বাংলাদেশ, , বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

লুইজালে : আঞ্চলিক সময়-সাপেক্ষে বহুরৈখিক চিত্রকল্প

  প্রকাশ : ২০২২-১০-০৪ ১৩:৩০:৫৪  

পরিস্থিতি২৪ডটকম : যদিও ‘লুইজাল’ শব্দটি একপ্রকার নদীতে মাছ ধরার জালের আঞ্চলিক নাম; তবুও ছোটো আবহে বিরাট বিস্তৃতির কবিতাগুলি পড়তে পড়তে, আমার মনে হলো কয়েকটি বিশেষ বিষয় ~ য্যামোন, ‘মাছ’ ও স্বাধীনতা / ‘নদী’ ও পথ / ‘লুইজাল’ ও স্বপ্ন। আসলে, আলোচনার শুরুতেই এই আন্তঃসম্পর্কগুলো বলাটা প্রয়োজন, অন্ততপক্ষে আলোচনার কিছুটা আভাষ দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। গতো একুশে মেলায়, বইটি হাতে তুলে দ্যায় অনুজ মাহমুদ। যদিও, পূর্বেই ওর কবিতা সম্পর্কে কিছুটা আভাষ পেয়েছিলাম আন্তর্জাল পত্রিকা ‘বাক’ এবং ফেসবুক মিডিয়া মারফৎ। প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার যে, মাহমুদ নোমান একটি পত্রিকা’ও সম্পাদনা করে নাম ‘দেয়াঙ’। অতএব সম্পাদকসুবাদে নোমানের এই বইটি নিয়ে যৎসামান্য আলোচনা হলেও, কবিতাগুলিকে স্রেফ পল্লীজীবনের বেড়ে ওঠা স্বপ্নগুলোর কেবলমাত্র একটি প্রকাশের একরৈখিক ট্যাগলাইনে’ই বেশিরভাগ ফেলেছেন। আমি তা করতে পারিনি, বলা যেতে পারে আমার এই পাঠ প্রতিক্রিয়া : বেশিরভাগটাই কবির চিন্তাকে আরো বিস্তৃতির মধ্য দিয়ে দেখে, তার একটা বোধযোগ্য প্রক্ষেপন।

প্রথমেই বলবো বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়ে ~ রাজদীপ পুরী এখানে যে স্বপ্নিল আবহ এঁকেছেন; যেখানে দ্বিমাত্রিক অবস্থানেও একটি ত্রিভুজ / যার ভিতরটি বিভিন্ন রঙের কোলাজ দিয়ে ভর্তি হবার পরও উপচে পড়েছে কিছুটা এবং ত্রিভুজটির কেন্দ্রপ্রায় অঞ্চলে স্পষ্টত একটি চোখ / ত্রিভুজটির একটি প্রতিফলন, যা তার আকারকে বিস্তৃত করতে সাহায্য করেছে / ত্রিভুজের ওপরে দুটি বিপরীত অভিমুখ; যার একদিকে দুটি বিপরীত দৃশ্যের মাছ এবং অপরদিকে বিপরীত একটি মাতৃতান্ত্রিক ধারক চরিত্র তাকিয়ে আছে উল্টোপিঠে : শান্ত ও গভীর, একটি স্বপ্নের ত্রিমাত্রিক সম্পর্কের আবহ।যা আমাদের ঘোর লাগায় বিচলিত করে না।যাকে লালন করাটাই কর্তব্য।এখানে সেরকমভাবে কোনো ক্যাওস সৃষ্টি নেই বরং দৃশ্যটি নিজেই একটি যুক্তিপূর্ণরূপেরঘটা স্থাপিত।

আর এই ঘোরলাগা থেকেই, ভূমিকা হিসেবে কবির শুরুর স্ব-কথন “কবি হব এই অভিপ্রায়ে কবিতা লিখিনি।না লিখে থাকতে পারিনি বলে যা লিখেছি তাই কবিতা বলে অনেকের কাছে স্বীকৃতি পেল।” বা “আমার ফেলে আসা শৈশব বা বর্তমানেও, ঘুমে চেতনে যেন সেই জাল বেয়ে যাই”।এখানে কবি চিত্রকল্প শুধু নয়, সমান্তরালভাবে প্রয়োগ করেছেন চট্টগ্রাম অঞ্চলে তাঁর বেড়ে ওঠার সময়ে শেখা কিছু আঞ্চলিক শব্দার্থ।ফলতঃ কেবলমাত্র প্রতীকবাদী (symbolist) ও প্রকাশবাদী (expressionist) অংশতেই নয়; বরং ঘোর লাগা কিছু তৃতীয় ধারার জাদুবাস্তবতা ~ যার সাথে লাতিন আমেরিকা বা আফ্রিকান মেটাপ্যারাকালচার শৈলীর সাথে কিছু মিল থাকলেও, তা শেকড় সাপেক্ষে স্বতন্ত্র।না আমি কোনো তুলনামূলক বিচারে যাবো না, কারণ আন্তর্জাতিক চরিত্র বিশেষ্য এককে ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র থাকার স্বাভাবিক প্রবণতা।

