বাংলাদেশ, , শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

শুভময় পূণ্য তিথিতে মর্ত্যে মহাবতারের আবির্ভাব শুভ জন্মষ্টমী : লায়ন ডাঃ বরুণ কুমার আচার্য বলাই

  প্রকাশ : ২০১৯-০৮-২২ ১৮:০১:৩৯  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : সনাতন ধর্মীয় শাস্ত্র মতে, যুগে যুগে বিপথগামী মানুষদের সত্য পথে ফিরিয়ে আনার জন্য এবং অপশক্তিকে ধ্বংস করে ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য ভগবান বিভিন্নরূপে এ পৃথিবীতে অবতরণ করেন। ভগবানের এই অবতরণের জন্যই তিনি ‘অবতার’ বলে পরিচিত হন। মহাভারতের রচয়িতা ব্যাসদেব কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকে কেবলমাত্র অবতার বলে অভিহিত করেননি। শৌর্য, বীর্য, ত্যাগ, প্রেম, অনাসক্তি এবং অন্যান্য দিব্যগুণে ভূষিত কৃষ্ণকে দকৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ংদ বলে চিহ্নিত করেছেন।


আজ শুভ জন্মাষ্টমী। পরমপুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথি। বিশ্বব্যাপী শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছেই এ তিথির তাৎপর্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দিবসটি উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বিরা নানা আচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এর মধ্যে আছে উপবাস থাকা, গীতাপাঠ, কীর্তন, প্রসাদ বিতরণ ইত্যাদি। তবে দিবসটি উপলক্ষে ইদানিং সবচেয়ে বড় আয়োজনে আছে জন্মষ্টমীর মিছিল।
‘যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লানি ভবতি ভারত।
অভ্যূত্থানম ধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাম।
ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভাবামি যুগে যুগে।’
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা, জ্ঞানযোগ ৭/৮)
অর্থাৎ হে ভরত, যখন পৃথিবীতে অধর্ম বেড়ে যায় তখনই আমি অবতীর্ণ হই। অবতীর্ণ হয়ে সাধুদের রক্ষা, দুষ্টের বিনাশ ও ধর্ম সংস্থাপন করি। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদগীতায় স্বয়ং ভগবান তার আবির্ভাব সম্পর্কে এ কথা বলেছেন।
সনাতন ধর্মের একমাত্র পূর্ণাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপরে অষ্টমী তিথিতে, অর্থাৎ আজকের এই দিনে আবির্ভূত হয়েছিলেন মাটির এই পৃথিবীতে। তার আর্বিভাব তিথিকে কেন্দ্র করেই শুভ জন্মাষ্টমী উৎসব পালন করা হয়। দ্বাপর যুগে অশুভ শক্তি যখন সত্য, সুন্দর ও পবিত্রতা গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন সেই অশুভ শক্তিকে দমন করে মানবজাতিকে রা এবং শুভশক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে। ভারতবর্ষে তখন ঘোর অমানিশার কাল। রাজ্যলোভে তখন রাজন্যবর্গের মধ্যে রক্তপাত নিত্য ঘটনা। সমাজে যখন অনাচার, অধর্ম, অসততা ছড়িয়ে পড়েছে ঠিক তখন একজন অবতারের আবির্ভাব অনিবার্য হয়ে পড়ে। এ জন্য প্রয়োজন হয় কিছু ঘটনার। সেই ঘটনার মধ্যে দিয়েই শ্রীকৃষ্ণের জন্ম। তার জন্মবৃত্তান্তের পটভূমি সংক্ষেপে অনেকটা এ রকম : মথুরার অত্যাচারী রাজা কংস। তার অন্যায় শোষণে মথুরাবাসী অতিষ্ঠ। মতালোভী কংস এতটাই অত্যাচারী ছিলেন যে, মথুরার সিংহাসন দখল করার জন্য পিতা উগ্রসেনকেও বন্দী করতে পিছপা হননি। এ ঘটনায় অনেকেই কংসের বিপে অবস্থান নেন। চতুর কংস বিপদ বুঝতে পেরে বিদ্রোহীদের, বিশেষ করে যাদবদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে সচেষ্ট হন। তিনি যাদবকূলের শুর সেনের পুত্র, বিশ্বস্ত বন্ধু বসুদেবের সাথে বোন দেবকীর বিয়ে দেন।
ঋদ্বেদে একাধিকবার শ্রীকৃষ্ণের উল্লেখ আছে। শ্রীকৃষ্ণকে দেবকীপুত্র বলা হয়। মহাভারত, বিভিন্ন পুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবত এবং বৈষ্ণবকাব্যে যে কৃষ্ণের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে, তাঁর আবির্ভাব দ্বাপর যুগে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পিতার নাম বসুদেব ও মাতার নাম দেবকী। তিনি পিতামাতার অষ্টম পুত্র। রাজা উগ্রসেনের পুত্র কংসের কারাগারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হন। পিতা বসুদেব শ্রীকৃষ্ণের জীবন বিপন্ন জেনে জন্মরাত্রেই দৈবসহায়তায় কারাগার থেকে তাঁকে গোকুলে যশোদা ও নন্দের কাছে রেখে আসেন। শ্রীকৃষ্ণের জন্মের রাত ছিল গভীর অন্ধকার। তাঁর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে বসুদেব দেখলেন শিশুটি চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম ধারণ করে আছেন। দেখে তিনি বুঝতে পারলেন জগতের মঙ্গলার্থে পূর্ণবৃ নারায়ণ তাদের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন। বসুদেব করজোড়ে প্রণাম ও বন্দনার পর দেবকী প্রার্থনা করলেন। শ্রীকৃষ্ণ একজন সাধারণ শিশুর রূপ ধারণ করলেন। রাতের অন্ধকারে কারাগারে কি ঘটল যোগমায়ার প্রভাবে আর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলায় কংস কিছুই বুঝতে পাললেন না। কিন্তু পরদিন সকালে যখন বুঝলেন তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। ওদিকে মাতা যশোদার কোলে বড় হতে থাকে শ্রীকৃষ্ণ। এরমাঝে কংস নানাভাবে শ্রীকৃষ্ণকে খুজে হত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার সব চক্রান্তই ব্যর্থ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে মথুরাই মল্ল ক্রীড়ার আয়োজন করা হয়। এখানে আমন্ত্রণ জানানো হয় কৃষ্ণ এবং ভাই বলরাম কে। এখানেই কংস কৌশলে কৃষ্ণ বদের আয়োজন করেন। কিন্তু অন্তর্যামী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংসের সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেন। হতভম্ব কংস উপস্থিত নিজ রাজন্যবর্গ, সেনাদল ও সহচর সবাইকে তার পে অস্ত্র ধারন করতে বলেন। কিন্তু কেউই সেই আবেদনে সাড়া দেন না। তখন নিরুপায় কংস অস্ত্র নিয়ে নিজেই শ্রীকৃষ্ণের উপর ঝাপিয়ে পড়েন। অবশেষে কৃষ্ণের লৌহ মুষ্টির আঘাতে কংস ভুপাতিত হন। সমাপ্তি ঘটে সকল অন্যায় অত্যাচারের। বাল্যকাল থেকেই কৃষ্ণ তাঁর অলৌকিক শক্তির প্রমাণ দিয়েছিলেন পুতনাবধ, দামবন্ধন লীলা, কলীয়দমন, গোর্বধন ধারণ প্রভৃতি কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে। নিপীড়িত মানুষ মুক্তির আশায় কানুর তথা কৃষ্ণের অনুসারী হয়ে ওঠে। তিনি জগতের গুরু, তিনি পৃথিবীর সব কলুষিত পরিবেশ ও কলুষিত বন্ধন দূর করে এই পৃথিবীর সব জীবনের মধ্যে আত্মার বন্ধন সূদৃঢ় করেছেন। তিনি অর্জুনের মাধ্যমে গীতার আটার অধ্যায়ে জাগতিক জ্ঞান, ধ্যান, কর্ম, বিভুতি, ভক্তি, মুক্তি, মোহ, যশ, খ্যাতি আর অর্থ-বিত্তের মায়াজাল, অন্যায়, অসত্য, পাপ আত্মহংকার, মোলাভ প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান দান করেছেন। তিনি সব প্রাণীর মধ্যে তমগুণের প্রভাব অর্থাৎ অসৎ কার্য পরিহার করে ন্যায়-সত্য প্রতিষ্ঠা করেন। সকল অবতারের সারটুকু দিয়ে তৈরি তিনি, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বজনীন নেতা। জগতের মঙ্গলের জন্য নিবেদিত তার প্রাণ। আর এ কারণেই সকল সময়ে সর্বত্র তার স্তব হয়। তিনি জগৎশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ বলেই যুগে যুগে উচ্চরিত হবে তার নাম। ‘কৃষ্’ মানে সত্তা আর ‘ণ্ এর অর্থ হলো আনন্দ। এই দুই মিলিয়েই তিনি কৃষ্ণ। সেই পরমপুরুষ মহাবতার শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথিতে পৃথিবী থেকে দূর হোক সকল অসত্য, অন্যায়, অধর্ম। ন্যায়ের পক্ষে ভগবদ ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে জীব শিক্ষার জন্য বিভিন্ন কর্ম করেন। আগামী দিনে সত্যের পথে চলার মতো আলোক বর্তিকারূপে বিভিন্ন শিক্ষা দিয়ে থাকেন। শুভ হোক জন্মাষ্টমী। আজকের এই পুন্য তিথিতে ভগবানের সঙ্গে আমাদের চিন্ময় সম্পর্ক গড়ে উঠুক, এটাই হোক আমাদের প্রার্থনা।

লেখক: কলামিষ্ট, প্রাবন্ধিক ও মরমী গবেষক।



ফেইসবুকে আমরা