বাংলাদেশ, , বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

সারাবিশ্বের ন্যায় নিষ্ক্রিয় শৈশবের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ : ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন

  প্রকাশ : ২০২০-০১-১১ ১৮:২৫:৪৭  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : শিশু, শৈশব, শিক্ষা এগুলো উন্নত জাতি গঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের কাছে সবচেয়ে উপেক্ষিত বিষয়গুলোর একটি হচ্ছে শিশু শিক্ষা। বাস্তবে শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। প্রতিটি শিশু পরিবারের পরম আক্ঙ্খার ধন। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সব মা গর্ভকালীন সময়ে শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে সদা সতর্ক থাকার চেষ্টা করেন। পরিবারের সদস্যরাও শিশুর জন্ম সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিক করার প্রয়াসে মাকে কঠোর পরিশ্রম থেকে বিরত রাখেন। জন্মের পর থেকে কৈশোর বা বয়ঃসন্ধি কালের পূর্বের সময়টাকে শৈশব বলে। শৈশব কালের দুটি পর্ব রয়েছে। একটি হল প্রাক কর্মম পর্ব এবং অন্যটি হল কর্মক্ষম পর্ব। ডিভেলপমেন্টাল সাইকোলজি অনুসারে শৈশবকালকে হাঁটা শিক্ষার সময়, খেলার সময়, বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় এবং বয়ঃসন্ধিকাল সময়ে ভাগ করা হয়েছে। শৈশবকালের ধারণাটি ১৭শ থেকে ১৮শ শতাব্দিতে উদ্ভব হয় বিশেষত দার্শনিক জন লক John Locke এর শিক্ষা বিষয়ক মতবাদে। এর আগে শৈশবকালকে বড়দের অসম্পূর্ণ সংস্করণ হিসাবে দেখা হত। শৈশবকালের নির্দিষ্ট কোনো বয়স পরিসীমা নেই। সাধারণত জন্মের পর থেকে শৈশবকাল শুরু হয় এবং বয়ঃসন্ধিকালে শেষ হয়। বিশ্বের অনেক দেশে শৈশবকালের একটি বয়স সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে যা অতিক্রম করার পর তারা পূর্ণবয়স্ক হিসাবে বিবেচিত হয়।

এই বয়সসীমা বিভিন্ন দেশভেদে ১৫-২১ বছরের মধ্য কিন্তু অধিকাংশ দেশে তা ১৮ বছর। শৈশবের গোড়ার দিকে শিশুরা কথা বলতে এবং স্বাধীনভাবে হাঁটতে শুরু করে।| National Association for the Education of Young Children এর মতে শৈশবের প্রাথমিক পর্যায় ৮ বছর বয়স পর্যন্ত। এই পর্যায়ে শিশুরা দেখে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এবং অন্যদের সাথে যোগাযোগ করে বিভিন্ন জিনিস শিখে থাকে। বড়রা পরামর্শ এবং সাহায্য করে তাদের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। এর ফলে বড়দের এবং শিশুদের মধ্য মায়ার বন্ধন গড়ে ওঠে। মূলত এই পর্যায়ে শিশুরা সমাজ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে থাকে। সাত থেকে আট বছর বয়সে শৈশবের মধ্যবর্তী পর্যায় শুরু হয়ে বয়ঃসন্ধিকালের পূর্ব মুহূর্তে শেষ হয়। এই সময়ে শিশুরা বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করে ফলে তারা মানসিক এবং সামাজিকভাবে উন্নতি লাভ করে। এবং শিশুরা এই সময়ে নতুন নতুন বন্ধু তৈরি করে এবং নতুন নতুন দক্ষতা অর্জন করে। যার ফলে তারা আরও স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র হয়ে গড়ে ওঠে। বয়ঃসন্ধিকাল শৈশবকাল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু কিছু কিছু সমাজে বয়ঃসন্ধিকালকে শৈশবের অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হয় কেননা তাদের অনেকেই তখনও নাবালক থাকে। বয়ঃসন্ধিকালে শিশুদের শারিরিক, মানসিক এবং আচরণগত পরিবর্তন দেখা যায়। সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালের সমাপ্তি দেশভেদে এমনকি একটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও সংস্কৃতি ভেদে ভিন্ন হতে পারে। ঊদ্বিগ্নের বিষয়, বিশ্বে ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে চারজনেরই নেই পর্যাপ্ত শরীরচর্চার অভ্যাস; উদ্বেগজনক এই প্রকাশ পেয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সাম্প্রতিক এক গবেষণায়। আর এর ফলে শিশুর স্বাস্থ্য তো বটেই, মস্তিষ্কের বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে; ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সামাজিক দক্ষতা। গবেষণার এই তথ্য তুলে ধরে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধনী ও অনুন্নত দেশগুলোতে শিশুরা দৈনিক এক ঘণ্টাও শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকছে না। এই পরিস্থিতিকে গবেষকরা দেখছেন একটি ‘বৈশ্বিক সংকট’ হিসেবে। আর বাংলাদেশের শিশুরাও এই ঝুঁকির বাইরে নয়। সাইকিং, সাঁতার, ফুটবল খেলা, লাফানো, দড়ি লাফ, জিমনাস্টিকসের মত শারীরিক কসরৎÑযা হৃৎস্পন্দন বাড়ায়, ফুসফুসকে আরও বেশি সক্রিয় করে-এমন যে কোনো দৈহিক কর্মকাণ্ডকে ‘ব্যায়াম’ হিসেবে ধরে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছে। আর শিশুরা দিনে অন্তত এক ঘন্টা মাঝারি থেকে ভারী ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করছে কি না, তার উপর নজর রেখেছেন গবেষকরা। যে ১৪৬টি ডব্লিউএইচও এই সমীা চালিয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশেই শিশুদের নিষ্ক্রিয়তার মাত্রা সবচেয়ে কম। তারপরও এদেশের ৬৬ শতাংশ, অর্থাৎ প্রতি তিনজনে দুইজন শিশু শরীর চর্চার পেছনে দৈনিক এক ঘণ্টাও সময় ব্যয় করে না। তাদের এই গবেষণা বলছে, চারটি বাদে সব দেশেই ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে বেশি সক্রিয়। ফিলিপিন্সে ৯৩ শতাংশ ছেলেশিশু এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ৯৭ শতাংশ মেয়েশিশু শারীরিকভাবে যথেষ্ট সক্রিয় জীবনযাপন করছে না। যুক্তরাজ্য ৭৫ শতাংশ ছেলেশিশু আর ৮৫ শতাংশ মেয়েশিশুর শরীরচর্চার অভ্যাস নেই। প্রতিদিন এক ঘণ্টা শারীরিকভাবে সক্রিয় করার চেষ্টাকে অসম্ভব কোনো লক্ষ্য বলে মানতে নারাজ ডব্লিউএইচ’র কর্মকর্তা ডা. ফিওনা বুল। তার ভাষায়, সুস্বাস্থ্যের জন্য এই পদ্ধতি ‘প্রমাণিত’। শারীরিক পরিশ্রমে পুরুষের তুলনায় নারীরা অন্তত ২০ শতাংশ কম সক্রিয়-এরকম নয়টি দেশের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল ২০১৮ সালে ডব্লিউএইচও’র এক গবেষণা প্রতিবেদনে। সেই তালিকায় বাংলাদেশও ছিল। বাংলাদেশে পুরুষদের ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত শারীরিক শ্রমের হার যখন ২০ থেকে ২৯ দশমিক ৯ শতাংশ, নারীদের ক্ষেত্রে তা ৩০ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ শতাংশ। আর এর ফলে নারীদের মধ্যে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের মত অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। ডব্লিউএইচ’র ২০১৪ সালের আরেক প্রতিবদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর হার ৫৯ শতাংশ। এর মধ্যে হৃদরোগে মারা যায় সবচেয়ে বেশি ১৭ শতাংশ। আর ১০ শতাংশ মৃত্যু হয় ফুসফুসের অসুখ ও ক্যান্সারে। ডব্লিউএইচও’র ড. রেজিনা গুথল্ড বলেন, বয়ঃসন্ধিকালে সক্রিয় থাকাটা পরবর্তী জীবনেও সক্রিয় থাকতে সহায়তা করে। দৈহিকভাবে কর্মম থাকলে পরে হৃদরোগ, স্ট্রোক আর টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে। পাশাপাশি শৈশব-কৈশোরে মস্তিষ্কের বিকাশের জন্যও সক্রিয় থাকাটা জরুরি বলে মত দিচ্ছেন গবেষকরা। কিন্তু আমাদের সন্তানরা আরাম-আয়েশ, বিনোদন, খেলাধুলাকে বিসর্জন দিয়ে শুধু পড়ছে তো পড়ছেই। এই পড়ালেখা শিশুকে কতটা বিকশিত করছে, সমাজকে কতটুকু উপকৃত করছে, দেশকে কী দিচ্ছে- বিষয়গুলো নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে। শিশু মনোবিজ্ঞান বহির্ভূত শিক্ষা শিশুদের জোর করে শেখানোর পক্ষে যুক্তি হচ্ছে, এই বয়সে যদি লেখাপড়ার ওপর চাপ না দেয়া হয় তবে বড় হয়ে পড়ার অভ্যাস করাতে সমস্যা হবে। শিশুশিক্ষার জন্য বয়সের বিষয়টিকে গুরুত্বহীনভাবে দেখা হচ্ছে। প্রথম শ্রেণি থেকে পরীক্ষা দিতে দিতে শিশুর পরীক্ষা অভ্যাস গড়ে ওঠবে কিংবা পরীক্ষা ভীতি কমে যাবে, তা খোঁড়া যুক্তি। তাই এই পড়ালেখার পদ্ধতি ও পরীার যন্ত্রণায় হারিয়ে যেতে বসেছে শিশুর আনন্দময় শৈশব। শিশুর খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা, গল্প, কবিতা, ছড়ার বই পড়া, ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের মাধ্যমে জ্ঞানার্জন, নৈতিক শিক্ষাসহ ব্যবহারিক শিক্ষা সব আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর পড়া, স্কুল, কোচিং যেন শিশুর জীবন, এটাই একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর পরীক্ষার ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষিত, নিরর সবার মাঝে ঐক্যবদ্ধ সুর। শিশুকে ভালোভাবে পাস করাতেই হবে। অপরদিকে শিশুর শৈশব হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত। শিশুর শৈশব বিপন্ন না করে আদর্শ মূল্যায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে সৃষ্টি করা হোক যথার্থ জ্ঞানসমৃদ্ধ শিার পরিবেশ। হাসি, খুশি, আনন্দময় হবে শিশুর জীবন। বয়স, রুচি সামর্থ্য অনুযায়ী দেয়া হোক শিশুর শিক্ষা। শিশুর ওপর চলমান শিক্ষাব্যবস্থার যন্ত্রণা বাল্যবিয়ের চেয়েও বিরূপ প্রভাব ফেলছে সমাজে। বাল্যবিয়ের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নির্দিষ্ট ছেলে, মেয়ে বা তার পরিবার। অথচ শিশুশিক্ষার এ যন্ত্রণায় শিশু হারাচ্ছে শৈশবের আনন্দ। শিশুকে জ্ঞাননির্ভর পড়াশোনা থেকে দূরে রাখার ফলে শিশু, পরিবারসহ সমগ্র জাতিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আগামী প্রজন্ম গড়ে উঠছে অনেকটা বিকলাঙ্গ জ্ঞান নিয়ে। শিশুর সুন্দর জীবন ও ভবিষ্যতের জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের অবিলম্বে এগিয়ে আসতে হবে। শিশুর বিপন্ন শৈশবকে আনন্দময় করার ভাবনা ছড়িয়ে পড়ুক সবার মাঝে। আর আনন্দ হাসিখুশি পূর্ণ শৈশব গড়ে উঠুক সকলের সহযোগিতায়, সুস্থ বিনোদন চর্চার জন্য পরিবার তথা সমাজ থেকে নির্দেশিত হয়ে কোলাহলে ভরে উঠুক এবং বিকশিত হউক শৈশব। নইলে সারাবিশ্ব যেই নিস্ক্রিয় শৈশবের ঝুঁকিতে রয়েছে তার অনুরূপ ঝুঁকিতে বাংলাদেশও আছে। এই ঝুঁকি থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে না।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট এবং কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি।



ফেইসবুকে আমরা