে সাংবাদিকতায় একুশে পদক লাভ করেন৷ এছাড়াও তিনি কলকাতা পৌরসভার দ্বিশতবর্ষ সম্মাননা, প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক সম্মাননা, রাজশাহী লেখক সংঘ সম্মাননা, ক্রান্তি স্মারক, ঋষিজ সম্মাননা ও স্মারক, জাহানারা ইমাম পদকসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ভর্তি হন। অবশেষে ২০ জুন ২০২০ চিরবিদায় নিলেন প্রগতিশীল চেতনার আলোকবর্তিকা হিসেবে পরিচিত এই বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। সকাল সোয়া ১০টার দিকে ঐ হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি…রাজেউন। এ সময় চিকিৎসকরা পরিবারের সম্মতিতে তাঁর লাইফ সাপোর্ট খুলে নিয়ে মৃত ঘোষণা করেন। কামাল লোহানীর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। তাঁর শবদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর শেখেরটেকের কোয়ান্টম ফাউন্ডেশনে। সেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী গোসল করানো হয়। এরপর নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তাঁর প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ শেষে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার খান সনতলা। সেখানে জানাজা শেষে বাদ এশা কামাল লোহানীকে তাঁর স্ত্রী দীপ্তি লোহানীর কবরে সমাহিত করা হয়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন প্রবীণ সাংবাদিক, প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার অসাধারণ যোদ্ধাকে হারাল। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর চেতনায় উজ্জীবিত হোক আগামীর প্রজন্ম। প্রগতির এই আলেকবর্তিকা কামাল লোহানীর প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও মরমী গবেষক।