কক্সবাজারের অসহায় লবণ চাষীদের বাঁচানোর স্বার্থে বিদেশী লবণ আমদানী বন্ধ করতঃ
দেশীয় উৎপাদিত লবণের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করনে পদক্ষেপ জরুরী : ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন
পরিস্হিতি২৪ডটকম : বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের জেলা তথা ভৌগোলিক নিন্মাঞ্চলের বাসিন্দা কক্সবাজারের সমুদ্র উপকুলীয় জনগণ। যাদের বছরের বর্ষা মৌসুমের ৬টি মাস কাটে পার্শ্ববর্তী প্রবাহমান নদীর ভয়ংকর উচ্চাশ ও গর্জনে। কিন্তু এই বাংলাদেশের সমুদ্র তীরবর্তী উপকুলীয় এলাকায় রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা। এদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান অর্থকরী উৎপাদিত ফসল বা শিল্পজাত দ্রব্য লবণ। যে লবণ হলো নিত্যদিনের খাদ্য তালিকার অন্যতম উপাদান। এই লবণ খাদ্যে তালিকার বাইরেও ড্রাইং, কাপড় তৈরি, চামড়া শিল্পে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। লবণ চাষের ভরা মৌসুম ফাল্গুন-চৈত্র মাস। মূলত বছরের ছয় মাস লবণ চাষ হয় এই এলাকায়, বাকি ছয় মাস একই জায়গা চাষ হয় লোনা পানির চিংড়ি। সারাদেশের লবণের চাহিদার ৮০ ভাগই কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে মেটানো হয়ে থাকে। কক্সবাজার সদরের ইসলামপুর ইউনিয়ন ছাড়াও কুতুবখালী, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, ইসলামাবাদ, চকরিয়ার খুটাখালীসহ বিভিন্ন এলাকা এবং পোকখালী, ভারোয়াখালী, চপুলদন্ডীসহ বেশ কিছু জায়গায় লবণ চাষ হয়। লবণ চাষ যেসব জায়গায় হয়, সেখানে অন্য কোনো ফসল হয় না। উইকিপিড়িয়া ও ইন্টারনেটে বিভিন্ন সূত্র থেকে লবণ শিল্পের ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, লবণ উৎপাদন আদিকাল থেকে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের একটি দেশীয় শিল্পোদ্যোগ ছিল। মুলঙ্গী নামে পরিচিত চট্টগ্রামের এক শ্রেণির লোক অতীতকাল থেকে সমুদ্রের পানি সিদ্ধ করে লবণ উৎপাদন করত। তাদের লবণ উৎপাদন ত্রেকে ‘তোফল’ বলা হতো। মোঘল আমলে ‘নিমক জায়গীর মহাল ও নিমক এয়জ মহাল’ নামক দুটি সরকারি বিভাগ এই শিল্প নিয়ন্ত্রণ করতো। নিজামপুর, জুলদিয়া ও বাহারছরা এই তিনটি চাকলার অধীনে মোট ৩৯টি লবণ সংগ্রহ ত্রে ছিল। ষোড়শ শতকে লবণ উৎপাদনকারীদের সরকারি খাতে মাশুল দিতে হতো। মোঘল আমল পর্যন্ত লবণ শিল্পে সরকারের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছিল জমিদার শ্রেণীর হাতে। তারা লবণ চাষীদের দিয়ে লবণ তৈরি করার জন্য স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দাদন প্রদান করত। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫ সালের মধ্যে অনেক ইংরেজ প্রত্যভাবে ও বেনিয়াদের মাধ্যমে পরোভাবে লবণ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশদের উদ্যোগে ১৭৬৫ সালে বণিক সমিতি গঠিত হয় এবং এতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা লাভবান হয়। পরবর্তীকালে ওয়ারেন হেস্টিংস লবণ শিল্পের ওপর সরকারের একচেটিয়া আধিপত্য প্রয়োগ করে লবণ আবাদের জন্য সর্বোচ্চ দরদাতাকে লবণ উৎপাদনের জমি পাঁচ বছরের জন্য লিজ দিতে শুরু করেন। ১৭৭৭ সালে এ পদ্ধতি বাতিল হয়ে বার্ষিক চুক্তি সম্পাদিত হতে থাকে। নতুন পদ্ধতি ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। কোম্পানি এরপর এজেন্সির মাধ্যমে সরাসরি লবণ উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় জড়িত হয় এবং যৌথ নিলামের আয়োজন করে বাজারজাতকরণেও সম্পৃক্ত হয়। ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কোম্পানির আধিপত্য চলতে থাকে। এই ধারাবাহিকতায় কোম্পানি কর্তৃক আরোপিত কর প্রশাসন, বিদেশ থেকে লবণ আমদানি এবং ভারতে লবণ উৎপাদন নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে দেশীয় লবণ শিল্পকে ধ্বংস করা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনির শাসনের প্রথম দিকে চট্টগ্রামে ৭৯-৯৯ হাজার মণ লবণ উৎপাদিত হতো। তখন কোম্পানির কর্মচারীরা চট্টগ্রামে উৎপাদিত লবণের ব্যবসা করত। পরবর্তীকালে লিভারপুর থেকে লবণ আমদানির কারণে প্রকৃতিজাত এই শিল্পটি ধ্বংস হয়ে যায় ব্রিটিশ সরকার সামুদ্রিক লবণ উৎপাদন করা বেআইনি ও দন্ডযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করে এবং স্বদেশী লবণের উপর অতিমাত্রায় কর আরোপ করায় এই শিল্প বন্ধ হয়ে যায়। চট্টগ্রামের বহু মুলঙ্গী জীবিকার তাগিদে লুকিয়ে লবন চাষ করতে গিয়ে ধরা পড়ে শাস্তিও ভোগ করত। এভাবে নির্যাতন চালিয়ে চট্টগ্রামের প্রাচীন লবণ শিল্পকে ধ্বংস করা হয়েছিল। বিশ শতকের ত্রিশের দশকে মহাত্মা গান্ধীর লবণ আন্দোলনের প্রভাবে লবণ উৎপাদন আবার শুরু হলেও নতুন লবণ শিল্প প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশদের প্রবল বিরোধিতা ছিল। ১৯৪৭-এর পর থেকে এই লবণ শিল্পটি পুনরুজ্জীবিত হলেও এখানকার উৎপাদিত লবণের উপর অধিক আবগারী শুল্ক ধার্য করায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানিকৃত খনিজ লবণের সাথে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় কক্সবাজার এলাকায় উৎপাদিত সামুদ্রিক লবণ পিছিয়ে পড়ে। কিন্তু বর্তমান দেশে উৎপাদিত লবণের গুণগত মান বেড়েছে। লবণ উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এমনকি লবণ রপ্তানির মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আর এক্ষেত্রে বিসিকের বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে। কিন্তু চাষীদের ন্যায্যমূল্য না দিতে পারায় এই খাত দিন দিন মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। চাষীদের সুযোগ বৃদ্ধিসহ লবণখাতের প্রসারের লক্ষ্য সামনে রেখে লবণ নীতিমালা হয়েছে ২০১১ সালে। এই নীতিমালার অনেক ধারা লঙ্ঘন করে এক শ্রেণীর মুনাফালোভী ব্যবসায়ী এই শিল্পকে ধ্বংসের চক্রান্ত করছে এক শ্রেণীর লোক। কিন্তু অদৃশ্য কারণে বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও এই লবণখাত নিয়ে সরকার কিংবা বেসরকারি পর্যায় থেকে বিশেষ কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সরকার এ শিল্পকে কৃষিপণ্য হিসেবে না দেখে শিল্পপণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে চাষীরা কৃষি পর্যায়ে দেওয়া ভর্তুকি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমনকি ১৯৯১ সালের প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিঃস্ব লবণ চাষীদের ঋণের সুদটুকুও মওকুফ হয়নি। বর্তমানে লবণ চাষকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়ে চাষী হিসেবে সব ধরণের কৃষি ভর্তুকি দেওয়ার দাবী উঠেছে। সাধারণত লবণ চাষীরা প্রতিবছর নানা ধরণের দুর্যোগের মুখোমুখি হন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগের মাত্রা গত কয়েক বছরে অনেক বেড়েছে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার (বিসিক) তথ্যমতে, কক্সবাজার জেলায় ৬৩ হাজার ৫৩২ একর লবণের মাঠ রয়েছে। আর লবণ চাষি রয়েছেন ৪৩ হাজার ৫০০ জন। উৎপাদিত লবণ পরিশোধন ও বাজারজাত করণের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে অন্তত ৩৬০টি লবণ মিল-কারখানা। এসব মিলের মধ্যে শুধু কক্সবাজার সদরের বিসিক শিল্প নগরী ইসলামপুর কেন্দ্রিক ৪০টি মিলসহ জেলায় ছোট বড় মিলে অন্তত ৫০টি মিল গড়ে উঠেছে। এ পেশায় সম্পৃক্ত রয়েছে অন্তত অর্ধলক্ষাধিক চাষী ও তাদের পরিবার। কিন্তু উৎপাদিত লবণ ও লবণের মিল-কারখানাগুলো দেশের ৬টি রাঘব বোয়াল মিল মালিকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না চাষীর শ্রমের। এ কারণে চাষীরা লবণ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। চাষীরা আশায় বুক বেঁধেছিল উৎপাদিত লবণ বিক্রি করে খরচ জোগাবে। কিন্তু