পরিস্হিতি২৪ডটকম : আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি ৬৪ জেলায় একযোগে অবৈধ নদী দখলদারদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। এই তালিকায় থাকবে দূষণকারীরাও। জনসাধারণ যাতে দেখতে পারেন সে জন্য এই তালিকা টাঙ্গিয়ে দেয়া হবে উম্মুক্ত স্থানে। অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে এই সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান বলেছেন, কমিশন থেকে সব জেলা প্রশাসককে এ বিষয়ে যথাযথ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে নদ-নদীকে অবৈধ দখলমুক্ত করতে নির্দেশ দেয়ার পর প্রশাসন থেকে সারাদেশেই বড় ধরনের উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে। তবে প্রভাবশালী মহলের দখলে থাকা স্থাপনা উচ্ছেদে বাধা পাচ্ছে প্রশাসন। মামলা করে স্থাপনা উচ্ছেদ ঠেকিয়ে রাখছে অনেকে। এসব মামলা মোকাবিলায় এই প্রথমবারের মতো কমিশন নিজস্ব আইনজীবী নিয়োগ করেছে।
প্রসঙ্গত, নদীর অবৈধ দখল, পানি ও পরিবেশ দূষণ, শিল্প কারখানা কর্তৃক সৃষ্ট নদী দূষণ, অবৈধ কাঠামো নির্মাণসহ নানাবিধ অনিয়ম রোধ, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পুনরুদ্ধারের জন্য যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও নৌ-পরিবহন যোগ্য হিসাবে গড়ে তোলাসহ আর্থ সামাজিক উন্নয়নে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে ১৯১৩ সালে ২২ জুলাই জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু উল্লেখিত কর্মে সরকারকে সুপারিশ প্রদানের ক্ষমতা দিয়ে গঠিত কমিশন কোন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীন কাজ করবে বা তাদের প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় কোনটা সেটি আইনে স্পষ্ট করা হয়নি।
মাঠ প্রশাসন যেহেতু মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অধীন তাই কমিশন তাদের অধীনে কাজ করার আগ্রহ জানিয়ে ২০১৮ সালের ৯ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি পাঠায়। চিঠির ওপর মতামত প্রদানের জন্য তা নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে এ মন্ত্রণালয় কমিশনকে তাদের অধীনে রাখার যৌক্তিতা তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি পাঠায়। এখন পর্যন্ত বিষয়টি সেভাবেই ঝুলে আছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে নিয়ে শিগগির একটি যৌথসভা করে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হবে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম জানান।
এদিকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান গতকাল মঙ্গলবার ইত্তেফাককে জানান, কমিশন নদী বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দর্শন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি অবৈধ দখলদারদের তালিকা জেলায় জেলায় প্রকাশ করা হবে। পাশাপাশি উচ্ছেদ অভিযান চলবে। তার মতে, নদীর জমি নির্ধারণ করা বড় সমস্যা। দখলদাররা সীমানা পর্যন্ত মুছে দিয়েছে। তাছাড়া মাঠ প্রশাসনে উচ্ছেদ অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল নেই। চর পর্যন্ত দখল করে শিল্প কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। মামলা করে তারা অবৈধ দখল টিকিয়ে রাখছে। তবে কমিশন এখন তত্পর রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৪০৫ নদ-নদীর মধ্যে ৩৭টি সবচেয়ে বেশি দখল-দূষণের শিকার। যেসব নদ-নদী ইতোমধ্যে মৃত বা বিলুপ্ত, সেগুলো এই হিসাবের বাইরে। দূষণযুক্ত নদ-নদীর মধ্যে রয়েছে, রাজশাহী ও পাবনা অঞ্চলের বড়াল নদী; কুমিল্লা অঞ্চলের ডাকাতিয়া; চট্টগ্রাম অঞ্চলের কর্ণফুলী, হালদা; নেত্রকোনার মগড়া; খুলনার ময়ূর; হবিগঞ্জের খোয়াই ও সোনাই; সিলেট অঞ্চলের সুরমা, পিয়াইন, বিবিয়ানা, বাসিয়া; চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ অঞ্চলের নবগঙ্গা; টাঙ্গাইলের লৌহজং, লাঙ্গুলিয়া; ঢাকা অঞ্চলের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগ, ধলেশ্বরী, বংশী; কক্সবাজারের বাঁকখালী; ময়মনসিংহ অঞ্চলের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র; রংপুরের ঘাঘট, ইছামতী; দিনাজপুরের পুনর্ভবা; বগুড়ার করতোয়া; নওগাঁ-জয়পুরহাটের ছোট যমুনা; নাটোরের নারোদ; কুড়িগ্রামের সোনাভরি; বরিশাল অঞ্চলের সন্ধ্যা; ফরিদপুরের কুমার; সাতক্ষীরার আদি যমুনা; যশোরের কপোতাক্ষ ও ভৈরব; নরসিংদী অঞ্চলের হাড়িধোয়া; গাজীপুরের চিলাই।
৩৭ নদ-নদীতে তিন ধরনের দখল রয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে স্থায়ী আবাসন বা বাণিজ্যকেন্দ্র ছাড়াও সরকারি অপরিকল্পিত স্থাপনার মাধ্যমেও নদ-নদী দখলের শিকার হচ্ছে। অপরিকল্পিত স্থাপনা বলতে সাধারণত পরিকল্পনাহীন ও অবৈজ্ঞানিকভাবে নির্মিত আড়াআড়ি সড়ক, বাঁধ ও স্লুইসগেটকে বোঝানো হয়ে থাকে। এমন দখলের শিকার বৃহত্তর রাজশাহী ও পাবনা অঞ্চলের বড়াল নদী। আশির দশকে এই নদীর সঙ্গে গঙ্গার সংযোগস্থলসহ ভাটিতে তিনটি স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীকালে পাবনার কাবিখা ও কাবিটার অর্থে নির্মিত হয় আড়াআড়ি সড়ক। এর ফলে নদীটি বদ্ধ হয়ে পড়ে এবং নাটোরের বনগ্রাম এলাকায় একটি ধারা দখলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
সর্বশেষ করতোয়া নদী নিয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলনের ফলে সমপ্রতি একনেকে ওই নদীসহ নাগর ও বাঙালি নদী পুনরুদ্ধারে একটি প্রকল্প পাস হয়েছে। কিন্তু এতে স্লুইসগেট উচ্ছেদ না করে নতুন করে স্লুইসগেট নির্মাণের কথা বলা হয়েছে।
গবেষকদের মতে, নগর সংলগ্ন নদ-নদীর দূষণ ও দখল নিয়ে বেশি আলোচনা হয়। কিন্তু দখল-দূষণের থাবা প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিস্তৃত হয়েছে। দখল উচ্ছেদ বা দূষণবিরোধী অভিযানও পরিচালিত হয় মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীকে কেন্দ্র করে।
বিশিষ্ট নদী গবেষক শেখ রোকনের মতে, ৯০-এর দশক থেকে নদ-নদীতে দখল ও দূষণ বেড়েছে। একই সময়ে পরিবেশ ও নদী সংক্রান্ত আইন, বিধিমালা প্রণীত ও নতুন নতুন সংস্থা গঠন হলেও দখল বা দূষণ হ্রাসে দৃশ্যত কোনো প্রভাব পড়েনি। তার মতে, দখল ও দূষণ পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিহির চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, প্রায় প্রতি বছরই নদীতে দখল উচ্ছেদ অভিযান চলে। তার মতে, এসব অভিযান অনেকটা ‘লোক দেখানো’। উচ্ছেদের পর আবার বেদখল হয় নদী।
সুত্র : দৈনিক ইত্তেফাক