মোট সাড়ে-চার ফর্মার বই, মোট বাষট্টিটি নাতিদৈর্ঘ্যিক বা স্বল্পদৈর্ঘ্যের কবিতা সমন্বিত। শেকড় থেকে উঠে আসা এক নদীমাতৃক যাপন নিঃসৃত হলেও, প্রতিটি কবিতার মধ্যে কোনো একরৈখিক ন্যাকামি নেই; বরং দেখা ও না-দেখা’র বিয়োগফল থেকে উৎস এক অভ্যন্তরীণ গতিশক্তি’র প্রবাহ আমার এখনো পর্যন্ত ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী।অন্ততপক্ষে একাধিকবার পড়ার পরে একথা বলতে পারছি।যাইহোক, কয়েকটি কবিতা আমরা নমুনারূপে দেখা যাক :

প্রথম কবিতাটি; শিরোনাম ‘মকসুদে তুমি’ ~ “পাহাড়ে নিয়তের মোমবাতি জ্বলছে / ঝাড়ের ফাঁকে চোখ গলিয়ে দেখছি / চাঁদ নেমে এসেছে, / নাকের কাছাকাছি শুঁকছি এই-তো / কারো চোখের জলে, / টিমটিম আলোয় পুড়ে যাচ্ছে – / গলে যাচ্ছে একটু একটু / সিনার বোতাম খুলে / ফের তাকাতেই / দেখি চাঁদ নেই! / চাঁদ নিয়ে কেউ বাড়ি ফিরে গেছে” : খুব আপাতভাবে কবিতাটি পড়লে মনে হবে কোনো একটা সম্পর্কের ভাঙাগড়া।কিন্তু আদৌ কি তাই? চাঁদ যদি একটা স্বপ্নের প্রতিছয়া হয় এখানে, তবে সেতো নিরাকার ও বিমূর্ত।এ কারণেই তার গন্ধ পাওয়া যায় না / মোমের টিমটিমে আলোতে সে পুড়ে যায়, গলে যায় / আবার অদৃশ্য সে / আবার কারুর কারুর কাছে সম্ভাব্য দৃশ্য।সুতরাং এই ব্রহ্মাণ্ডের সেই নিরাকার প্রাণের নেপথ্যে থাকা চালনাশক্তির ফলে নতুন কোনো সৃষ্টি’র কথা এখানে বলতেই পারি।

পরবর্তী কবিতা; শিরোনাম ‘লুইজালে’ ~ “বিলের ধারের বটগাছটি আমার মা। / বাবা হয়তো লুইজাল নিয়ে / মাছ ধরতে গেছে / বোনটি প্যাঁকপ্যাঁক করছে / শেওলার হাঁড়িতে; / আমি ঝুলঝি বটগাছে – / পরগাছার ইঁয়ড়ে।” : এই কবিতাটিতে য্যামোন একাত্ম হবার প্রবণতা সাংঘাতিক। একটি ধারনা থেকে ধারক এবং ধারক থেকে বোধি’র উৎস। একথার পরিপ্রেক্ষিতে ~ আমরা বলতেই পারি বলয় থেকে বলয়ান্তরে এই মহাশূন্যে রয়েছে আমাদের অস্তিত্ব, সময় বিষয়টির সাপেক্ষে।কজনই বা ভাবতে পারি ~ নিজেকে এই অসীমতার অতিক্ষুদ্রাংশরূপে। এ ভাবনা নিত্য ও বিস্ময়কর।

বইটি থেকে আরেকটি এরকমই কবিতা দিয়ে এই পর্যায়টি শেষ করবো; শিরোনাম ‘বৈঠাবিহীন সাম্পান’ ~ “নদীর সিথানে মেঘহত্যার সন্ধ্যাতে / বৃষ্টির বান্ধবীরা কামুক হয়ে যায় / পণ্যবাহী জাহাজে সারেঙের বুকে / খুলে দেয় শাড়িটির ভাঁজ – // আমি ভেসে ছিলাম বৈঠাবিহীন সাম্পানে।” গোটা কবিতাটিতে আন্তঃসম্পর্কের অদৃশ্য গতিশক্তি জনিত ছোটোছোটো মোচড়গুলি খেয়াল করার মতো।য্যানো, একেকটি পর্যায় সম্পূর্ণ করে আরেকটি পর্যায় প্রবেশ।

এবার কিছু দুর্বলতা নিয়ে (যেগুলি নিজের মনে হয়েছে) সততার সাথে, অনুজ মাহমুদ নোমান ও পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইবো।প্রথমেই বলবো, বেশ কয়েকটি জায়গায় অহেতুক বানান ভুল; যেগুলি দেখলেই বোঝা যায় বানান ব্যাকরণ না মেনে লেখার নেপথ্যে পরিকল্পনা নেই।সুতরাং এই অকারণ ভুলগুলিকে প্রুফ দ্যাখার সময় সংশোধন করা উচিৎ ছিলো। পরবর্তী যে বিষয়টির কথা বলবো তা হলো ‘আমি / আমার’ জাতীয় শব্দগুলির সুনির্দিষ্ট ব্যবহার; যা অতিরিক্ত ও অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। কারন, এগুলি ছাড়াও ভাবটি সুনির্দিষ্ট থাকতো।প্রত্যয়ের প্রথামাফিক প্রয়োগ।’তে’ বা এ-কার / ও-কার প্রয়োগটির ক্ষেত্রে আরো কিছু চিন্তাশীলতা আশা ছিলো; যেহেতু বিষয়মাত্রা উঁচু স্তরের। আংশিক কয়েকটি উদ্দেশহীনতা যদি এই উচ্চস্তরের প্রবাহ / ফ্লো’কে প্রতিহত করে ~ বড়োই কষ্টকর।

কবিতা যদি একটি ভাবনা’র যথাযথ প্রকাশ অভিমুখী হয়; সেখানে দুটি ধারা খেয়াল করার মতো। একদিকের পর্যায়ে সময়ের সাপেক্ষে কোনো ঘটনা বা পর্যবেক্ষণের তাৎক্ষনিক প্রকাশ এবং পরবর্তী পর্যায়ে, এই প্রকাশ পরবর্তী প্রতিফলনকৃত অংশের অনুসন্ধান।প্রথম পর্যায়টিতে আটকে থাকেন বেশিরভাগ কবিই; কারন যেহেতু এই পর্যায়ের কবিতা চিরকালই সর্বজনগৃহীত অনুভূতি থেকে সৃষ্ট। ফলতঃ, সবার জন্য কবিতা ব্যপারটি অতিরিক্ত অনুভূতিকেন্দ্রিক হবার কারনে ‘কবিতা একটি শুধুমাত্র বিনোদন’ ~ এই মানসিকতা সাধনার পথ থেকে বিরত করে কবিকে।বইটির একেবারে শুরুতেই অগ্রজ কবি / সম্পাদক অনুপম মুখোপাধ্যায় লিখেছেন “পশ্চিমবঙ্গের কবিতায় ফর্মের বাড়াবাড়ি, বাংলাদেশের কবিতায় আবেগদীপ্ত বিষয়ের প্রতি ঝোঁক এবং উভয় ভূখণ্ডেই স্টাইলের প্রতি এক অচেতন উদাসীনতা।এর মধ্যে একজন কবিকে দেখছি, তিনি এই তিনটি দিকের কোনোটির প্রতিই আলাদা মনযোগ দিচ্ছেন না।লেখার সামগ্রিক উল্লাসে লিখছেন, লেখার সর্বগ্রাসী দুঃখে তাঁর লেখাগুলো হয়ে চলেছে।” কথাগুলো একদা অনুসন্ধানে রত একজন অগ্রজ এবং এগিয়ে থাকা কবির কাছে শুনলে, কিছুটা বিভ্রান্তি হয়েই যায়।কারন, সাধনার নেপথ্যে থাকা চিন্তাশক্তির অনুপ্রাস অস্বীকার্য নয় এবং পর্যবেক্ষণের অভিনবত্ব তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।সরল কথায় নকলনবিশ না হয়ে স্বতন্ত্রতা রাখার প্রবণতা।আর এতগুলো কথা একারণেই বললাম, কারণ মাহমুদ নোমান যে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের অংশ; তারা নতুনত্বের পন্থায় বিশ্বাসী বলেই জানি।আর এটাই তো স্বাভাবিক

পরিশেষে একথাই বলবো, কবির শুরুর স্বীকারোক্তি ~ কবিতা লিখবো বলে লিখিনি। আর এখান থেকেই তাঁর স্বতন্ত্র হবার প্রবণতা শুরু। আর ব্যক্তিগতভাবে চাইবো, এই প্রবণতা য্যানো তাকে চর্চা ও অনুশীলনে সর্বদা নিযুক্ত রাখে, সে য্যানো দ্রুত অনুভব করতে পারে সাধনার প্রবেশদ্বার। এই প্রস্তুতি চলার ফাঁকে, পাঠকের উচিৎ তাঁকে নজরে রাখা। আর ভবিষ্যতের জন্যই ‘লুইজালে’ অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিৎ, অন্ততপক্ষে একবারের জন্য হলেও।
লেখক : রাহুল গাঙ্গুলি-কলকাতা । ( মাহমুদ নোমানের টাইমলাইন থেকে লেখাটি সংগৃহীত । )



ফেইসবুকে আমরা