বাংলাদেশ, , শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

শিশু অধিকার নিশ্চিত করে তাদের বেড়ে উঠার সুযোগ দিন : লায়ন ডাঃ বরুণ কুমার আচার্য বলাই

  প্রকাশ : ২০১৯-০৭-২৭ ২০:৪৯:১১  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : শিশুরা মানব বাগানের ফুল। এই শিশুরা দেশ ও রাষ্ট্রের সেরা সম্পদ। শিশুদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতপূর্বক সু-নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদেরই। শিশুদের নিরাপত্তা যদি যা যায় এবং মেধা ও নিরাপত্তা বিকাশে কার্যকর পদক্ষেপ না নিই তবে তা দেশের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি স্বরুপ। শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আগামীর ভবিষ্যত নির্মানের দায়িত্ব শিশুদের হাতে। কেননা এদের মধ্যে কেউ হবে বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাষ্ট্রনায়ক প্রভৃতি। আবার কেউ ঝরে যাবে ভবিষ্যতের ক্রুর, বৈরী পৃথিবীর ক্ষুধা দরিদ্র, পুষ্টিহীনতা, নিরাপত্তাহীনতার আবর্তে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। তবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। অনেক শিশু অনাথ-এতিম হয়ে পড়ে। এইসব অনাথ নিরীহ শিশু সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তার উন্মেষ ঘটার পর ১৯২৪ সালে জাতিপুঞ্জ ঘোষণা দেয় ‘মানব জাতির সর্বোত্তম যা কিছু দেয়ার আছে, শিশুরাই তা পাবার যোগ্য।’ কিন্তু বড়ই দুর্ভাগ্যের বিষয়, শিশুদের সমস্যার সমাধান হতে না হতেই শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এবারও লক্ষ লক্ষ শিশু অসহায়, অনাথ, এতিম হয়ে পড়ে। আবারও তারা মানবেতর জীবন-যাপনে বাধ্য হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪০ সালে শিশুদের সার্বিক উন্নয়ন ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আসে জেনেভা ঘোষণা। এরপর ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর ভিয়েনাতে জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। এরই আলোকে ২০ নভেম্বর, ১৯৮৯ সালের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে শিশুদের প্রতি বিশেষ যত্ম ও সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ ঘোষণা করা হয়। অবশ্য ইতিপূর্বে ১৯৫২ সালে আন্তর্জাতিক শিশু কল্যাণ ইউনিয়ন বিশ্ববাসীর দৃষ্টিকে সুদূরপ্রসারী ও জাগ্রত করার জন্যে একটি নির্দিষ্ট দিনে একটি শিশু দিবস উদযাপনের প্রস্তাব আনে। ১৯৫৩ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার উদযাপিত হয় প্রথম বিশ্ব শিশু দিবস। ৪০টি দেশ প্রথম বিশ্ব শিশু দিবস পালন করে। এরপর ১৯৫৪ সালে জাতিসংঘের সদস্যদের উদ্যোগে শিশুদের বিভিন্নমুখী উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এর ফলে বিশ্বের সকল দেশের শিশুদের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। শিশুদের প্রতি বিবেকবান সহৃদয়বান মানুষের সহানুভূতি বৃদ্ধি পায়। পাঁচ বছর পর পুনরায় ১৯৫৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয় শিশুদের জন্য ১০টি অধিকার, যা বিশ্বের সব শিশুর ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো বর্ণবৈষম্যের প্রভাবমুক্ত অধিকারগুলি হলো: ১. জাতি, ধর্ম, বর্ণ অথবা জাতীয়তা নির্বিশেষে শিশুরা অধিকার ভোগ করবে। ২. স্বাধীন, মুক্ত ও মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশ সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক বিকাশে শিশুরা বিশেষ নিরাপত্তা ও অবাধ সুযোগ ভোগ করবে। ৩. জন্মসূত্রে প্রতিটি শিশুর একটি নাম ও জাতীয় পরিচয় থাকবে। ৪. আবাসিক সুবিধা, প্রচুর পুষ্টি, বিনোদন ও স্বাস্থ্য পরিচর্যাসহ সামাজিক সুবিধা থাকবে। ৫. পঙ্গুত্ব ও প্রতিবন্ধী শিশুদের শুশ্রুষা, শিক্ষা ও পরিচর্যা নিশ্চিত করতে হবে। ৬. যতদূর সম্ভব মা-বাবার আশ্রয়ে ও তত্ত্বাবধানে প্রীতি ও সমঝোতা এবং নিরাপত্তার স্নেহময় পরিবেশে শিশু থাকবে। ৭. স্বকীয় সত্তা বিকাশে সমান সুযোগ এবং বিনা ব্যায়ে শিক্ষা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। ৮. দুর্যোগের সময় শিশু অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিরাপত্তা ও ত্রাণ পাবে। ৯. অবজ্ঞা, নিষ্ঠুরতা এবং শোষণের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা দিতে হবে। ১০. ধর্ম বর্ণ বা অন্য যেকোনো ধরনের বৈষম্য থেকে নিরাপত্তা এবং শান্তি ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের পরিবেশে শিশুকে গড়ে তুলতে হবে। শিশু অধিকার ঘোষণার পর ১৯৮৯ সালে সারা বিশ্বে বিশেষ শিশু বর্ষ উদযাপিত হয়। ১৯৮৯ সালে পুনরায় জাতিসংঘে শিশু অধিকার সম্পর্কে বিশ্ব রাষ্ট্র প্রধানরা একত্রিত হয়ে আলোচনায় মিলিত হন। মতৈক্য হয় নতুন শিশু অধিকার সনদ তৈরি করার প্রতি।

এই সনদে ৫৪টি ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সব ধারাতেই কিছু নির্দিষ্ট সুফল ভোগ করার ও কিছু তিকর দিক থেকে রা পাওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এইভাবে ৫৪টি ধারা সম্বলিত শিশুর সার্বিক অধিকার সনদ প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু আজও শিশুদের অধিকার পুরো বাস্তবায়িত হচ্ছে না। শিশুরা পাচ্ছে না তাদের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলো বাস্তবায়নের সুযোগ। প্রতি বছর শহরে বসবাস করা শিশুরা নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে বিশ্ব শিশু দিবস উদযাপনের সুযোগ পেলেও দেশের বৃহত্তর অংশের শিশুরা দিনটি সম্পর্কে কিছুই জানে না। তারা শিক্ষার আলো থেকে হয়ে আছে বঞ্চিত। অনেকেরই যদিও বা একটু-আধটু স্কুল-মাদরাসায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো, তারাও দারিদ্র্যের কষাঘাতে প্রতিষ্ঠান ছেড়ে জীবিকার তাগিদে কাজে নামতে বাধ্য হয়েছে। যে বয়সে তাদের হাতে স্কুল-মাদরাসার বই-খাতা থাকার কথা, সেই বয়সে কেউ রিকশা চালাচ্ছে, কেউ কাগজ কুড়াচ্ছে, কেউ ইট পাথর ভাঙ্গছে আবার কেউ বাসের হেলপার হয়ে জীবন কাটাচ্ছে। এমনিভাবে আমাদের দেশে শিশুশ্রম দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর প্রধান কারণ দারিদ্র। দারিদ্র দূর করতে না পারলে শিশুশ্রম বন্ধ হবে না। একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই এ শিশুদের জীবনে বিকাশ এবং শিশুশ্রম বন্ধ করা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে আমাদের একটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে, শিশুটি যে উদ্দেশ্যে শ্রম দিচ্ছে সেটি মেটানো। আমাদের দেশের প্রোপটে দেখা যায়, বেশিরভাগ শিশুই খাদ্যের বিনিময়ে কাজ করছে বা অন্নসংস্থানের উপায় হিসেবে কাজ করছে। এক্ষেত্রে যদি শিশুদের সংঘটিত করা যায়, তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ করা যায়, তাহলেই শিশুকে শিক্ষার আওতায় আনা যাবে। শিশুদের খাবার চিন্তা যদি না থাকে, তাহলে শিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হবে। কেননা জীবনধারণের জন্য প্রথম ধাপ হলো খাদ্য। সুতরাং একজন শিশুর খাদ্য নিশ্চিত হলে সে অন্যান্য অধিকার রায় মনোযোগী হবে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, শিশুশ্রম রোধ একদিনে সম্ভব নয়। কারণ বিষয়টির সঙ্গে জীবনধারণের প্রয়োজন জড়িত রয়েছে। তাই বল প্রয়োগ করে শিশুশ্রম বন্ধ করলে শিশুর তির আশঙ্কাই বেশি। অতএব, এক্ষেত্রে সমাজের সবার উচিত, মানবিক দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে আসা। শিশুদের শ্রমের ক্ষেত্রে কিছু শর্তারোপ করা প্রয়োজন। সারা দিনের কঠোর শ্রম নয়, দিনের কিছু নির্ধারিত সময়ে শ্রম দেয়া, অতিরিক্ত কোনো কাজ চাপিয়ে না দেয়া এবং অবৈধ কোনো কাজ না করানো। এসব বিষয় লক্ষ্য রেখে শিশুশ্রম নির্ধারণ করা প্রয়োজন। একটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে, দিনের বিশেষ একসময়ে শিশুকে পড়ার সুযোগ দিতে হবে। সেটা শিশুর জীবনের উন্নয়নের জন্য যেমন প্রয়োজন, ঠিক সমাজের সার্বিক কল্যাণেও অত্যন্ত জরুরি। তাছাড়া শিক্ষার মাধ্যমে গড়ে ওঠে দক্ষ জনশক্তি। আমাদের আজকের শিশুকে যদি আমরা দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে চাই, তাহলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। প্রতিটি শিশুই ফুলের মতো ফুটবার এবং সুন্দররূপে বিকশিত হবার বা বেঁচে থাকার আছে অধিকার । বড় কষ্টের বিষয় হল সম্পদের অসম বণ্টন এবং সামাজিক অসংগতির শিকার হচ্ছে আমাদের চারপাশেই থাকা অনেক শিশু । যাদের কথা কলম ধরার অথচ সেই সকল কচি হাতগুলো হয়ে ওঠছে শ্রমের হাতিয়ার। গাছ লাগিয়ে শুধু ফলের আশা করলে হবে না, গাছের পরিচর্যাও প্রয়োজন, গাছের যেমন পরিচর্যা করা হবে গাছ তেমন ফলই দিবে । সুতরাং আমরা যদি আজকের শিশুদের আগামির ভবিষৎ ভাবি তাহলে তাদের প্রতি আমাদেরও যতœশীল হতে হবে শিশুদের লেখাপড়া শিখিয়ে বড় হওয়ার সুযোগ দিতে হবে তবেই তাদের কাছে ভবিষৎ ভালো কিছু আশা করা যাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে আজকের এই শিশুরাই ভবিষৎ প্রজন্মকে পরিচালনা করবে। আর সে শিশুরাই যদি পরে থাকে অবহেলিত হয়ে তাহলে কি করে গড়বে তারা আগামী প্রজন্মকে? তাই এগিয়ে আসুন শিশু শ্রম বন্ধ করি আর আগামীতে একটি সমৃদ্ধির বাংলাদেশ গড়ি।

লেখক: শিশু সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, মরমী গবেষক ও গ্রন্থপ্রনেতা।



ফেইসবুকে আমরা