পরিস্হিতি২৪ডটকম : চীনা দার্শনিক কনফুশিয়াসের একটি মহামূল্যবান উক্তি হল, যে ব্যক্তি অন্যের কল্যাণের ইচ্ছা পোষণ করে সে প্রকৃতপে নিজের কল্যাণই নিশ্চিত করে। সামাজিক সংগঠনে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে কাজ করার প্রেরণা পাওয়া যায় এবং মানুষের মাঝে ইতিবাচক গুণাবলী তৈরি হয়। মানুষের মধ্যে তৈরি হয় নেতৃত্ব-গুণ। দায়িত্বশীলতা বাড়ে, সামাজিক দায়বদ্ধতা বাড়ে। কেননা মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক জীব হিসেবেই সে বেড়ে ওঠে, বসবাস করে। প্রাণিজগতের আরো কিছু প্রাণির মধ্যেও সমাজবদ্ধ হয়ে জীবনযাপনের প্রবণতা দেখা যায়, তবে মানুষের বুদ্ধির মাত্রা তাদের চেয়ে বেশি। মানুষ কেবল সামাজিক প্রাণিই নয়, বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণিও বটে। তাই সে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাসের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার সংগঠন গড়ে তোলে, যার মধ্যে সামাজিক সংগঠন অন্যতম। সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট সমাজকে কেন্দ্র করেই সামাজিক সংগঠনগুলো গড়ে ওঠে। তাই কোনো সমাজের কিছু লোক যখন কিছু নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বা সমাজের কিছু সমস্যা সমাধানে একত্র হয় এবং কিছু নীতিমালা অনুসরণ করে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায় তখন তাকে সামাজিক সংগঠন বলা যায়। সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠায় সমাজের যুবক শ্রেণিকে অগ্রণী ভূমিকায় দেখা যায়। সামাজিক সংগঠন করার প্রধান কারণ সামাজিক দায়বদ্ধতা। জন্মের পর শিশুর মানসিক বিকাশে সমাজের ভূমিকা অনন্য। সমাজের কোনো এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই তার প্রথম পাঠ শুরু হয়। তরুণ বয়সে সমাজের সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে চলাফেরায় তার সামাজিকীকরণ সম্পন্ন হয়, নেতৃত্বের গুণাবলি গড়ে ওঠে। এভাবে সামাজিক মূল্যবোধ নিয়ে ধীরে ধীরে সে উচ্চশিক্ষার দিকে এগিয়ে যায় এবং সামাজিক কাজ করার দায়বদ্ধতা অনুভব করে। একসময় সে সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলে। সামাজিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজ করে থাকে। যেমন: রাস্তাঘাট সংস্কার, বাঁধ বা সাঁকো নির্মাণ, বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা, রক্ত দান ইত্যাদি। এছাড়াও সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে শীতবস্ত্র ও ঈদসামগ্রী বিতরণ, চাঁদা তুলে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া, স্বল্পব্যয়ে মেডিকেলসেবার আয়োজন করা ইত্যাদির মাধ্যমেও সামাজিক সংগঠনগুলো সমাজসেবা করে থাকে। সামাজিকব্যাধি নির্মূলেও সামাজিক সংগঠনগুলো এগিয়ে আসে। ভৌগোলিক এবং আর্থ-সামাজিক কারণে সমাজে বিভিন্ন সামাজিকব্যাধি রয়েছে। মদ, জুয়া, মাদকদ্রব্য, যৌতুক, নারী নির্যাতন, দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ইত্যাদির বিরুদ্ধে সামাজিক সংগঠনগুলো অবস্থান নিতে পারে। মানববন্ধন, আলোচনা সভা, সেমিনার, লিফলেট বিতরণ ইত্যাদির মাধ্যমে সামাজিকব্যাধির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে পারে। পুরনো ঐতিহ্যবাহী সংগঠনগুলো প্রতিবন্ধকতার দেয়াল পার হতে কিছুতেই পারছে না। কোথাও আর্থিক অসচ্ছলতা, কোথাও উদ্যোগের অভাব আবার কোথাও রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থার বিস্তর সীমাবদ্ধতা। মূলত সংগঠনকে ছবি আঁকার সাথেও তুলনা করা সম্ভব। একটা রঙে কখনও ছবি হয় না। অজস্র রঙের সম্মিলিত প্রয়োগেই গড়ে উঠে একটি সুন্দর ছবি। শুধু সাদা কাগজের সাদা রঙ্গে তো ছবি হয় না। সেখানে নানা রঙের মিলনমেলা গুছিয়ে, সুন্দরভাবে প্রয়োগ করতে হয়। দল বলতেও আসলে এমন কিছুই বোঝায়। যেখানে নানারঙ হয় এক একজন শিল্পী আর ছবিটা হয় একটি সংগঠন। রঙ ছাড়া যেমন ছবি হয় না। তেমনি শিল্পী ছাড়া সংগঠন হয় না। সবচেয়ে বড় বিষয় ছবি আঁকতে যেমন শিল্পীর প্রয়োজন হয়, মালা গাঁথার যেমন দক্ষ মালা গাঁথুনি থাকতে হয়, বাদ্যযন্ত্র বাজাতে যেমন বাদক প্রয়োজন হয়, তেমনি একটি সংগঠন পরিচালনার জন্য প্রয়োজন হয় এমনই কোন দক্ষ, উদ্যমী, উদ্যোগী, পরিশ্রমী পরিচালক বা নির্দেশকের। তখনই একটি সংগঠন পরিপূর্ণতা পেতে পারে। এক পরিবারের সদস্যরা যেমন একে অপরের সম্পর্কে ভাল করে জানে যে সে কী পছন্দ করে, কী অপছন্দ করে, কোন সময় কী করে, কী তার ভাল লাগে, কখন ঘুমায়, কখন খায়, কখন বাইরে যায়, তাদের বন্ধু কে ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছু। তেমনি একটি সংগঠনকেও একটি পরিবারের মত পরিচালনা করা উচিত। দলের কোন সদস্যের কী সমস্যা, কোন সদস্যের কী পরিস্থিতি, কোন সদস্য কী করছে, কোন সদস্য কী করবে, কোন সদস্য অসুস্থ, কোন সদস্য অভাবে ভুগছে, কোন সদস্য সময় দিতে পারছে না এই সব কিছু সংগঠনের প্রতি সদস্যের জানা উচিত। একজন সদস্য ভয়াবহ কোন রোগে আক্রান্ত। অথচ সে নিজে না জানালে সংগঠন সেই বিষয়ে জানবে না এটা কেমন কথা? দলের সকল সদস্যদের উচিত একে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা। এমন একটা নির্দিষ্ট দায়িত্ব সংগঠনের কোন সদস্যকে দিয়ে দেয়া উচিত যে সংগঠনে কে আসছে বা কে আসছে না সেই সব খোঁজ রাখা। না আসলে কেন আসছে না, কী হল, সব ঠিক আছে তো, অসুস্থ তো নয়, মারা তো যায়নি এমন খোঁজখবর নেয়া। রোজ না হলেও সপ্তাহে একবার। সপ্তাহে না হলেও মাসে একবার। হযরত আলী (র.) বলেছেন, মানুষের দুঃখ দেখে তুমি যদি তার বিপদে এগিয়ে না আস তবে মনে রেখো তুমিও একদিন বিপদে পড়বে তখন কেউ তোমার কান্না শুনবে না। মানুষে মানুষে বন্ধুত্বের বিকাশ ঘটানো যায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, আমরা বন্ধুর কাছ থেকে মমতা চাই, সমবেদনা চাই, সাহায্য চাই। সেজন্যই বন্ধুকে চাই। আমাদের মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) নবুয়ত পাওয়ার আগেই সমাজসেবার জন্য তরুণদের নিয়ে হিলফুল ফুজুল নামে সেবাসংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নবুয়ত পাওয়ার পরও তিনি সাহাবীদের নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করেছেন। হযরত শাহজালাল (রহ.) সিলেটে এসেছিলেন ৩৬০ জন আওলিয়া (সহযাত্রী) নিয়ে। মহামতি বুদ্ধের আশ্রমে থাকতেন সাধনার জন্য শতশত ভিক্ষু। আর আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘবদ্ধ হওয়ার সফলতার বিস্ময়কর উদাহরণ। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাধারণ মানুষের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ, সহযোগিতা ও সমর্থনে নয় মাসে বাংলাদেশের বিজয় অর্জনও সংঘবদ্ধতার কারণেই সম্ভব হয়েছে। সামাজিক সংগঠন মানুষকে সবার কাছে পরিচিত করে তুলে। সংগঠনে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে সবাই লাভবান হয়। যেমন আপনার যদি একটি আপেল থাকে আপনি যদি অন্য একজনকে দেন অন্যজনও যদি আপনাকে একটি আপেল দেয়, উভয়েরই একটি করে আপেল থাকলো। অন্যদিকে যদি আপনার একটি আইডিয়া থাকে আপনি যদি অন্যজনের সাথে শেয়ার করেন এবং অন্যজন যদি আপনার সাথে আর একটি আইডিয়া শেয়ার করে উভয়েরই দুটি করে আইডিয়া হয়ে গেল। সংগঠন মানুষের কল্পনাশক্তিকেও শাণিত করতে পারে। সংগঠন একদিকে জীবনের পরিধি বাড়ায় অন্যদিকে মানুষকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। মানুষের ইতিবাচকতাকে বাড়িয়ে আশাবাদী করে। মানুষকে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী করে কাজের প্রেরণা ও সাহস যোগায়। তাছাড়া সংগঠন আনন্দিত করতেও সহায়তা করে। পরিশেষে বলা যায়, একটি সামাজিক সংগঠনকে সফল করতে হলে নেতাদের নেতৃত্বগুণ, দতা, ধৈর্য, স্বেচ্ছাসেবী মানসিকতা, সহযোগিতা-পরায়ণ, দলগত সিদ্ধান্তের উপর শ্রদ্ধাশীল মনোভাব, সর্বোপরি নৈতিক গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে। সংগঠন হলো এক সুতোয় এক এক করে এক একটা ফুল দিয়ে গাঁথা মালার মতো। প্রতিটা সংগঠন যদি সুন্দর ও সুশৃঙ্খল একটা পথে চলতে থাকে আর নিজেদের ত্রুটি-দুর্বলতাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে চলতে পারে তবে সেই সব সংগঠনের সফলতা কেউ ঠেকাতে পারবে না। ত্রুটি আর দুর্বলতা নিয়েও সুন্দর, সাবলীল, মার্জিত একটা চলার পথ বেছে নেয়া আর সেই পথ যতটা কঠিন হোক না কেন এগিয়ে যাওয়া আর সংগঠনের প্রতি সদস্যের মাঝে পৌঁছে দেয়া সাম্যের বাণী। কেউ ছোট নয়, কেউ বড় নয়। সবাই এক কাতারের সদস্য আর সবাই সমমর্যাদার। আর এই সামাজিক সংগঠনগুলো আত্মার মেলবন্ধনের সৃষ্টির রূপরেখা হিসেবে তৈরি হোক, এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট এবং কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি।