বাংলাদেশ, , বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

শোহাদায়ে কারবালার প্রকৃত শিক্ষা হল অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা : ডাঃ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন

  প্রকাশ : ২০১৯-০৯-০৫ ১৩:১৯:০৮  

শোহাদায়ে কারবালার প্রকৃত শিক্ষা হল অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা : ডাঃ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন

পরিস্হিতি২৪ডটকম : ইসলামী বর্ষ পরিক্রমার প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখকে প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) আশুরা নামে অভিহিত করেছেন। বিশ্ব ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই দিনে সংঘটিত হয়েছে। সেগুলো যুগে যুগে মুসলমানদের অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই ঘটনাকে স্মরণ করে লিখেছিলেন, ফিরে এলো আজ সেই মুহররম মাহিনা/ত্যাগ চাই, মুরসিয়া ক্রন্দন চাহিনা। কারবালার যুদ্ধ আশুরাকে মহিয়ান করে দিয়েছে। ইরাকের ফোরাত নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত কারবালা মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ জনপদ।

হিজরি ৬১ সালের এই দিনে ফোরাত নদীর তীরে ঐতিহাসিক কারবালা প্রান্তরে যে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে, তা সমগ্র মুসলিম জাহানকে শোকে-বেদনায় স্তব্ধ করে দিয়েছিল। মহররম মাস এলেই কারবালার সেই বেদনাবিধুর স্মৃতি জেগে ওঠে, প্রত্যেক মুসলমানের হৃদয়ে রক্তরণ হয়। কারবালা প্রান্তরে নৃশংস ঘটনা যখন ঘটে, তখন মুসলিম জাহানে চরম অরাজকতা চলছিল। ইসলামের চার খলিফার স্বর্ণযুগ তখন অতীত। মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদ তখন রাজতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর। প্রিয় নবীর (সা.) দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এ অন্যায় মেনে নিতে পারেননি। ন্যায় ও সত্যের পতাকা সমুন্নত রাখার লক্ষ্য সুদৃঢ় শপথ নিতে তিনি ইয়াজিদের বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। সে যুদ্ধ ছিল অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার। ইয়াজিদ যুদ্ধের সব রীতিনীতি ভেঙে হত্যা উৎসবে মেতে ওঠে। কারবালা প্রান্তরে পরিবার-পরিজন ও সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নির্মমভাবে শহীদ হন রাসূল দৌহিত্র। তাঁর এই শাহাদাতের ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। অন্যায় অসত্য ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে পরিবার-পরিজন ও ভক্ত অনুসারিদের নিয়ে তিনি পরাক্রান্ত শাসক শক্তির হাজার হাজার দক্ষ ও প্রশিক্ষিত সেনাদের বিরুদ্ধে এক অসম লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হন। সত্যের পথে অসীম সাহসী বীর হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তাঁর সজন ও সহযোদ্ধারা মৃত্যু অবধারিত জেনেও আপোষহীন যুদ্ধ করে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। ইয়াজিদ বাহিনী ফোরাতের তীর অবরুদ্ধ করে ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর সহযোদ্ধাদের দিনের পর দিন এক বিন্দু পানিও পান করতে না দিয়ে তাঁদের নিদারুণ কষ্ট দিয়েছে। পিপাসায় কাতর হয়ে অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু ইসলামের মহান শিক্ষা ইমানের পথ থেকে তাঁরা মুহুর্তের জন্য বিচ্যুতি হননি। তাঁর এই আত্মত্যাগ, সত্যনিষ্টা ও ন্যায়বাদিতা যুগ যুগ ধরে মুসলিম উম্মার কাছে এক অনিশেষ অনুপ্রেরণা হয়ে আছে এবং আগামীতেও থাকবে। আশুরার এই দিনটি মূলত মুসলমানদের জন্য শোহাদায়ে কারবালার সেই দুঃসহ স্মৃতিই বহন করে আনে। সৃষ্টির আদিকাল থেকে যুগে যুগে বিভিন্ন নবী-রাসূলের নানা ঘটনাকে ধারণ করে আছে। আল্লাহ তাআলা হজরত মুহাম্মদ (সা:)-এর নূর মোবারক সৃষ্টির মাধ্যমে যেদিন সৃষ্টি জগতের সূচনা করেন সেদিন ছিল আশুরা। পৃথিবীতে যেদিন প্রথম বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছিল সেদিন ছিল আশুরা। মানব জাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ:)-এর দেহে প্রাণ সঞ্চারিত করেছিলেন সেদিন ছিল আশুরা, হজরত আদম (আ:)-এর তত্তবা যেদিন আল্লাহ কবুল করেছিলেন সেদিন ছিল আশুরা। হজরত নূহ (আ:) মহা প্লাবনের সময় ৪০ দিন ভাসমান থাকা অবস্থায় কিস্তি থেকে যুদী পাহাড়ের চূড়ায় সদলবলে যেদিন অবতরণ করেছিলেন সেদিন ছিল আশুরা, যেদিন হজরত ইবরাহীম (আ:) নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে আল্লাহর রহমতে মুক্ত হয়েছিলেন সেদিন ছিল আশুরা। আল্লাহ তায়ালা আগুনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন : হে আগুন, তুমি ইবরাহীমের জন্য শান্তিপ্রদ শীতল হয়ে যাও। হজরত মূসা (আ:) যেদিন বনী ইসরাইলের কয়েক হাজার মানুষকে ফেরাউনের কারগার থেকে মুক্ত করে লৌহিত সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন সেদিন ছিল আশুরা, হজরত আইয়ূব (আ:) ১৮ বছর কঠিন রোগে ভোগার পর সেদিন আল্লাহর রহমতে রোগমুক্ত হয়েছিলেন সেদিন ছিল আশুরা। হজরত ইউনুস (আ:) চল্লিশ দিন মাছের পেটে থাকার পর আল্লাহর রহমতে যেদিন দজলা নদীর তীরে অবতরণ করেছিলেন সেদিন ছিল আশুরা। এরকম অসংখ্য ঘটনার সরব সাক্ষী আশুরা। কারবালায় ইমাম হোসাইন (রা:) সপরিবারে শাহাদাতের ঘটনা যেদিন ঘটেছিল সেদিন ছিল ১০ই মহররম বা আশুরা। কারবালা সেদিন ছিল ধু ধু মরু প্রান্তর বর্তমানে সেখানে গড়ে উঠেছে এক অত্যাধুনিক নগরী। প্রতিদিন হাজার হাজার জিয়ারতকারীর সমাবেশ ঘটে কারবালায়। তারা হজরত ইমাম হোসাইন (রা:) মাজার শরীফ জিয়ারত করে শহীদী চেতনা উজ্জীবিত হয়। হজরত হোসাইন (রা:) কারবালার যুদ্ধের সূচনাতে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছিলেন। দীর্ঘ ভাষণে তিনি বলেছিলেন, আমার নানা হজরত মুহাম্মদ (সা:) বলেছিলেন হোসাইন, আমার থেকে এবং আমি হোসাইন থেকে কিন্তু ইয়াযিদ বাহিনী তার সেই ভাষণের তোয়াক্কা না করে তাঁকে কতল করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। ইয়াজিদের প্রেতাত্মা আজও রয়েছে। তারা মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে চলেছে। পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে তোমরা আল্লাহর রজ্জু সম্মিলিতভাবে মজবুত করে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিভেদ সৃষ্টি করো না। আল্লাহর এই নির্দেশকে যারা অমান্য করে তারা আল্লাহর শত্রু এবং মানবতার শত্রু। আশুরার মূল শিক্ষা হচ্ছে অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা এবং ঐক্য ও সংহতি। ন্যায় প্রতিষ্ঠার কঠিন সংগ্রামে অসীম সাহসের সঙ্গে আপোষহীন লড়াই করে কিভাবে প্রয়োজনে আত্মবিসর্জন দিতে হয় সেই শিা আমরা লাভ করতে পারি কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা থেকে। লোভ ও হিংসার ব্যাপকতায় আজ বিশ্বের দেশে দেশে মানবতা হয়ে পড়ছে বিপন্ন। মুষ্টিমেয় মানুষের লোভের কাছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর শন্তিতে বেঁচে থাকার আকাঙ্খা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। এ সময়ে কারবালার মহান আদর্শে আমরা উজ্জীবিত হতে পারি। ন্যায়ের প্রতি অবিচল নিষ্ঠাই মানুষকে মুক্তি দিতে পারে সব অন্যায় ও অশান্তি থেকে। পবিত্র আশুরায় তাই প্রার্থনা সত্যের উজ্জ্বল আলোয় দূর হোক মিথ্যার কালিমা। জয় হোক ন্যায় ও সত্যের।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিষ্ট
ও কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি (বাপউস)।



ফেইসবুকে আমরা