লবণ বিক্রি করতে না পেরে এখন চরম হতাশায় ভুগছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় চাষীরা লবণ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। হারিয়ে যাবে দেশীয় লবণ শিল্প। এই এলাকা সমূহে লবণ চাষের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের জন্য জমির প্রাপ্যতা একটি বড় সমস্যা। উচ্চমূল্যে জমি বর্গা নিয়ে তারা লবণ চাষ করেন। এজন্য প্রকৃত ভূমিহীন লবণ চাষীদের কাছে লবণের খাস জমি দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত দিতে হবে। একইসঙ্গে ভূমি বন্দোবস্ত পাওয়া ভূমিহীন চাষীদের ভূমিদস্যুদের হাত থেকে বাঁচাতে মুনসেফ নিয়োগ করতে হবে। এছাড়াও লবণ মাঠ নিয়ে হানাহানি, খুনাখুনি, জবরদখলজনিত সমস্যার তাৎণিক সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে এবং লবণ চাষীদের নামে আগে গৃহীত ঋণের সুদ মওকুফ করে দিয়ে চাষীদেরকে চাষের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। একইসঙ্গে স্থানীয়ভাবে লবণ জমির খাজনা কৃষিজমি সমান করে দিতে হবে। তাছাড়াও লবণ চাষীদের প্রতিবছর প্রতি একরে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করে এই ঐতিহ্য লবণ চাষকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আর না হলে যুগ যুগ ধরে অবহেলায় পড়ে থাকবে লবণ খাত। এই লবণ উৎপাদনে দেশের লবণের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাহিরেও রপ্তানী করা সম্ভব। যদি এই শিল্পের বিকাশে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল উদ্যোগ গ্রহণ করে। তাছাড়াও লবণ চাষীদের জন্য গৃহীত নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে হবে যথাযথ। কেননা এই লবণ শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করে দেশীয় শিল্পকে ধ্বংসের চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে বিদেশ থেকে লবণ আমদানীর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে একটি মহল। তাই এই চক্রান্ত নস্যাৎ করে সরকার অনুমোদিত নীতিমালা বাস্তবায়ন ছাড়াও লবণখাত বাঁচাতে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই লবণ খাতকে বাঁচাতে হবে। আর যে কোনো অজুহাতে শিল্প প্রতিষ্ঠান বা যে কোনো প্রতিষ্ঠান কর্তৃক লবণ আমদানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। তাছাড়াও চোরাই পথে আনা লবণ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। লবণের মূল্য মাঠ পর্যায়ে নির্ধারণ করতে হবে। প্রতিবেশী দেশগুলোর মতো উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে এবং লবণ বোর্ড গঠন করতে হবে ও লবণ বোর্ডের প্রধান কার্যালয় থাকতে হবে কক্সবাজারে। লবণ চাষকে শিল্প থেকে বাদ দিয়ে একে কৃষিতে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। বর্তমানে লবন চাষীরা যে লবণ উৎপাদন করছে যা মণপ্রতি মূল্য ২০০ টাকারও কম বা প্রতি কেজি ৫ টাকার নিচে। কিন্তু লবণ উৎপাদনে খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদিত লবন বিক্রির পরও কানিপ্রতি লোকসান ২৫ হাজার টাকা এবং প্রতি মৌসুমে লবণ চাষে যুক্ত শ্রমিকপ্রতি ৭৫ হাজার টাকা করে ক্ষতিগ্রস্ত। তাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, পলিথিন পদ্ধতিতে উৎপাদিত লবণের মূল্য প্রতি বস্তা (২মণ) ৪৫০ থেকে ৪৭৫ টাকা, মাঠে ধৌত লবণ প্রতি বস্তা ৪২০ থেকে ৪৬০ টাকা এবং কালো লবণ প্রতিবস্তা ৩২০ থেকে ৩৭০ টাকা নির্ধারণ করে দেশীয় উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। আর সাদা লবণ উৎপাদনে আগ্রহ বাড়াতে চাষীদের জন্য স্থানীয়ভাবে ন্যায্যমূল্যে পলিথিনও সরবরাহ করতে হবে চাষীদের মধ্যে। তাহলেই দেশীয় এই পণ্যের বিকাশ ঘটবে। বাঁচবে লাখ লাখ পরিবার।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট এবং কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি।