বাংলাদেশ, , শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

মানব পাচার রোধে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে :: ডাঃ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন

  প্রকাশ : ২০১৯-০৮-১০ ২০:১২:৫৯  

পরিস্হিতি২৪ডটকম : মানব পাচার বিশ্বব্যাপী একটি সমস্যা এবং একটি ঘৃণ্য অপরাধও বটে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে মানব পাচার পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যা খুবই উদ্বেগজনক ও নিন্দনীয়। জাতিসংঘের মতে মানব পাচার হল, “ভয় দেখিয়ে বা জোর করে অথবা কোনোভাবে জুলুম করে, হরণ করে, প্রতারণা করে, ছলনা করে, মিথ্যাচার করে, ভুল বুঝিয়ে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে, দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, অথবা যার উপরে কর্তৃত্ব আছে পয়সা বা সুযোগ-সুবিধার লেনদেনের মাধ্যমে তার সম্মতি আদায় করে শোষণ করার উদ্দেশ্যে কাউকে সংগ্রহ করা, স্থানান্তরিত করা, হাতবদল করা, আটকে রাখা বা নেওয়া।” সংজ্ঞাটির ব্যাখা যা-ই হোক না কেন, এ কথা সত্যি যে নানাবিধ কারণে মানুষ নানাভাবে পাচারের শিকার হচ্ছে। চাকরির প্রলোভন, উন্নত জীবনের স্বপ্ন, নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা বা বসবাসের ভালো পরিবেশ দেওয়ার কথা বলে একশ্রেণির মানুষ এই ছলচাতুরি করে পাচারের সুযোগ নেয়। মানব পাচার একটি জঘন্য অপরাধ। এটি মানবাধিকার পরিপন্থী। সভ্য দুনিয়ায় মানবপাচার সহনীয় কোনো কাজ নয় এবং কোনো সুস্থ মানুষ ও সভ্য রাষ্ট্র এটিকে সমর্থন করে না। তীব্র ঘৃণা মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে। মানুষের অসহায়ত্ব পুঁজি করে যারা ব্যবসা করে তারা চিরকাল ঘৃণিত, কারন তারাই স্মরণ করিয়ে দেয়, গ্রীস-রোম-আরব-আফ্রিকার ক্রীতদাস প্রথা। বুকের রক্তে লাল সবুজে খচিত পতপতকরে উড্ডীন পতাকার দেশ, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার দেশ বাংলাদেশ এহেন ঘৃণ্যমানব পাচার কখনোই সমর্থন করেনি, সমর্থনের প্রশ্নও ওঠে না। মানব পাচারের ভয়াল এই থাবা থেকে বাংলাদেশও কোনোভাবে নিরাপদ নয়। আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর প্রচুর সংখ্যক মানুষ পাচারের শিকার হচ্ছে। কেউ বা পাচার হয়ে ফিরে কিছুদিন পরে ফিরে আসছে, আবার কেউ চিরদিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে রয়েছে। অনেক সময় সামাজিক লোকলজ্জার ভয়েও পাচারের শিকারের পরিবার ঘটনাটি জানায় না। ফলে ঘটনা আমাদের আর জানা হয় না, জানা যায় না কার মাধ্যমে এই সর্বনাশটি ঘটল। মানব পাচারে দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা দেখা যায়। তবে সম্প্রতি মানব পাচার নিয়ে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তা বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত। মানব পাচারের ক্ষেত্রে একটি থাকে সোর্স রাষ্ট্র যেখান থেকে পাচার হয়, একটি থাকে ডেসটিনেশন রাষ্ট্রযেখানে পাচার হয়ে যায় আর যেক্ষেত্রে সোর্স রাষ্ট্র ও ডেসটিনেশন রাষ্ট্রের মধ্যবর্তী কোনো রাষ্ট্র পাচারে ব্যবহৃত হয় সেই রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রসমূহ হলো ট্রানজিট রাষ্ট্র। বিশ্বব্যাপী এ মুহূর্তে যে সমস্যা মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে তা হচ্ছে উল্লেখিত সংশ্লিষ্ট দেশে মানব পাচার। অর্থনৈতিক মুক্তিখোঁজা বাংলাদেশের নাগরিক ও মায়ানমার রোহিঙ্গা মুসলমান যাঁরা নিজ নাগরিক মর্যাদা ও সম্মান প্রাপ্তি হতে বঞ্ছিত তারা তথাকথিত ‘কলম্বাস’ বা ‘টারজান’ ভিসা নিয়ে আপন জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে পরদেশে পরবাসী হতে পাড়ি জমায়। জীবনের সমূহ ঝুঁকি উপেক্ষা করে সকল মায়া-মমতা ত্যাগ করে কল্পিত জীবনের নিরাপত্তায় দু’মুঠো ভাতের জন্য মা ও মাটি চ্ছিন্ন হয়। প্রকৃত পক্ষে তারা প্রলোভনে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় শিকড় ত্যাগ করে পরিযায়ী পাখির মতো আশ্রয় খোঁজে। রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক আইন পাখির যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পাচার হওয়া মানুষের ক্ষেত্রে মৌলিক ও মানবাধিকার প্রয়োগে পাখির মতো নিরাপত্তাও নিশ্চিত করে না বা হয় না। এজন্য কালক্ষেপণ হয়। পাচার হওয়া সাগরে ভাসামৃত্যু পথযাত্রি মানুষের জন্য মানুষের দরদ সৃষ্টিতে এত দীর্ঘ সময়ের অপচয় দেখে এমন শ্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। মানুষ মানুষের জন্য-একথা পাচার হওয়া মানুষের জন্য প্রমাণ করতে বহু সময় লেগে গেল। প্রলোভন- ছলনায়ই শুধু পাচার হয় না, পাচার হয় বৈষম্য-বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য, ন্যায় বিচার প্রাপ্তির জন্য, মানবাধিকার লাভের জন্য, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। যুগপৎ পাচারের কারণ, মুক্তিপণের দাবি পূরণে ব্যর্থতা, দেহ-ব্যবসা, শরীরের কোনো অঙ্গ চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করা ইত্যাদি। পাচার যেভাবেই হোক এটি নৈতিকতা, আইন ও ধর্ম সমর্থন করে না। তাই সাগরে ভাসা মানুষের জন্য দেরিতে হলেও এত উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। প্রতিবছর কত মানুষ পাচারের শিকার হচ্ছে তার সঠিক তথ্য-উপাত্ত না থাকলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গত ৩০ বছরে প্রায় এক মিলিয়ন (বা ১০ লাখ) মানুষ বাংলাদেশ থেকে পাচারের শিকার হয়েছে। আমাদের দেশ থেকে সীমান্তপথে ভারতে অথবা সাগরপথে মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে নিয়মিত পাচার হচ্ছে। মূলত নারী ও শিশুরা বেশি সংখ্যায় পাচারের শিকার হচ্ছে। কারণ, আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থার আলোকে তারা বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে বরাবরই স্বীকৃত। সাম্প্রতিককালে বিদেশে চাকরি দেওয়ার নামেও পাচারকারীরা নতুনভাবে এই ঘৃণ্য অপকর্মটি করে যাচ্ছে যা থামানো দরকার। বাংলাদেশ থেকে যাঁরা বিদেশে যায় তারাআর্থিক দুর্দশা থেকে উত্তরণের জন্য, ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য, খাওয়া-পরারজন্য কল্পিত সুখের দেশের পথে পা বাড়ায়। মানব পাচার রোধে প্রথমে যা দরকার তা হল, সামাজিক সচেতনতা তৈরি। সবাই যদি সচেতন হই তাহলে পাচাররোধ করা যাবে সহজেই। তাছাড়া যেসব আইন বা নীতিমালা রয়েছে সর্বশক্তি দিয়ে সেসবের প্রয়োগ করতে হবে। রাষ্ট্রের পক্ষে আইন বাস্তবায়নে যাঁরা নিয়োজিত রয়েছেন তাদের সদিচ্ছা যদি থাকে তাহলে সহজে পাচারের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব। আমরা জানি পৃথিবীর কোনো আইন শতভাগ পরিপূর্ণ নয়। সময়ের প্রয়োজনে নতুন নতুন আইন প্রণীত হবে এবং হচ্ছেও। তবে সবার সদিচ্ছা আর সন্মিলিত উদ্যোগ মানব পাচারের মতো ঘৃণ্য আপরাধকে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলোপ করতে পারে। এ ছাড়া পাচারের শিকার হচ্ছে যারা তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতির হাত বাড়াতে হবে। আমাদের অনাদর বা অবহেলায় পাচারের শিকার কেউ যেন সমাজের মূলস্রোত থেকে হারিয়ে না যায় সেদিকে সদয় দৃষ্টি দিতে হবে।

লেখক: প্রবন্ধিক, কলামিষ্ট ও সভাপতি, বৃহত্তর চট্টগ্রাম ডেন্টাল এসোসিয়েশন।



ফেইসবুকে আমরা